মিষ্টির দোকানের বেঞ্চটা নর্দমার উপর পাতা। নর্দমা নদী না। কিন্তু জলের স্রোত তো। আর এই বড় নর্দমার জলে এত স্রোত যে ময়লা জমে না। একটু দূরে নর্দমার উপরেই দুটো পেচ্ছাপ করার জায়গা বানিয়ে দিয়েছে মিউনিসিপালিটি থেকে। মেয়েদের ওসব করার জন্য আরো ভিতরে যেতে হবে, বাজারের মধ্যে। আর তাদের জন্য?
দোকানটা বাবার। এখন সে বসে। মা অসুস্থ। আগে মা বসত। পাহারা দিত। এখন বিনুনি নিজেকে নিজেই পাহারা দেয়। মিষ্টির মত। মাছি বসে যেমন। তেমন চোখ বসে। কৌতুহল। অপমান। সয়ে গেছে। অপমানে বুক জ্বলে। কামনায় বুক জ্বলে। হতাশায় বুক জ্বলে। তার বারবার মনে হয় এ সব কিছুই ঠিক হচ্ছে না। সব ছেড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় যাবে। সেখানে সব ঠিক হবে। যেতে পারে না। মা আছে না? আবার বুক জ্বলে।
"এই বিনু, ক্লাবের পুজোয় চাঁদা দিবি না? দোকান করতে দেবে না কিন্তু!"
মাসির মেয়ে। রাজনীতি করে। তার কাছে একে তাকে ধরে আনে। ক্লাব থেকে। শুতেই হয়। বাঁচতে গেলে মান-সম্মান থাকতে হয়। তার মান-সম্মান নেই। সবাই জানে সে আসলে হি… সে ফুটপাত মানুষ। দাঁড়ানো যায়। দোকান খোলা যায়। বসা যায়। সংসার পাতা যায় না বেশিদিন। ফুটপাত সব দেয়, সংসার দিতে পারে না।
একটা বিড়ি ধরিয়ে বিনুনি ক্লাবে এলো। সিনেমা চলছে টিভিতে। হল প্রিন্ট। নায়িকাটা নতুন, নাম মনে নেই। বেঞ্চে বসল।
"ভালো মাল আছে, আনব?"
আন।
আজ রাতে বাড়ি যাবে না। ক্লাবেই থেকে যাবে। ঘুম এসে যায় আজকাল যেখানে সেখানে। স্বপ্ন পঙ্গু হলে ঘুম যেখানে সেখানে চলে আসে। শরীর, মন, সেক্স সব সহজ এখন। ডাকলেই চলে আসে নেড়িকুকুরের মত। আয় আয়... চু চু চু…। আবার ফিরে যায় ঝটকা মেরে ফেলে দিলেই। জীবনটা পোষ মেনে গেছে ভীষণ। এতটা না মানলেও হত।
আজ নিল তিনজন। কি সুখ পায় ওরাই জানে। কোমর থেকে টাটাচ্ছে। কদিন থাকবে ব্যথাটা। ক্লাবে কেউ নেই এখন। সবাই বাড়ি চলে গেল। দু’জনের তো আবার বউ আছে। পোষা মেয়েমানুষ। রাতে ওখানে লাগাবে। এঞ্জয়… এঞ্জয়… অল দ্য বেস্ট…
রাত দুটো। ক্লাবের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বিনুনি। পোশাক পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো করে রাখা। রাখা না, ফেলা। সেন্টের আর মদের গন্ধ মিশে ম ম করছে। কে যেন একটা সেন্ট দিয়েছিল। নইলে তার গা থেকে নাকি রসগোল্লার রসের গন্ধ আসে! কি আশ্চর্য, পোশাকে মানুষ কত আলাদা। কিন্তু ন্যাংটো হয়ে বিছানায় গেলে, আলো নিভলে শুধু শিকার শিকারী খেলা। কেউ জেতে না এই খেলায়। দু’জনেই হারে। জেতে কিছুটা সময়, সব ভুলিয়ে দিয়ে। ঠকিয়ে নিয়ে।
বিনু ভালোবাসায় বিশ্বাস করে। কিন্তু আশা রাখে না। ভগবানের দশ হাতের মত। আছে, কিন্তু নেই। বিশ্বাসে আছে, আশায় নেই। ঘড়িটার পাশে দুর্গা ঠাকুরের ছবি। ক্লাবের পুজোর। প্রতি বছর বাঁধায়। বিনু উঠে দাঁড়ালো। টলছে পা, মাথা। ক্লাবের জানলাগুলো বন্ধ। টিউবটা জ্বালল। দুর্গার সামনে এসে দাঁড়ালো। নগ্ন।
কি লাফড়া বানিয়েছ মা… তাকাও… এদিকে দেখো.. আরে ও তোমার পোষা অসুর… নইলে ফি বছর এই এক ড্রামা করতে আসে?.. ওকে ছাড়ো… আমার দিকে তাকাও… নীচে উপরে কি সব সেটিং… মাথা ঠিক ছিল না তোমার? হে… হে… হো.. হো… মাথা ঠিক ছিল না?...
