Skip to main content

মারিয়াম্মার মন্দিরে পা দুটো দরজার দিকে ছড়িয়ে বসে, বাষট্টি ছোঁয়া বিন্দু।

চেন্নাই আর ভেলোরের মধ্যে ছোট্টো একটা গ্রাম এই পেরুল। সেই গ্রামের বহু পুরোনো মন্দির এই মারিয়াম্মার মন্দির।

মারিয়াম্মা বৃষ্টির দেবী। আরোগ্যের দেবী। সেই প্রাচীন তামিল সাহিত্য, “সঙ্গম”, সেখানেও মারিয়াম্মার উল্লেখ আছে। এই গ্রীষ্মের শুরুতেই গ্রামে মারিয়াম্মা উৎসব হবে। মাটির কলসীতে গাছ নিয়ে, তাতে মালা ফুল দিয়ে সারা গ্রাম ঘোরানো হবে। এই মন্দিরের চাতালে গোটা গ্রামের ভোজের আয়োজন হবে। এসব বিন্দু সেই ছেলেবেলা থেকে দেখা আসছে। নিজের মা, দিদিমা, মারিয়াম্মা… সবাইকে একই লাগে বিন্দুর। তার গ্রাম তো এই কটা গ্রাম পরেই। আদারি।

বিন্দুর গোটা শরীরে বাতের যন্ত্রণা। বিন্দুর দুই ছেলে চেন্নাইতে থাকে। একজন বাসের কন্ডাক্টর, আরেকজন হোটেলে কাজ করে। ওদের বাবা নেই প্রায় দশ বছর হল। বিন্দু একাই থাকে। বিন্দুর মা-ও একাই থাকে, তাদের চারবোনের মধ্যে বাকি কেউ বেঁচে নেই। সে আর তার মা বেঁচে শুধু। আর বেঁচে মারিয়াম্মা।

বিন্দুর খুব ইচ্ছা মাকে একবার শেষবারের মত দেখে আসে। মা মৃত্যুশয্যায়। ও গ্রাম থেকে যারাই আসে তারাই বলে, বিন্দু, যাও একবার দেখে এসো।

======

প্রচণ্ড মেঘ করে এসেছে। বিন্দু বসে বসে মারিয়াম্মার কাছে প্রার্থনা করছে, একবার মাকে দেখতে দাও মা…মা…কেউ নিয়ে যাক আমায়….কিন্তু কে নিয়ে যাবে? ছেলেদের সময় নেই।

বিন্দু চোখে ভালো দেখে না। তবু মনে হল মারিয়াম্মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মন্দিরের ভেতরটা ভালো অন্ধকার। সামনের বিরাট বটগাছটার জন্য আরো অন্ধকার হয়। মন্দিরের ভেতর একটা প্রদীপ জ্বলছে। শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মারিয়াম্মা চুপ করে বসে। বিন্দু কাঁদছে নিঃশব্দে। মাকে মনে পড়ছে। মাও যেন কাঁদছে। মারিয়াম্মার সামনে শুয়ে শুয়ে। মনে মনে।

=======

প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। মারিয়াম্মার পিঠে জলের ছাঁট এসে লাগতে শুরু করল। জানলাটা খোলা। উঠে জানলাটা বন্ধ করবে সে শক্তি নেই বিন্দুর। দমকা হাওয়ায় প্রদীপটা নিভে গেল। গোটা মন্দিরে অন্ধকার আরো গাঢ় হল। বাইরে মেঘের অন্ধকার। বৃষ্টি কার? বৃষ্টি তো মারিয়াম্মার। বিন্দু আঁচলটা বিছিয়ে দিল মন্দিরের চাতালে। বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে। মা, তুমি দেখছ বৃষ্টি? মা দেখছ?

একটা বড় দমকা ছাঁটে মন্দিরের ভিতর অবধি জল চলে এলো। যেন মা ছুঁলো বিন্দুর গাল, মাথা। মায়ের গ্রামেও বৃষ্টি হচ্ছে। মা-ও মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে তার কথা ভাবছে। মারিয়াম্মা মেঘের ছায়া হয়ে, বৃষ্টি হয়ে তার মায়ের মাথার কাছে বসে। বিন্দুর কথা বলছে। বলছে, তোমার মেয়ে, আমি আর তুমি একসঙ্গে ভিজছি দেখো।

মায়ের মারা যাওয়ার খবর পেল বিন্দু এক সপ্তাহ পর। বিন্দু ভেবে দেখল সেদিনই মা মারা গেছে, যেদিন সে মন্দিরে বসে ছিল মারিয়াম্মার সঙ্গে।

বিন্দু মন্দিরে গেল। মারিয়াম্মাকে বাইরে থেকে প্রণাম করবে। মায়ের জন্য প্রার্থনা করবে।

বিন্দু দেখল মন্দিরের সামনে বেশ ভিড়। কী হয়েছে গো?

একজন বলল মন্দিরের দক্ষিণদিকের দেওয়াল ভেঙে গেছে, সেদিনের ঝড়ে। মারিয়াম্মার ডান হাতটা ভেঙে গেছে। মিস্ত্রী এসেছে। আর কারিগর।

বিন্দু চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ঠিক হয়ে যাবে। মারিয়াম্মার কিছু হবে না। তোমরা ভেবো না।

বিন্দু বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। মায়ের জন্য বাড়িতেই প্রদীপ জ্বালবে। আর মারিয়াম্মার জন্য।