পাটালিগুড় আর কেক নিয়ে বসে বুড়ো। কেক ক'টা বিক্রি হলে বাঁচে। ওদের গোপালের জন্মদিন আজ। বুড়ো কেক খায় না। ডিম আছে। গলায় তুলসীমালা। গোপাল মন্ত্র দিয়েছেন গুরু।
শীতের রোদে আমেজ আছে বেশ। কি সুন্দর শীতের আমেজে জন্মেছে ওদের গোপাল। আমাদের কেমন ভরা বর্ষায়। বুড়ো এইসব ভাবছে। খরিদ্দার খুঁজছে। পাটালির উপর মাছি তাড়াচ্ছে।
জবা এসেছে বাজারে। জবার এক যুগে অনেক পুরুষ ছিল। সে নিজেও ছিল। জবা মাছের দরদাম করছে। ফষ্টিনষ্টি করছে। বুড়ো মনে মনে বলল, শালা বয়েস হল, রস কমল না।
জবা এদিকে আসছে। বলল, কি গো নাগর, তুমি গলায় তুলসীমালা দিয়ে খেস্টানের ঠাকুরের প্রসাদ বিক্রি করো কেন গো? জাত খোয়ালে নাকি!
বুড়োর রাগ হল। কিন্তু বাজারে কথা বাড়িয়ে লাভ কি? ওর মুখের আগল আছে?
জবা বসল উবু হয়ে। সামনে। বলল, নাতিটা এসেছে। একটা কেক দেবে? পরে টাকা চুকিয়ে দেব।
বুড়ো তাকালো জবার চোখের দিকে। জবা মিথ্যা বলে যখন বোঝা যায়। সত্যি বলে যখন হয় ঝাঁঝে কান জ্বলে যায়, নয় তো বুকে কাঁটা বেঁধে। টাকা তো অনেকবার জবাও নেয়নি। জবার ছেনালি সহ্য হয়। জবার ভিক্ষা সহ্য হয় না। মাটি নরম হলে পোকা যেমন গর্ত করে, জবার দুর্দিনে, অনেকে তার মত সুযোগ নিয়েছে। সে নিজেও।
জবার হাতে দামী কেকটা তুলে দিল। কিছু বলল না। দয়ামায়া না থাকলে সুয্যচন্দ নামবে উঠবে না সংসারে, এই কথাটা সার বুঝেছে বুড়ো। মা দুর্গা যখন পরিবার নিয়ে পুজোতে আসে, বুড়ো তখন মায়ের সংসারের জন্যেও প্রার্থনা করে গোপালের কাছে। মানুষের মনে পাপ বাসা বাঁধে। এ সত্য। কিন্তু মানুষের উপর করুণায় সে পাপ ধুয়ে যায়। নইলে এ পড়ন্ত শরীর জবার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কান্না পেল কেন? জবা কি শুধু শরীরটাই দিতে চাইত? বিশ্বাসে আঘাত লাগলে মানুষ হিংস্র হয়। আহত বাঘ বেশি ভয়ংকর, কথায় আছে না? জবার রুক্ষ হয়েছে সখে না, বাধ্য হয়ে। জবার বিশ্বাস ভেঙেছে কারা?
জবা চলে গেল। বুড়ো কেকের দাম দু টাকা কমিয়ে বিক্রি করল। সব বিক্রি হল। জবা যেন লক্ষ্মী। বড় খাঁটি মেয়েটা।
বুড়ো সন্ধ্যে করতে বসেছে গোপালের সামনে। চোখ বন্ধ। হঠাৎ দেখল ওদের গোপাল জবার হাত ধরে তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো যেন, বলল, নিয়ে গেলাম ওকে। তুমি ঠিক চিনেছ। জবা খাঁটি। ভীষণ খাঁটি।
বুড়ো দেখল, ওদের গোপালের ঠোঁটে তার বিক্রি করা কেকের টুকরো। জবা হেসে বলল, এই আমার নাতি গো… আমার প্রাণ।
বুড়ো কাঁদল। পুজোর আসন তুলে, গুছিয়ে রেখে, খাটে বসেছে, বউ এসে খবর দিল…. মাগীটা মরেছে…. শুনেছো….
বুড়ো হাঁ করে তাকিয়ে….
বউ বলল, আরে ওই জবা…. ছি ছি… সন্ধ্যেবেলা ও নাম মুখে আনালে….
বুড়োর গলাটা খামচে এলো কান্না। বলল, সেকি! এই তো…. বড় অভাগী..…..
কেউ দাঁড়ালো না শোনার জন্য। বুড়ো গায়ে জামাটা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে। জবা কাউকে না বলে চলে যাবে? এত অভিমান? মানুষ শুধু হাত পাততে দাঁড়ায় না, কি মানুষের সামনে…কি ঈশ্বরের সামনে… এটা বোঝে না বাইরের লোক… জবা কি চায়… বোঝেনি কেউ?