Skip to main content
বন্ধুতা



----

     “চিনি না তো... কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?” ধীরে ধীরে বিছানা তুলতে তুলতে পাপিয়া তার বড় ছেলে তুহিনকে জিজ্ঞাসা করল। তুহিন ইলেভেনে পড়ে।
     সকাল আটটা। একটা ছেলে তুহিনকে খুঁজতে এসেছিল। ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। তুহিন লেট রাইজার। ঘুম চোখে, চশমা পরে, খালি গায়ে একটা হাফ প্যান্ট পরে বসার ঘরে ঢোকে।
     ঢুকেই বলে, “ও তুই নিলু… এত সকালে?”
     “আরে স্যার অঙ্ক খাতাটা চেয়ে পাঠালেন।”
     “কোন স্যার?”
     “সকালবেলায় মাল টেনে আছিস নাকি? কোন স্যার আবার, অঙ্কের বিকাশদা...”
     “ও আচ্ছা। কেন?”
     “ওই পীযুষদের ব্যাচে ওই আগের সপ্তাহের অঙ্কগুলো কিছু টুকতে দেবেন তাই... ফেয়ার খাতাটা তোর কাছে তো?”
     “ও আচ্ছা, বোস আনছি... চা খাবি?”
     “না রে তুই তাড়াতাড়ি দে... বেরোই... আবার প্রোজেক্ট লিখতে হবে...”
     “আচ্ছা দাঁড়া...”
     তুহিন নিলুকে ছেড়ে ভিতরে আসতেই প্রশ্নটা করে পাপিয়া।
     “সক্কাল সক্কাল ক্যাঁচাল কোরো না তো! কে এসেছিল... কেন এসেছিল... আচ্ছা আমি বড় হচ্ছি তো... আমার একটা পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু থাকতে হয় তো নাকি...?”
     পাপিয়ার মাথা গরম হয়ে আসছিল... নিজেকে সামলে নিয়ে হনহন করে রান্নাঘরের দিকে এগোল... সক্কাল সক্কাল মাথা গরম করে লাভ নেই... তাছাড়া তমালের আজ মিটিং কি একটা নিয়ে, অনেক রাত অবধি কাজ করেছে... এগারোটায় বেরোবে... এখন চীৎকার চেঁচামেচি শুরু হলে মাঝখান থেকে ওর ঘুমটা নষ্ট হবে।
     তমাল মার্কেটিং জোনাল হেড একটা বিদেশী ওষুধ কম্প্যানীর। বিশাল চাপ। গড়িয়ার এই ফ্ল্যাটটাতে ওরা এসেছে বছর চার হল। তমালের প্রোমোশনের পরপরই। তুহিন এখানকার একটা নাম করা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ ভালোই।
     নিলুর বাবার একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান মোড়ের মাথায়। তাদের পাড়াতেই। নিলুও ক্লাস ইলেভেনে সায়েন্সে পড়ে। একটা সরকারী স্কুলে। অঙ্কটা দুজনেই এক জায়গায় করে। কারণ বিকাশদার মত অঙ্কের টিচার এখানে কেউ নেই। নিলুর বাড়িতে ওর বাবা, মা আর একটা বোন নীলাঞ্জনা, ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় খুবই ভালো। নিলুর ভালো নাম নীলাংশু।



-----
     নীলুর কোথায় যেন একটা খটকা লাগে তুহিনদের বাড়ি গেলেই। নিজেকে খুব ছোট লাগে। আগে লাগত না। ইদানীং লাগে। খাতাটা সে আনতে আসতে চায়নি এই জন্যেই, সারাটাদিন আজ মনটা এরকম বিগড়িয়ে থাকবে।
     চুপ করে ব্যাচে এসে বসল। পড়ায় মন বসছে না। অঙ্কুশ, অরুণাভ, ইন্দ্রনীল, প্রসুন, পীযুষ… সবার জামা প্যাণ্টের দিকে তাকালো। ওদের ব্যাগগুলোর দিকে তাকালো। একটা কাঁটার মত বিঁধছে বুকের মাঝখানটায়। তার এইটা নিয়ে আর একটাই জিন্সের প্যান্ট। তাও কোমরটা ছোট হয়। নীচে বসতে যথেষ্ট কষ্ট হয়। রোগা বলে কোনোরকমে ম্যানেজ করে নেয়। বুচুরও (নীলাঞ্জনা) কিরকম লাগতে থাকবে… নাঃ আর ভাবব না… ভাবল বটে তবু মনটা খারাপ হতে লাগল।
     বিকাশ স্যার তার দিকে পিছন করে মৌসুমীকে কি একটা বোঝাচ্ছে। নীলু আড়চোখে রিদিমার দিকে একবার তাকালো। কি অদ্ভুত দেখতে মেয়েটাকে। সব মেয়েগুলোর থেকে আলাদা। রিদিমার মুখের দিকে তাকালেই নীলুর বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ওর সাথে কথা বলতে গেলেও তার বুকটা ধড়াস ধড়াস করে। সে খুব চেপে রাখে ব্যাপারটা। কারোর সাথে আলোচনা করে না। একমাত্র ওম জানে। ওম একটু অন্যরকম। একটু মেয়েদের মত। ও বলে ও নাকি ‘গে’, ও বুঝতে পেরেছে। ওর ছেলেদের নাকি বেশি ভালো লাগে।
