"তোমার কাছে পৌঁছাবার কোনো সিঁড়ি দিতে পারো নামিয়ে?"
তারার দিকে তাকিয়ে গাছটা বলল। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস গেল মিলিয়ে। গাছটা বলল, "তুমি ওই দুর্গটার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমার সবক'টা শিকড় ওর ভিতের বুকের ভিতর গেছে। আত্মীয়তা হয়েছে মাটির গন্ধে আমার শিকড়ের সাথে ওই দুর্গের ভিতের। ওরা কথা বলে। না, ভুল বললাম, শিকড় কথা শোনে, ভিত বলে। কি রক্তাক্ত সে কথা, কি যন্ত্রণার তুমি যদি শুনতে আকাশ, শুনতে পেতে তারা!"
একটা পেঁচা এসে বসল গাছটার ডালে। চাঁদ উঠল। বাতাসের বেগ মন্থর। গাছ বলে চলল,
"ভিতের বুকটা রক্তাক্ত হয়ে আছে। আগাছায় ঢাকা সারা শরীরে যুগান্তের অভিমান। ওর খুব গর্ব ছিল জানো। সে যে দুর্গের ভিত, সে দুর্গ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনের দুরূহ সময়ের সাক্ষী। তাদের ত্যাগস্বীকার, কষ্টস্বীকার, মুখ বুজে অত্যাচার সয়ে যাওয়া – এসবের সাক্ষী সে! সে নিজেও যেন এই সংগ্রামের এক যোদ্ধা। তার দেওয়ালের প্রতিটা পাথর ভারতের বীর সন্তানদের সাথে ডুকরে ডুকরে কাঁদত যন্ত্রণায়, ফেটে পড়তে চাইত আক্রোশে। কি অত্যাচার! কি অমানবিকতা! কিসের জন্য সহ্য করেছিল তারা?
ওই যে জানলাটার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া এক টুকরো আকাশ, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই আকাশ, তোমার দিকেই তাকিয়ে ওরা দিন কাটাত। ওরা জানত, বিশ্বাস করত, স্বাধীনতার চিঠি নিয়ে তুমিই আসবে একদিন ওদের কারাগারের সামনে। ওরা বাবা মা বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন... এমনকি নিজের প্রেমকে পর্যন্ত মাড়িয়ে এসেছে নিষ্ঠুর পায়ে আকাশ, শুধুমাত্র নিজের জন্মভূমিকে স্বাধীনতা দেবে বলে।
এ অন্ধ, বদ্ধ, ছোট ছোট কুঠুরিতে পশুর পালের মত গাদাগাদি হয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়েনি আকাশ, নিজেদের প্রেয়সীর মুখ ওদের! দেয়নি মোচড় বুকের ভিতরটায়? অসহায় বাবা মা ভাইবোনগুলোর মুখ আসেনি চোখের সামনে ভেসে? এসেছে, এসেছে, এসেছে। ওগো আকাশ, ওগো ধ্রুবতারা এসেছে, আমি জানি! ও দুর্গের প্রতিটা পাথর বলেছে সে কথা! প্রতিটা পাথরের গায়ে খোদাই করা রক্তাক্ত যন্ত্রণার গাথা ওদের।
ওরা তবু চুপ করে থেকেছে। আকাশ, তুমি যখন এই আজকের মত সেদিনও পূর্ণচন্দ্র নিয়ে সারাটা শরীর তোমার প্লাবিত করেছ শ্বেতচন্দনের বরণে, ওরা ধৈর্য মেনেছে। অপেক্ষা করেছে সেই শ্বেতশুভ্র স্বাধীনতার, যাকে ওরা বসিয়েছে মৃত্যুভয়েরও আগে।"
গাছ থামল। চারদিকে দমবন্ধ করা বাতাস গুমরে গুমরে উঠছে। তারার চোখ স্থিরদৃষ্টে গাছের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে। আকাশের চোখ উঠল ভারী হয়ে কালো মেঘে, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে।
আকাশ বলল, "জানো গাছ, জানো তারা, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দিন কাটাতে কাটাতে কত প্রাণ আমার বুকে এসেছে মিলিয়ে। শরীর নিথর হয়ে চেপে বসেছে ওই দুর্গের ভিতের বুকে।"
"তবে আজ এদিন কেন এল? কেন এত অন্ধকার আজও, যা ওই বন্দীশালার কুঠুরির চেয়েও ঘন?", একটা ছোট ঘাস বলল আকাশ তারা গাছের দিকে তাকিয়ে। অভিমানে দ্বিগুণ হয়ে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল তার ক্ষুদ্র বুকের পাটা।
সবাই চুপ। সবাই আত্মমগ্ন। কেন হল? শ্বেতশুভ্র স্বাধীনতা কি এল? না তো। এত ছলনা, এত হাহাকার, এত হিংসা কেন, স্বরাজ যদি হবে? একি সত্যিই স্বরাজ?
হঠাৎ একটা শব্দে সবার চমক ভাঙল। মাঠের প্রান্তে এক বুদ্ধস্তূপ। সেখানে প্রদীপ জ্বালতে এসেছেন এক দরিদ্রা রমণী - মা। পিছনে পিছনে তার দুই শিশুসন্তান। আকাশ তারা গাছ ঘাস চেয়ে রইল সে দিকে।
তিনি প্রদীপ জ্বাললেন। নতজানু হয়ে বসলেন বুদ্ধের চরণে। দু'পাশে বসল তার দুই সন্তান। তিনি প্রার্থনা উচ্চারণ করলেন, সর্বে ভবন্তু সুখীন... সর্বে সন্তু নিরাময়... সকলে সুখী হোক... নিরাময় হোক... সকলে যা মঙ্গল তাই অবলোকন করুক.... কারোর ভাগ্যে দুঃখ না আসুক...
পূবাকাশ হল লাল।
(বক্সা ফোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো মনে এসেছিল। বলা হয় বক্সাফোর্টের স্থান আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই, বিভীষিকা আর দুর্গমতায়। Debasish এর তোলা ছবিটায় দুর্গ তথা কারাগারটার অংশ দেখা যাচ্ছে। দেবাশিষকে ধন্যবাদ ছবিটা তুলে দেওয়ার জন্য)