তারের উপর বসে আছে একটা নীলকন্ঠ পাখি। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে বসে শীলা। ভেলোর থেকে ফিরছে। ডাক্তারের জবাব নিয়ে।
খামতি যা থেকে গেল সে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা নেই। যা পাওয়া গেল সে নিয়েও গর্ব করতে সাধ নেই। এখন ফিরলেই হয়। ক্লান্তি।
স্বামী। উপরের বার্থে শুয়ে। ট্রেনের ছাদ ভীষণ বৈচিত্রহীন। ছাদে কেউ রং করে? অনেকে করে। সুখের অনেক রং। প্রয়োজনের নেই। পাখা ঘুরছে। ঘাম হচ্ছে তবু। জুন মাস। স্লিপার ক্লাস।
মন শান্ত। বড় একটা ঝড় আসছে জেনেও শান্ত। ঝড় এলে মানুষ আশ্রয় নেয়। সুন্দরবনের ওদিকে গিয়ে দেখেছে। কিন্তু প্রশান্ত বসুর আশ্রয় নেই। উড়িয়ে নিয়ে যেখানে ফেলবে ফেলুক। কোনো অভিযোগ নেই জীবন নিয়ে। অভিযোগ যে করা যায় সেটাই বুঝতে পারেনি আজীবন। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা। শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়াবার মাটি পেতে পেতেই সূর্য মধ্যগগনে।
একটানা পাখার আওয়াজ। মেয়ে বলেছিল এসি থ্রিটায়ারের কথা। সামর্থ্যে কুলায়নি। জীবন গর্ব করার মত কিছু দেয়নি। চায়ওনি। অল্প অল্প করে ভাতের দলা গিলেছে। সময়ের আগে পাত খালি হয়ে যেন না যায় এই ভয়ে। লজ্জায়।
মেয়ে। বিয়ে হয়েছে আট-ন’বছর। বাচ্চা নেই। প্রতুল চেষ্টা করেছে অনেক। মণিদীপাও। হয়নি। হবেও না। মোবাইলে সিনেমা দেখছে মিডল বার্থে। কানে হেডফোন। চোখদুটো লাল। মাঝে মাঝেই কেঁদেছে। রিপোর্ট ভুলও হতে পারে, প্রতুল বলেছে। কলকাতায় আবার সব টেস্ট করাবে। একটা মসৃণ জীবন চেয়েছিল। না হয় থাকত অল্প ছোটো কিছু গর্ত। ঝাঁকুনি লাগত। থমকে যেত না। মা।
নীলকণ্ঠ পাখিটা উড়ে যায়নি এখনও। ট্রেনটাও দাঁড়িয়ে। এই যে বাড়তি সময়টুকু পাওয়া, এও সুখ। যে সুখকে ধুয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহারযোগ্য করতে হয় না। এ সুখ বারান্দায় ফেলে যাওয়া উদাসী পায়রার পালক, যে ঘরে থেকেও রয়ে গেল বাইরের।
টয়লেটে যেতে হবে। তলপেটে চাপ। কিন্তু এই ছবি, আর তো ফিরবে না। এই পথ, এই মুহূর্ত আর তো আসবে না। আর তো কোনোদিন আসা হবে না এই রাস্তায়। পাখিটা এখনও বসে। কিন্তু তলপেটে বাড়ছে চাপ। আর না.. মণি…
মণি বাইরে দাঁড়িয়ে। ট্রেন থেমে। কমোডের ধাতব গা, নোংরা, ঠাণ্ডা। মন বৈরাগ্য আন। মন নীলকন্ঠ পাখি হ। সামনে হেলানো ঘষা কাঁচ। নগ্ন শরীরের লজ্জা ঢাকা কাঁচ। মানুষের লজ্জা অনেক। চোখে, কানে লজ্জা ঢোকে। তাড়া করে বেড়ায় মাথা। মানুষ ঢাকে। আড়াল করে। শরীর, কথা, সুখ, ইচ্ছা।
ট্রেনটা নড়ল। শীলার চোখে জল এলো। নীলকণ্ঠ পাখিটার জন্য। স্বামীর জন্য না, মেয়ের জন্য না, রান্নাঘর, শোয়ার ঘর, আলনা, আলমারি, পাখা, ড্রেসিংটেবিল, ডাইনিংটেবিল, ছাদ, ঠাকুরঘর… কিছুর জন্য না। কান্না পেল নীলকণ্ঠ পাখিটার জন্য। মন কেমন করে উঠল। তারের উপর বসে সেও কি একবার তাকে দেখতে চেয়েছিল? শেষবারের মত?
শীলার চোখ বেয়ে নামছে উষ্ণ জল। তলপেট ফাঁকা। উঠতে হবে এবার। ট্রেনের দুলুনি বাড়ছে। ছায়ার পর ছায়া এসে সরে সরে যাচ্ছে চেন্নাই মেলের, এস ফাইভের টয়েলেটের দেওয়ালে। একটা ছায়াও স্পষ্ট নয়, স্থির নয়। জীবনের মত। কতবার ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে, আজন্ম দেখা নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছে সে, কে আমি? তার মা, দিদা, তার মা… হয় তো গুহাবাসী তার কোনো প্রাচীন আত্মীয়ও প্রশ্ন করেছে, কে আমি? আকাশ উত্তর দেয়নি সেদিনও। জীবন নীলকন্ঠ পাখির মত অল্পক্ষণ বসে উড়ে গেছে আবার নীলাকাশে। গেছে মিলিয়ে। উত্তর না পেয়ে। তবু ক্ষোভহীন।
মা হল? ঠিক আছ?
মণির গলা।
আছি রে… আসছি..
কাপড় পরতে পারবে, না আমি আসব?
আসবে? থাক। আর কিছুদিন শরীরের একান্ত গোপনীয় লজ্জাটুকু নিজেরই থাক। এইটুকুই তো আপন। নিজের। আর কদিন পর তো সবটুকু ভেসে যাবে। ততক্ষণ থাকুক নীলকন্ঠ বসে ডালে। দোল খাক, পুবাকাশে কালো কালবৈশাখির মেঘ জমেছে দেখেও।