     নীলু ওমের মুখের দিকে তাকাতেই ওম মুখটিপে হেসে খাতায় মন দিল। নীলু বুঝেছে ওম দেখতে পেয়েছে তার তাকানোটা রিদিমার দিকে।
     আজ স্কুল নেই। সাইকেল নিয়ে ওরা যখন বেরোলো পড়ার ব্যাচ থেকে তখন সাড়ে ন’টা। ইন্দ্রনীল বলল, “চল একটু ঘুরে বাড়ি যাই… তুহিনের বাড়ি যাবি? গেম খেলবি?” সব্বাই একসুরে ‘হো হো’ করে বেরিয়ে পড়ল। নীলু আর ওম গেল না। ওদের কেউ বললও না অবশ্য। জানে নীলু কম্পিউটারে গেম খেলতে পারে না। আর নীলু যেখানে নেই ওম সেখানে যায় না। ছেলেরা ওদের ‘হ্যাপি কাপল’ বলে। আগে আগে ওম রেগে যেত, এখন রাগে না। আর নীলুর ওসব কোনোদিনই গায়ে মাখার অভ্যেস নেই।
     নীলু আর ওম পাশপাশি সাইকেল নিয়ে হাঁটতে লাগল। কাছেই একটা পার্ক মতন আছে। নীলু বলল, “চল গিয়ে বসি।” সামনে পূজো। পার্কের একটা কোণায় প্যাণ্ডেল বাঁধা হচ্ছে। ওরা গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায়।
     ওম কথা শুরু করল, “তুই রিদিমাকে বলিস না কেন? একবার বলে তো দেখ। তারপর না করবে তো না করবে। তুই জানিস তো পীযূষটা ওদিকে লাইন মারার জন্য মুখিয়ে আছে ওর পিছনে। রিদিমা ওকে খুব একটা পছন্দ করে না জানিস তো। ও ড্রিংকস করে বলে।”
     নীলু চুপ করে সামনের গাছে একটা কাঠবেড়ালির ওঠা-নামা দেখছিল, কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বলল, “হুম।” তারপর কিছুটা ভেবে বলল, “ছাড়। ওর বাবার মুদির দোকান থেকেই আমাদের যা কিছু আসে, এমনকি বাকিতেও আসে। সব জানাজনি হোক আর আমার জন্য বাড়ির লোকের হয়রানি হোক… না রে ছাড়… একটা ভালো rank যদি ইঞ্জিনীয়ারীং এ করতে পারি, একবার যদি একটা সরকারী কলেজে চান্স পাই… ব্যস… তারপর দেখব…”, বলতে বলতে নীলু সামনের ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকালো… মনে মনে ও নিজেকে ওখানে কোথাও একটা দেখতে চায়… বাড়ির সবাইকেই...
     ওম বলল, “আমার কি হয় কে জানে। অঙ্ক নিয়ে পড়ার ইচ্ছা। এদিকে পিসী বলছে মেডিক্যাল দিতে। আমার একটুও ইচ্ছা নেই জানিস তো। বায়োলজী আমার কিচ্ছু মুখস্থ হয় না।” (ওমের মা বাবা নেই। পিসীর কাছে মানুষ। পিসী একটা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এখানকার। অবিবাহিতা।)
     এটা ওটা কথা বলার পর নীলু বলল, “চল ওঠা যাক। খিদে পেয়েছে। ওরা উঠে বেরোতে যাবে, বাইরে রাস্তায় রিদিমার সাথে মুখোমুখি। সাথে পীযুষ।”



-----
     তুহিনের মাথাটা গরম হয়ে গেছে। মায়ের সাথে কথা বললেই এরকম হয় আজকাল। চুপ করে কিছুক্ষণ খাটে শুয়ে থাকল। মোবাইলের নেটটা অন্‌ করল। ওয়াটস অ্যাপে গুচ্ছের মেসেজ ঢুকলো। তাদের স্কুলের গ্রুপটার হবে। সক্কাল সক্কাল ভালো লাগছে না। যত্তসব হাবিজাবি ছবি আর জোক্‌স ভর্তি থাকে। ভালো লাগে না সব সময়। ফোন লক্‌ করে রাখতে হয়। তাতেও মায়ের সন্দেহ। মায়ের বেশি সন্দেহ বর্ষাকে নিয়ে। তাদের স্কুলেই পড়ে। তুহিনকে পছন্দ করে। তুহিন জানে। তবু তুহিন নিজের ফিলিংসটা বোঝাতে পারে না।
     বর্ষার মেসেজ ঢুকল। ওই গুড মর্নিং মেসেজ। তুহিন বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুল। আজ স্কুল নেই। হঠাৎ পিঠে একটা হাত লাগাতে চমকে উঠল, “ও বাবা, বলো…”
     “কি রে শরীর ভালো নেই? এরকম পড়ে আছিস যে। স্কুল নেই তো আজ?”
