Skip to main content
বড়দিন


ছেলেটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল সকালবেলা। গ্রামের নাম বিলালপুর। শীত পড়েছে বেশ। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি।
আচমকা ঘুড়িটা সোঁ সোঁ করে আকাশে উঠতে লাগল। ছেলেটা প্রথমটা ঘাবড়ে গেল। ভাবল ঝড় শুরু হল? না তো, আশেপাশে গাছগুলোর মাথা তো দুলছে না। সে যখন খুব ছোট তখন একবার ঝড়ে তাদের বাড়ির টিনের ছাদ উড়ে গিয়েছিল। খুব ভয় পেয়েছিল। সে কি কান্না তার! মনে হচ্ছিল তার বাবা মা সক্কলকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু এখন তো সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। এখন ভয় পেলে চলে? 
আরে একি! একি! তার হাতের লাটাইয়ে তো আর সুতো নেই! লাটাইয়ে টান পড়ছে দূরে অদৃশ্য উড়ন্ত ঘুড়ির।
যা! ছিঁড়েই গেল সূতো। ঘুড়িটা হারিয়েই গেল।
খুব মন খারাপ তার। ভীষণ মন খারাপ। সারাদিন একে তাকে বলল। কেউ বিশ্বাস করল না। বলল, ভাগ! ঘুড়ি কেটে নিয়েছে কে, তাই ওসব মিথ্যা গল্প বানানো, যত্তসব!
সে দিনে ভাল করে খেলো না, রাতেও না। শুতে গেল। এখন সে একাই শুতে যায়। আগে বাবা-মা'র সাথে শুত।
হঠাৎ শুনল জানলায় টোকা। এত ঠাণ্ডায় কে ডাকছে? সকাল হয়ে গেল নাকি এত তাড়াতাড়ি? বিশু তো কলকাতায় গেছে মামাবাড়ি। ও-ই তো ডাকে ভোরে এসে, এই ফড়িং, এই ফড়িং... ওঠ মাঠে যাব...
ফড়িং এসব ভাবতে ভাবতে আলো জ্বালল, জানলাটার কাছে এগিয়ে গেল। জানলাটা খুলবে কি খুলবে না ভাবছে। যদি ভক্ করে একটা ভুত দেখে ফেলে! বলা তো যায় না। ভুতের তো আর শীতের হ্যাপা নেই।
আবার টোকা। ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চান্ন। একটু ভেবে খুলেই দিল জানলা। ভুস্ করে খানিক কুয়াশা ঢুকে গেল। তার সাথে হাড়-কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা। ফড়িং 'উফ্' করে উঠে, গায়ের চাদরটা জড়িয়ে ভাল করে বাইরে চেয়ে দেখল। না তো! কেউ তো কোত্থাও নাই! কি হল তবে? কি জানি বাবা, কে এসেছিল। ফড়িং তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে লেপটায় মাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। চোখটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় কে ডাকল - এই ফড়িং!
- কে?!! চমকে লেপের মুড়ি সরিয়ে, তাকিয়ে তো সে তাজ্জব!
আরে সারা ঘরে কি সুন্দর আলো! সোনালী রঙের, আবার নীলের আভা। মাঝখানে কুয়াশার মধ্যে ওটা কি? আরে তার ঘুড়িটা যে! 
- হ্যাঁ আমিই, ঘুড়িটা বলে উঠল। গলাটা বেশ ভারী, কিন্তু কিরকম ভাল। তার ভয় করল না। অনেকটা স্কুলের বাংলা স্যারের মত গলার আওয়াজ। সে বলল,
- তুমি কথা বলতে শিখলে কি করে? 
- সে পরে বলব। 
- তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? 
- একজন রাজার কাছে।
- রাজা? ধুর বোকা! এটা কি ইতিহাস বইয়ের সময় নাকি! রাজা কোত্থেকে আসল?
- আছে। তুমি আজ সকাল থেকে মন খারাপ করছিলে না। তোমার বাবা এবার পঁচিশে ডিসেম্বর কেক আনতে পারবেন না বলেছেন বলে?
- হুঁ করছিলাম তো। বাবার তো মিল বন্ধ সেই পূজো থেকে। এবারের পূজোতে আমার একটা মাত্র গেঞ্জি হয়েছে তাই। মা-বাবা'র তো তাও হয়নি। 
ফড়িং-এর চোখটা একটু জ্বালাজ্বালা করল না? ছিঃ ছিঃ, সে বড় না এখন। জামার জন্য মন খারাপ করে? মা আরো তিনটে বাড়ি বাসন মাজার কাজ নিয়েছে।
ফড়িং বলল, আমার এখন আর মন খারাপ নেই।
তার মনে হল, ঘুড়িটা যেন হাসল। ফড়িং বলল, তুমি সত্যিই রাজার কাছে গিয়েছিলে? সে কোন দেশের রাজা? 