বিনু উবু হয়ে বসল। ছবির দিকে মাথাটা উঁচু করে তাকিয়ে। তোমায় কতজনে মিলে যেন এ সব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল? এমনিই? শুধু ওই অসুরকে খাল্লাস করবে বলে? কি ডিল ছিল? তারপর?...
আমার দিকে তাকাও। আমি কে বলো তো? শিখণ্ডী। নাম শুনেছ না? ভীষ্ম, না দ্রোণাচার্য কাকে মারলাম যেন? ভীষ্ম… না ঢাল, না তরোয়াল.. আমার জন্যে মরে গেল। স্রেফ আমার জন্য। সেই অভিশাপ লাগল মা… সেই অভিশাপ… কাউকে পেলাম না… কাউকে না…
বিনু শুয়ে। কাঁদছে। হঠাৎ থেমে গেল। যেন কি একটা ভুল হঠাৎ শুধরে নিল। নিজেকে নিজেই যেন অপ্রস্তুত করল। মোবাইলটা অন করল। কয়েকটা সেল্ফি তুলল। কি সুন্দর। অপূর্ব লাগছে নিজেকে। কোনোদিন ধর্ষণ শব্দটায় বিশ্বাস হয় না। ওরা অনুপ্রবেশকারী। কেউ কেউ তো আবার শরণার্থী। কি অসহায় ওই সময় পুরুষগুলো, দেখলে মায়া লাগে। ব্যথা লাগে। মায়া লাগে। নগ্ন পুরুষ শুধু পোশাক খোলে না, নিজের দাঁড়ানো ইগোকেও শুইয়ে দেয়। যেটা দাঁড়ায়, ওটা লজ্জা। ওদের শৃঙ্খল। নিজের পায়ে নিজের ও অঙ্গ জড়িয়ে মরে শালারা….
বিনু হাসছে। উপুড় হয়ে শুয়ে হাসছে। মোবাইলের গ্যালারিতে গেল। নিজের ছবিতে ভর্তি। কি সুন্দর সে। কিন্তু কাকে পাঠাবে? এরকম সেল্ফি অনেকবার তুলেছে আর ডিলিট করেছে। কেউ তাকে নগ্ন করে কেন বলে না তুমি কি সুন্দর বিনু! ছিদ্রান্বেষী পুরুষের দল। তোমাদের চোখে, বুকে পায়ে শুধু তোমাদের ওই একটাই অঙ্গ পেঁচিয়ে। অন্ধ। বোকা। পঙ্গু।
বিনু হোয়াটসঅ্যাপ অন করল। কাকে পাঠাবে? একটা একটা নাম স্ক্রল করে যেতে লাগল। একটার পর একটা নাম। কত কথা লেখা। সব অতীত। সব মিথ্যা। সব মিথ্যা। তবু হোয়াটসঅ্যাপ সব মনে রাখে। বোকা কোথাকার! মোবাইলে একটা চুমু খেল। না চুমু না, কিস করল। চুমু বড় আদুরে শব্দ। কিস… নাভি থেকে বুক জ্বালিয়ে দেয় এই শব্দটা।
এই বিনু… দরজা খোল.. দরজা খোল….
বিনু দরজা খুলতে সময় নিল। বেশ বেলা হয়ে গেছে তো!
পাড়ার খোকনদা।
মাসিমা… মাসিমা….. তুই চ শিগগির.. কি সব্বোনাশ হয়ে গেল রে…
বিনু বুঝল। বলল, হাঁপাচ্ছ কেন? ড্রামা কোরো না.. আমি আসছি। তুমি যাও।
বিনু ক্লাবের ভিতর এলো। দুর্গার সামনে দাঁড়ালো। কান্না পাচ্ছে না। মুক্তি লাগছে। কানে শুনছে হাওড়া স্টেশানের অ্যানাউন্সের আওয়াজ। কোমরটা টাটাচ্ছে। অনেক জায়গায় যাওয়ার আছে। কিন্তু কোথায় যাবে? আজ রাতেই পুরী গেলে হয় না? অনেকদিন ইচ্ছা সমুদ্রে নামবে। সমুদ্রে ডুববে। সমুদ্রকে সরাসরি দেখিয়ে নেবে, তার সেল্ফি। নদী বোঝে না, তার ভীষণ তাড়া। সমুদ্র বুঝবে তাকে। তার সব না বলা নোনতা কথাকে বুঝবে সমুদ্র। কত মানুষের কত না বলা কথা আর না কাঁদা কান্না জমেই না সমুদ্র এত নোনতা!
হাত জোড় করে দাঁড়ালো। দুর্গার দিকে তাকালো, প্রণাম করে বলল, থ্যাংকিউ দিদি। ভালো থেকো।