     “না না এমনি।”
     “মাকে চটিয়েছিস কেন?” তমাল হেসে একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলল।
     তুহিন হেসে বলল, “তোমার বউকে চটাতে হয় না, চটেই থাকে। কি দেখে যে তোমার প্রেম হয়েছিল বুঝি না।”
     তমাল ‘হো হো’ করে হেসে উঠল, চীৎকার করে বলল, “ওগো শুনে যাও… তোমার ছেলের কথা…”
     পাপিয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসল। কাপটা তমালের হাতে দিতে দিতে বলল, “কি বলছেন শুনি?”
     তমাল হাসতে হাসতে বলল, “কি দেখে যে এমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়লাম আমি ও নাকি বুঝতেই পারছে না।”
     পাপিয়া খুব শক্ত হয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করে বলল, “নিজে একটা প্রেম করে দেখাক না, আমার থেকে ভালো কারোর সাথে… তা না… ওই ধিঙ্গি বর্ষার প্রেমে উনি হাবুডুবু খাচ্ছেন। কি সব পোশাক পরে মেয়েটা… ওর বাবা-মা কি করে অ্যালাও করে বাবা বুঝি না... আর ওই তো ঘাটের মড়ার মত চেহার… আরে আমিও তো টালিগঞ্জের মেয়ে নাকি... তোর বাবাও তো… জিজ্ঞাসা কর আমি ওরকম পোশাক পরতাম কি না… একটা শালীনতা ছিল আমাদের…”
     তুহিন ওর বাবার কোলে মাথা দিয়ে বলল, “শুরু হয়ে গেল পার্লামেন্ট অধিবেশন…”
     তমাল আবার ‘হো হো’ হেসে উঠতে যাবে… কিন্তু পাপিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেল না। তুহিনকে চোখ টিপে উঠে গেল…, “আমি স্নানে গেলাম... তোমার রান্না কদ্দুর… আজ আমি গাড়ি নিয়ে যাব না… অফিস থেকে গাড়ি আসবে বুঝলে… সাহেব আসতে পারে… যদি ঘরে ঢোকে তুমি তবে চা’টা সেধো একটু…”
     খানিক পরেই… হইহই করতে করতে… “এই তুহিন তুহিন…” বলতে বলতে ছেলেদের দল এসে পড়ল… পাপিয়া দরজা খুলতে খুলতে বলল… হ্যাঁ রে তোদের কি ঘরের চালে মাথা টেকে না রে… যা অঙ্ক নিয়ে বোস… আমি আসছি… একদম কম্পিউটার অন করবি না...
     ইন্দ্রনীল এদের মধ্যে সব চাইতে ফাজিল, সে সটান মেঝেতে শুয়ে বলল, “এরকম কোরো না আন্টি… জাস্ট মারা যাব… ক’টা শিশুর ওপর এমন অত্যাচার কোরো না…”
পাপিয়া হেসে ভিতরের ঘরে গেল। ছেলেগুলো তুহিনের খাটে লাফিয়ে ওকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।

 


-----
     নীলাঞ্জনাদের (নীলুর বোন) ব্যাচটা পড়িয়ে অশ্রু বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বিকাশ এ বছর মাষ্টার্স কমপ্লিট করল অঙ্কে। অশ্রু ফিলোজফিতে। দু’জনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের। দু’জনের বাবা-ই রেলে ছিলেন। দু’জনেই রিটায়ার করেছেন। বিকাশের মা গতবছর এই ঠিক পূজোর আগে আগেই ডেঙ্গিতে মারা গেছেন। বিকাশ ওদের এক ছেলে। অশ্রুও এক মেয়ে। বিকাশ একটা চাকরীর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কারণ অশ্রুর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসছে।
অশ্রু একটা বাসস্ট্যান্ডে বসেছিল। বিকাশ আসছে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। বিকাশ একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করল, “খেয়েছ কিছু?”
     অশ্রু মাথা নাড়ল। আজ ওদের একসাথে কলেজ স্ট্রিটে যাওয়ার কথা।
     বিকাশ ঘড়ি দেখে বলল, “এখন বেরোবে, না দুপুরে স্নান খাওয়া করে বেরোবে?”
     অশ্রু নিজেও ঘড়ি দেখে বলল, “তোমার আজ আর ব্যাচ আছে?”
     বিকাশ বলল, “আছে, ওই তুহিনদের বাড়ি। ইংলিশ মিডিয়ামের ব্যাচটা। সে ম্যানেজ হয়ে যাবে। বেরোবে এখন? স্নান হয়ে গেছে?”
     অশ্রু মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলল। বিকাশ বুঝল অশ্রু মনস্থির করেই বেরিয়েছে। বলল, “দাঁড়াও একবার তুহিনের মা'কে জানিয়ে দিই।”
     ফোন করে এসে বলল, “চলো। মেট্রোতে যাবে? মহাত্মা গান্ধী রোডে নেমে যাব… নাকি ট্রেনে শিয়ালদায় যাবে?”