- হ্যাঁ গিয়েছিলাম তো। সে সব দেশের রাজা গো। 
- সে রাজা কি বললে? 
- তুমিই জিজ্ঞাসা করো।
ফড়িং বলল, কি ভাবে, সে রাজার মোবাইল আছে নাকি?
ঘুড়ি আবার যেন হাসল। বলল, পিছনে ফেরো। 
ফড়িং পিছনে ঘুরেই তাজ্জব! আরে এ কে?
সে দেখে তার সামনে কুয়াশা কুয়াশা আলো। মনে হচ্ছে যেন শরীর। মুখটাও যেন চেনা চেনা।
সে বলল, এই তো আমি ফড়িং! কি অপূর্ব গলার আওয়াজ সে কুয়াশা রাজার! 
- আপনি আমার নাম জানেন? ফড়িং বিস্মিত হয়ে বলল। 
- আমায় যে সব জানতে হয় ফড়িং।
- ও..., ফড়িং কি বলবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল বাবা-মাকে ডাকে। তারপর ভাবল, না থাক। তারা ভয় পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সে কি বলবে?
- তোমার কি খুব মন খারাপ ফড়িং?
- হুঁ। আমরা খুব গরীব যে! 
- আমিও খুব গরীব ফড়িং। 
- সে কি তুমি তো রাজা! ফড়িং ভাবলে একি ঠাট্টা!
- না গো। সত্যিই আমি খুব গরীব। আমি রাজাও বটে। 
- কেউ নিয়ে নিয়েছে তোমার সব রত্ন-মানিক্য?
- হুম
- কে?
- অনেকে মিলে। সে থাক। তোমায় বরং আমার সাথে ঘুরিয়ে আনি চলো।
ফড়িং কিছু বলতে যাবে, দেখলে তার আগেই সেই কুয়াশাটা তাকে আলোর বৃত্তের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না চারদিকে। শুধু আলো আর আলো।
তার পাশে রাজা। এত কাছে, তবু স্পষ্ট না। তার মনে হল একবার ছুঁয়ে দেখে। কিন্তু কি একটা সংকোচে ছুঁল না, থাক।
রাজা বললেন, এসো, আগে তোমায় নকল রাজাদের দেখাই।
তারা সারা দেশের বড়বড় বাড়িগুলোর ভিতরে গেল। কেউ তাদের দেখতে পেল না। কত খাবার, কত যন্ত্রপাতি, কত নরম বিছানা, কত দামী দামী জামাকাপড়। সে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেল। একটুও ভাল লাগছে না আর। তার অঙ্কের ক্লাসের মত লাগতে লাগল। সে রাজাকে বলল, রাজা ফিরব।
বাইরে এসে বাঁচল। খুব প্রাণভরে শ্বাস নিল।
রাজা বলল, চলো তোমায় খুব অল্পে বাঁচা মানুষের কাছে নিয়ে যাই।
সে দেখল, অনেকের বাড়িই নেই। কেউ প্ল্যাটফর্মে শুয়ে, কেউ ফুটপাথে, কেউ বাড়ির রকে, কেউ রাস্তার পাইপের মধ্যে। রাজা বললে, দেখো ওই লোকটা শেষ কবে পুরো পেট খেয়েছিল ভুলেই গেছে। আর ওই লোকটার ছেলেটা গতবছর বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। ওর টাকা নেই বলে কেউ ঠিকমতন চিকিৎসা করেনি। ওই বাচ্চাগুলো ময়লা বিক্রী করে পয়সা আনে বাড়িতে। তবে খাওয়া হয়।
ফড়িং-এর কান্না পেল। চোখ ফেটে জল আসল। মনে হল বাড়ি গিয়ে দৌড়ে মুড়ির টিনটা নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে তার বাড়িতেও ভাত থাকে না ঠিকই। কিন্তু মুড়ি তো থাকেই। এত গরীব মানুষ আছে যাদের মুড়িও কেনার পয়সা নেই। তার খুব কান্না পেতে লাগল। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করল।
কুয়াশা রাজা অন্যমনস্কভাবে কি ভাবছিল। ফড়িং বলল, রাজা বাড়ি যাব!
- দাঁড়াও ফড়িং আরো কিছু দেখিয়ে নিই।
তারা কুকুর দেখল, পাখি দেখল, পোকার গর্তে গেল, মাছেদের কাছে গেল। কারোর গায়ে রোগ, কারোর ফুসফুসে রোগ, কারোর হাঁটতে অসুবিধা।
ফড়িং বলল, কে করেছে এদের এরকম? 
রাজা বলল, মানুষ। 
তারা গাছেদের কাছে গেল। নদীর কাছে গেল। আকাশের কাছে গেল।
দেখল কেউ ভাল নেই। সব্বার ভীষণ অসুখ। কারোর জ্বর, কারোর শ্বাসকষ্ট, কারোর গায়ে হামের মত লাল দাগ। 
রাজা বলল এও নাকি মানুষের জন্য।
তারা বাড়ি ফিরে আসল।
ফড়িং বলল, তুমি কি ভগবান? 