     অশ্রু বলল, “যা বলবে।”
     “তা হলে মেট্রোতেই চলো।”
     হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিকাশ বলল, “এ কি! এ দুটো বাড়ি যায়নি এখনো?”
     অশ্রু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “কারা?”
     বিকাশ পার্কের দিকে আঙুল তুলে দেখালো… অশ্রু চিনতে পেরে বলল, “ছাড়ো না, আজ স্কুল নেই যখন… হ্যাঁ গো… ওমের সাথে কি নীলুর কিছু…”
     “আরে না না… আমিও তাই ভাবতাম আগে… নীলুর পচাদার মেয়ের ওপর ক্র্যাশ।”
     “মানে রিদিমা?!” খুব বিষ্ময়ের সাথে কথাটা বলল অশ্রু। বিকাশ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন কি হল? এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই…”
     অশ্রু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলল, “আরে না… ভাবো কত ছোট থেকে ওদের দেখেছি… ওরা কি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছে না…”
     বিকাশ অশ্রুর মুখের দিকে তাকালো। খুব সুশ্রী অশ্রু না অবশ্যই। গায়ের রঙ ফর্সা। মুখে বসন্তের দাগ। পাতলা ঠোঁট। সরু মুখের গড়ন। খুব সাধারণই। অশ্রুকে যদি ও কোথাও পায় আলাদা করে সেটা ওর গলার আওয়াজ আর চোখের মণিদুটোতে। এই দু’টোই তার মরুদ্যান। খুব ভালোবাসে মেয়েটাকে সে… খুব… দুই বাড়ি থেকেই জানে অবশ্য। তবু ওর মায়ের যত গোলমেলে বুদ্ধি। কি যে সুখ মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে সে বুঝতে পারে না।
     বিকাশ আলতো করে অশ্রুর ডান হাতের একটা আঙুল নিজের বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। মনে মনে ভাবতে থাকে কোন আঙুলটা ছুঁলো… মধ্যমা… অনামিকা...
     আবার ছোঁয়… এবার কোন আঙুলটা ছুঁলো...
     অশ্রুর খুব মজা লাগে এই খেলাটা বিকাশের। ও যতক্ষণ না ওর কড়ে আঙুলটা ছোঁবে ও থামবে না। সে ইচ্ছা করে কড়ে আঙুলটাকে গুটিয়ে রাখে।
     বিকাশও বুঝতে পারে… ওর জেদ চেপে যায়… কতদিন চুমু খায়নি সে মেয়েটাকে… ভাবতেই তার মনে হয়… নিশ্চই খিদে পেয়ে গেছে ওর… তাড়াতাড়ি একটা পাশের হোটেলে ঢুকে পড়ে... বলে, “আগে ডিমটোস্ট খেয়ে নেওয়া যাক… না হলে আবার তোমার গ্যাসের ব্যাথাটা বাড়বে…”
অশ্রুর মনটা খারাপ হয়ে যায়… যাঃ! কড়ে আঙুলটা ছুঁলো না যে!

 

 


------
     আচমকা রাস্তায় রিদিমাকে এভাবে দেখবে ভাবেনি নীলু। তার ওপর সাথে পীযুষ। পীযুষেরা তুহিনের মত বড়লোক না হলেও ভালোই অবস্থা। পীযুষের বাবা রাজ্য সরকারের বড়বাবু। ওরা দু’ভাই। ছোটভাইটা জন্ম থেকেই ইনভ্যালিড। পীযুষ পড়াশোনায় মাঝারি। কিন্তু বাড়ির অবহেলায় উচ্ছন্নে যাচ্ছে। বাড়ির সবার বেশিরভাগ নজর ওর ভাইয়ের দিকেই থাকে। নানা জায়গায় চিকিৎসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছে ওর বাবা মা। বিশেষ কিছু উন্নতি হয়নি।
     পীযুষ বলল, “আরে হ্যাপি কাপল যে… ভুল সময়ে দেখা হয়ে গেল নাকি রে…”
     রিদিমা বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই থাম তো, ভাট বকিস না… শোন ওম তোকে আমার খুব দরকার। তোর প্রোজেক্টের খাতাটা আমায় একটু দিস তো। আমি কিচ্ছু পারছি না। ওদিকে ববিতা মিস হেভি খ্যাঁচাচ্ছে।” কথাগুলো বলতে বলতে রিদিমা একবার আড়চোখে নীলুর দিকে তাকালো। নীলু রিদিমার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, রিদিমা তাকাতেই মুখটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে করে নিল।
     রিদিমা আচমকা নীলুকে বলল, “হ্যাঁ রে বুচু আজ ফ্রী আছে বিকালে?”
     নীলু একটা ঢোক গিলে বলল, “কেন রে?... জানি না তো… বাড়ি গিয়ে জেনে তোকে ফোন করছি…”
     রিদিমা বলল, “থাক, চল তোর সাথে তোর বাড়িতেই যাই, কাকিমা বলছিল ওর কি যেন নতুন জামা একটা পাল্টাবার আছে, আমারও পাল্টাতে হবে… আমি আর ও চলে যাব…”
     পীযুষ বলল, “যাঃ শালা আমি কি করব এখন? আমার বাড়ি তো পুরো উল্টোদিকে…”
     রিদিমা একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “কেন আমি তোকে আমার সাথে আসতে বলেছিলাম নাকি?”
     পীযুষ একটা খারাপ কথা বলে সাইকেল ঘুরিয়ে চলে গেল। ওম একটু অপ্রস্তত হয়ে পড়েছে নীলু বুঝতে পেরেছে। ও ওমের কাঁধে হাত রেখে বলল, “চল না আমাদের সাথে…”
     ওম একটু হেসে বলল, “না রে আজ ইলেক্ট্রিকের বিল জমা দিতে যাব। আজ ছুটি যখন কাজটা সেরে নিই।”
     ওম চলে গেল। রিদিমা সাইকেল ঘুরিয়ে বলল, “চল আর সাইকেলে উঠে কাজ নেই… হাঁটি…”
     নীলুর কান গরম হচ্ছে। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ডিগবাজী খাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে। সে সম্মতি জানিয়ে রিদিমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। রিদিমা একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে বলল, “এদিকে আয়...” নীলু বুঝল ও ওর বাবার দোকানটা অ্যাভয়েড করতে চাইছে।
     রাস্তায় সেরকম কিছু বলতেই পারল না নীলু। রিদিমা ওর কাকার ছেলের কথা (রিদিমার কাকার নাম ঘটা, সেরকম কিছু করে না। নেশা করে রাস্তায় ঘাটে পড়ে থাকে, তাদের সাথেই থাকে। তার চার বছরের ছেলেটা রিদিমার খুব প্রিয়) বলেই যাচ্ছে। নীলু অর্ধেক কথা শুনতেই পাচ্ছে না… যেটুকু শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে না… তার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই বেজে চলেছে… ওমের গলা… ‘বলে দে নীলু… নীলু বলে দে… না হলে ও পীযুষের খপ্পরে পড়ে যাবে রে…’
     তাদের বাড়ির ঠিক আগের বাঁকটাতে এসেই সে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। রিদিমাও থেমে গিয়ে বলল, “কি হল রে…”
     নীলুর বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে… কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে বুঝতে পারছে… জিভটার উপরে যেন কে সিমেন্টের বস্তা চাপিয়ে রেখে দিয়েছে। কোনোরকমে যা বলল, তা সে বলতে চায়নি… সে হঠাৎ কঠিন গলায় বলে উঠল, “তুই ওই পীযুষের সাথে মিশিশ কেন? জানিস না ও মাল খায় আর আরো অনেক নোংরামি করে?”
     বলতে বলতে নীলুর গলা বুজে আসল… মনে হল এই বুঝি কেঁদে ফেলে… ভীষণ লজ্জা লাগতে লাগল… পা দুটো কাঁপতে লাগল। কোনোরকমে রিদিমার সাইকেলে একরকম ধাক্কা মেরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আয়…”
     রিদিমা চুপ করে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আসছি দাঁড়া… আরে দাঁড়া… অত জোরে জোরে হাঁটিস না… আমি অত জোরে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে পারি না…”
     নীলু দাঁড়াল। রিদিমা পাশে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাপ রে দৌড় লাগালি কেন?...”
     নীলুর নাকে এলো রিদিমার গা থেকে আসা কোনো ডিও বা পারফিউমের গন্ধ… ওর মনটা একই সাথে মোহিত আবার উদাস হয়ে গেল। মোহিত কারণ গন্ধটা রিদিমার গা থেকে। আর উদাস কারণ ডিও কেনাটা বা পারফিউম কেনাটা তাদের কাছে নিছক বিলাসিতা। কত পার্থক্য ওদের দু’জনের। আচ্ছা মানুষের যখন অবস্থা বদলায় তখন কি তার পুরোনো অভ্যাসগুলোও বদলায়? নীলুর মনে আবার একটা মন খারাপের মেঘ করতে লাগল… সে ঝট্‌ করে তা সরিয়ে ফেলে রিদিমার সাইকেলের হ্যান্ডেলে রাখা হাতে হাত রেখে বলল, “আয়।”


-----
     পীযুষের ঘরে ঢুকতেই ভালো লাগে না। ঢুকলেই সেই চীৎকার চেঁচামেচি। ভাইয়ের জন্য এই করো, সেই করো। বিরক্ত লাগে পীযুষের। আজ আরো মাথাটা গোলমাল লাগছে রিদিমার জন্য। কি দরকার ছিল নীলুর বাড়িতে ওর সাথে যাওয়ার? এই রকম হাজার একটা চিন্তা নিয়ে সে বিছানায় এসে শুলো। তার মা মণীষা ঘরে ঢুকেই চীৎকার করে উঠে বলল, “কি রে অসময়ে শুলি যে… শরীর খারাপ নাকি রে?”
     পীযুষ কিচ্ছু না বলে মোবাইলে গেম খেলতে লাগল। এটা নতুন কিছু না অবশ্য পীযুষের স্বভাবের। মণীষা রেগেমেগে বলতে লাগল… “হাজারবার বলেছি এই নেটের কার্ড না ভরে দিতে… না ভরে দিতে… কে শোনে কার কথা…”
     পীযুষ রেগেমেগে চীৎকার করে উঠল… “তুমি বেরোবে এ ঘর থেকে!!!”