রাজা বলল, লোকে তাই বলে। তুমি কি করে জানলে?
- বা রে! সবাই একডাকে চিনল কি করে তোমায়, তুমি যদি রাজাই না হবে যদি?
- হুম। তবে কি জানো। এখন তোমায় অনেক কাজ করতে হবে। তাই তোমার কাছে আসা।
ফড়িং বলল, মন্দির বানাবো? 
রাজা বলল, উঁহু
- মসজিদ?
- উঁহু
- চার্চ?
- না না
- তবে?
- একটা নদী বানাতে হবে।
- ঠাট্টা হচ্ছে? ফড়িং-এর রাজার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে। লোকটা আর যা হোক, খুব নিরীহই মনে হচ্ছে ফড়িং-এর। কেন যে লোকে একে এত ভয় পায়!
- না ফড়িং ঠাট্টা না। একটা বড় নদী বানাতে হবে। 
- এই গ্রামে? 
- সব গ্রামে। তবে বাইরে না। ভিতরে। 
- বুঝেছি। তুমি ধাঁদা ধরছ তো? আমি কিন্তু ধাঁদা ভাল পারি না। আগেই বলে রাখলাম।
রাজা গম্ভীর হয়ে বললে, না ফড়িং ধাঁদা না। রাজার কোথায় যেন একটা কিসের কষ্ট।
- তবে?
- আচ্ছা বলোতো, এই ঘরটায় যদি দরজা না থাকত, জানলা না থাকত তুমি থাকতে পারতে?
- উঁহু। দম আটকে মরতুম তো। স্যার বলেছেন, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, আর তাতেই আমরা বাঁচি।
- যদি রাস্তা না থাকত?
- স্কুলে যেতাম কি করে? মেলায় যেতাম কি করে? মা কাজে যেত কি করে? বিশু ভোরবেলায় ডাকতে আসত কি করে? 
- হুম। যদি কথা না বলতে পারতে? 
- ভুনু নন্দীর মত? সে জন্ম থেকেই কথা বলতে পারেনা। আচ্ছা তুমি তাকে ঠিক করে দিতে পারো না? সে এখন কত্তোবড়ো। চুলও পেকে গেছে কপালের কাছে ক'টা। 
- হুম সে হবে'খন। তা হলে কথা বলো; রাস্তা, জানলা, দরজা সব দরকার বলো।
- হুম। খুব খুব খুব। 
- এটাই কিছু মানুষ ভুলে গেছে। তারা শুধু দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। জানলায় পেরেক ঠুকে দিচ্ছে।
- কারা তারা? ভারী বদলোক তো? 
- হুম।
- তুমি কিছু করতে পারো না? মা যে বলে তুমি সর্বশক্তিমান!
- পারি তো। কিন্তু আমার শক্তি তো সব ভালো মানুষদের নিয়ে।
- তারা কই?
- ঘুমাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে।
- কেন?
- নদী নেই বলে।
- সেই নদীটা? যেটা আমায় বানাতে বললে? 
- হ্যাঁ। সেই নদীটা। সেটার উৎস তোমার মধ্যে, সবার মধ্যে আছে। একটা পাথর চাপা আছে। তাই তার জল বেরোতে পারছে না। 
- কে দিল পাথর?
- ওটা এমনিই জমে যায়, নদীটাকে অবহেলা করলেই। আসলে নদীটা খুব অভিমানী যে!
- ও। আমি পারব ওই নদীটাকে আবার জাগাতে।
রাজার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, তোমরাই তো পারবে। তাই তো আমার আশা। 
- সে নদীটার নাম কি?
- ভালোবাসা

এই ফড়িং ওঠ ওঠ....
ফড়িং ধড়মড় করে উঠে দেখে জানলা খোলা। ঘুড়িটা জানলার সাথে আটকে। তার মা বিছানা তুলতে তুলতে বলে, তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুয়ে ছোট, গ্রামে হইচই পড়ে গিয়েছে। ভুনুকাকু তোর কথা বলতে শুরু করেছে আজ সকাল থেকেই! সব্বাই তার বাড়ি যাচ্ছে। সে ছড়া বলছে, গান গাইছে, নাচছে, কাঁদছে..... যা যা তাড়াতাড়ি যা। আজকে পঁচিশে ডিসেম্বর না, সে সব বাচ্চাদের কেক খাওয়াবে বলেছে। অ্যাত্তো কেক এনেছে। 

ফড়িং-এর কি হল। সে ছুট্টে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। তার মা হতবাক।
সে কাঁদছে আর বলছে, মা আমাদের নদী বানাতে হবে মা, নদী বানাতেই হবে.....

(ছবিঃ সুমন)