     তার চীৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে পীযুষের ভাই চীৎকার করে কেঁদে উঠল... মণীষা পাশের ঘরে ছুটে গেল।
     পীযুষের কি মনে হল, সেও খানিক বাদে পাশের ঘরে গেল কান্না থামছে না দেখে। তার ভাই তাকে দেখে আরো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে কাঁদতে লাগল। পীযুষ গিয়ে ওর মাথার কাছে বসে, ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল। সেও পীযুষকে চেপে ধরতে চেষ্টা করল কিন্তু হাত-পা'গুলো ওর নিজের ইচ্ছামত চলে না। পীযুষ বারবার ওর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগল, “আরে আমি তোকে বকিনি তো… এই ধলা (ওকে এই নামেই ও ডাকে। ভালো নাম ধীমান)।”
     ধলার লালা পড়ে পীযুষের প্যান্ট ভিজতে লাগল। পীযুষের প্রচণ্ড কান্না পায় এক এক সময়, ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালে এই সময়টা। মনে মনে ভাবে আর কক্ষণো চীৎকার করবে না। তবু করে ফেলে। তার চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে। ধলার কান্না থেমেছে, সে ‘ঊঁ আঁ’ করে তার দাদাকে আদর করার চেষ্টা করছে।
     মণীষা চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। এমন কপাল তার! তার স্বামী, গোপাল পৈতৃক সূত্রে ড্রিঙ্কসটা পেয়েছে। সেটা এখনো ছাড়তে পারেননি। আর অশান্তি করতে তার আর ভালোও লাগে না। সব কেমন গা ছাড়া গা ছাড়া। হঠাৎ পিঠে কার একটা গা ঠেকল। পীযুষ। মণীষা চোখ মুছে ওর গালে একটা হাত দিয়ে বলল, “দাঁড়া খেতে দিচ্ছি। ম্যাগী করেছি। স্কুল নেই তো আজ। ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে?”
     পীযুষ, ‘হ্যাঁ’ বলে পাশের ঘরে চলে গেল। একতলা বাড়ি ওদের, তিনটে বেডরুম আর একটা বড় ডাইনিং। সামনে কিছুটা উঠোন। বহু পুরোনো বাসিন্দা বলে এখনও এতটা জমি আছে। মণীষার ইচ্ছা প্রোমোটারকে দিয়ে দেয়। তার ভাইয়েরই প্রোমোটার ব্যবসা, বেহালায়। গোপাল রাজী নয়।
     পীযুষ তুহিনকে ফোন করল।
     “তোর নেট আছে?”
     “হ্যাঁ, কেন রে?”
     “কাকিমা দুপুরে ঘুমালে সবাইকে নিয়ে আসব? একটা মস্ত্ ভিডিও’র লিঙ্ক পেয়েছি… টু হট… আমি শালা তিন মিনিট দেখেই মাল ধরে রাখতে পারিনি… আনব…?”
     তুহিন একটু ভেবে বলল, “আমি আধঘন্টা পর জানাচ্ছি।“


-----
     তুহিন চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। সবাই আসলেই তো শালা বাওয়াল হবে। কিন্তু ইচ্ছাও হচ্ছে ভীষণ। জেনুইন ইচ্ছা কিনা বুঝতে পারছে না। পীযুষ আজ অবধি বোরিং পানু দেখায়নি এটাও ঠিক। কি করবে? কিন্তু অনেকগুলো অঙ্কও জমে আছে বিকাশদার। না করে রাখলে আবার বর্ষার ট্যাকট্যাকে কথা শুনতে হবে। সেও বিরক্তিকর।
     ‘আচ্ছা একবার বার করে আসি। মন শান্ত হোক তারপর দেখা যাবে।’ বাথরুমে ঢুকল। মাষ্টারবেট করার সময় তার একটা ভয় হত আগে। কে যেন বলেছিল, বিয়ের পর অসুবিধা হয়। সিমেন বেরোয় না। ঠিক মত দাঁড়ায় না নাকি। সপ্তাহে একবারই নাকি ঠিক। আর এটাই শরীরের সব। তাই এটা বেরিয়ে গেলে ক্লান্ত লাগে এত। বেশি বার করলে নাকি ব্রণ হয়, চোখের জ্যোতি কমে, আয়ু কমে যায়। কি ভয় পেত সে এইট-নাইন-টেনে। কিন্তু না বার করেও থাকতে পারত না। কি কনফিউশানে কাটিয়েছে বাবা! তারপর বায়োলজী পড়তে গেল সৌরভ স্যারের কাছে। তিনি বোঝালেন, নেট দেখিয়ে পড়ালেন এগুলো অস্বাভাবিক কিছু না। প্রথম প্রথম মানতে চায়নি। তারপর বিশ্বাস হল। ক্লান্ত লাগে কারণ এতটা উত্তেজনা যায় বলে নার্ভগুলো দিয়ে, আর ব্রণটনো শুধুমাত্র হরমোনের জন্য হয়- টেস্টোস্টেরণ।
      ইচ্ছা করল না। তুহিন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। বেরোতেই পাপিয়ার মুখোমুখি। পাপিয়া তার দিকে তাকিয়েই বলল, “এই অ্যাতো ঘামছিস কেন রে? শরীর ঠিক আছে?”
     কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল তুহিন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বল, “আরে না, সেরকম কিছু না। গ্যাস হয়েছে হয় তো।”
     পাপিয়া বলল, “যা ফ্রীজের উপর জেলুসিলটা রাখা আছে, খেয়ে নে। আর শোন, আমি নিউমার্কেট বেরোব, তুই যাবি? ক’টা জিনিস কেনার বাকি আছে।”
     তুহিন বিরক্ত হয়ে বলল, “ধুর কি যে বলো না, আজ বিকাশদা আসবে না বিকালে?”
     পাপিয়া বলল, “এই দ্যাখো, আমি তো বলতে ভুলেই গেছি তোকে… আজ তো বিকাশ আসবে না… ওর পিসী না কাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে বলল অ্যাপোলোতে।”
     তুহিনের বুকটা ধক্‌ করে উঠল। সে বলল, “তাই?”
     “অমনি খুব খুশী না? চল আমার সাথে। আরেকটা জিন্স কিনে দেব।”
     তুহিন বলল, “থাক, আমি বাচ্চা না যে মায়ের সাথে মার্কেটিং-এ যাব। আর তুমি যা বোরিং একটা দোকানে ঢুকবে তো ঢুকবেই... উফ... ডিসগাস্টিং…”
     পাপিয়া রেগে গিয়ে বলল, “এক একসময় ভাবি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে কি ভুলই না করেছিলাম। তোর মত একটা অপগণ্ড মানুষ করতে গিয়ে পুরো ক্যারিয়ারটাই জলে গেল।” (এটা ঠিক। পাপিয়া অঙ্কে মাষ্টার্স। খুব ভালো স্কোর ছিল। কিন্তু শুধু ছেলে মানুষ করবে বলে, একটা সরকারি স্কুলের চাকরী ছেড়ে দিয়েছিল।)
     তুহিন আর কথা না বাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুলো। পীযুষকে লিখল, ‘ডান।’
     খানিক বাদেই উত্তর এলো... ‘ওকে’

------
     রিদিমা ঘুচুর সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেল, নীলুর দিকে ফিরে তাকালোই না। ঘুচু ব্যাপারটা বোঝে, কিন্তু নীলুকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না। সে কিছুক্ষণ এ ঘর ও ঘর করে, দাদার কাছে এসে বলল, “রিদিমা দিদিটা খুব ভালো জানিস। তুই একটু বেশি রুড কথা বলিস ওর সাথে। কেন একটু ভালো করে কথা বলতে কি তোর জিভ ক্ষয়ে যায়?”
     চুপ করেই থাকল নীলু। শুধু বলল, “হুঁ।”
     দাদার মুড ভালো না দেখে সে পাশের ঘরে চলে গিয়ে টিভি চালালো। নীলু উঠে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শুতে যাবে, এমন সময় তাদের মা রমা আসল। রমা বলল, “তুই ওবেলা ঘুচু আর রিদামাকে নিয়ে একটু যা না রে নতুন মার্কেটটায়। ওর চুড়িদারটা ছোট হচ্ছে। এতগুলো টাকা দিয়ে কেনা বল।”
     নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার পীযুষদের বাড়ি পড়া আছে। ইংরাজী।”
     “ও”, বলে রমা ফিরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে রিদামা পড়ে না ওখানে?”
নীলু বলল, “ও রিদিমা মা, রিদামা নয়। না ও অন্য স্যারের কাছে ইংরাজী পড়ে। কেন?”
“না এমনি”, বলে রমা বেরিয়ে গেল।
     পীযুষ ঘটাকাকার (রিদিমার কাকা) সাথে দেখা করল ঘুপটি রেশন ঘরের পিছনে। সে গাঁজা কেনে মাঝে মাঝেই এই ঘটাকাকার থেকে। পরিচিত বলে হোক বা রিদিমার বন্ধু বলে হোক, একটু কম দাম নেয়। আর প্রতিবার বলে, “আর খাস নি খাস নি ওগুলো… বিষ… ছেড়ে দে…”
কে ওই সব শোনে। সে খেঁকিয়ে উঠে বলে, “মাল ছাড়ো তো!!! যত্তসব নাকিকান্না বউকে শুনিও।” ঘটার এক একবার মনে হয়, দেয় গালে দুটো চড় চড়িয়ে। পারে না। কেন যেন হাতে জোর আসে না। বিবেকে লাগে তবু। মারব ভাবলেও লাগে, না মারলেও লাগে। একবার ঠারেঠোরে ওর বাবা গোপালকে বলতে গিয়েছিল, সে তার বাল্যবন্ধু। তা সে হেসে উড়িয়ে দিল... বলল, “আমাকেও তো চিনতে ঘটা, আমিও কি কম নেশা করিচি ওর বয়সে, এ আমাদের রক্তে… তাও তো এখনো মাগীবাড়িটা যায় না হয় তো। আমি তো তাও গেচি। তারপর পুলিশের তাড়া খেয়ে ফিরে এয়েচি… হুম... কোন বংশের ছেলে দেখতে হবে তো!”
     ঘটা আর কথা বাড়ায়নি। বলতেই পারত, “তোমার মামা অত উঁচু সরকারি পদে কাজ করত বলে তোমার চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল। তুমি নিজের এলেমে তো পাওনি? যদি না পেতে তবে তোমাতে আর ঘটাতে কোনো তফাত থাকত না…”
     কি হবে বলে… বলতে গিয়ে শুধু ক’টা ভাটের কথা শোনা আরো… থাক্‌।
     আড়াইটে নাগাদ এক দঙ্গল ছেলে ঢুকল তুহিনদের বাড়িতে। গাঁজার আসর বসল। পীযুষ বাবার কয়েকটা বোতলও এনেছে। তুহিন এসব খায় না অবশ্য, তবে বাধাও দেয় না।
     ক্রমশ ঘর ধোঁয়াতে ভরতে লাগল। তুহিন জানলাগুলো খুলতে পারছে না। পাশেই অন্যবাড়ির জানলা। একবার ক্যাঁচাল হয়েছিল এই নিয়ে। যা তা। তুহিন মনে মনে প্রমাদ গুনল, আজ কিছু একটা হবে।


------
     বিকাশ আর অশ্রু যখন বাসে উঠল ফেরার তখন ছটা পাঁচ। অন্ধকার হতে শুরু করেছে। অশ্রু বাসে উঠে লেডিস সিটের দিকে চলে গেল। বাসে যথেষ্ট ভীড়। এই সময় ট্রেনটা অ্যভয়েড করতে চায় অশ্রু। ওর অনেক পরিচিত লোকেরা নাকি ফেরে এই সময়টা। যুক্তিটা বুঝতে পারে না। তবু মেনে নেয়। সে নিজেও তো সত্যি কথাটা বলতে পারেনি তুহিনের মা’কে। কেন সে নিজেও জানে না। আসলে চাকরী না পাওয়া পর্যন্ত এই স্বপ্ন দেখাও কিরকম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার মত লাগে সবার। বিকাশেরও লাগে। কিছু বই কিনল, সব ওই চাকরীর পরীক্ষা দেওয়ার জন্যেই অবশ্য।
     অশ্রু ইশারায় জানালো ও টিকিটটা কেটে নিয়েছে। আচ্ছা ও যদি চাকরী না পায় কোনোদিন… তা বলে কি কোনোদিন পাবে না অশ্রুকে? এও সম্ভব? তাকে অশ্রুকে ছেড়ে বাঁচতে হবে? হতে পারে না… না না না… সে জোরে জোরে দু’বার মাথা নেড়ে ফেলল। পাশের দাঁড়ানো ভদ্রলোক বললেন, “কি দাদা শরীর খারাপ?” বিকাশ লজ্জা পেয়ে বলল, “না না…” তাড়াতাড়ি একবার অশ্রুর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। যাক নিশ্চিন্ত, দেখেনি কিছু। ও বুঝে যেত। কি করে কি করে ও বুঝে যায়...
     বিকাশ ভাবল এই রবিবার গিয়েই সে অশ্রুর বাবার সাথে দেখা করবে। মা চলে যাওয়ার পর বাড়িটায় কিরকম লাগে তার ঢুকতে। যা হোক হবে। না হয় টিউশান করেই চলবে। তবু সে বলবেই বলবে। বাসটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়ালো। তারও যেন চিন্তার জাল ছিঁড়ল। হঠাৎ মনে হল কি অসম্ভব কথা ভাবছিলাম আমি… নিজের জন্য মেয়েটার জীবন কেন নষ্ট করব? ও আমার থেকে আরো ভালো ছেলে পাবে। ভাবতে ভাবতেই দেখল অশ্রু তার মুখের দিকে তাকিয়ে। বিকাশের মাথা আবার গুলিয়ে গেল।
     বিকাশ একটা বসার সিট পেয়েছে। চোখ রাখল অশ্রুর চোখে। মাঝে নানান মানুষ। তার অশ্রুকে ছুঁতে ইচ্ছা করছে। অশ্রু কারোর হতে পারে না, না না কারোর না! আবার মাথা নাড়তে লাগল। চমকে গিয়ে দেখল সেই ভদ্রলোক নেই তো? নাহ, নেমে গেছে। থাকলে নির্ঘাত তাকে পাগল ঠাওরাতো। সে আবার অশ্রুর দিকে তাকালো, সে মুখ টিপে টিপে হাসছে। তবু চোখের কোণটায় যেন জল। জল? না তার মনের ভুল? বাসের আলোগুলো কেন যে এত কমজোরি… তার অশ্রুকে ছুঁতে ইচ্ছা করছে আবার। হাতটা বাড়াতে গেল… অশ্রু চোখ বড়বড় করে বলল… না… ইশারায়। ওর পাশের একজন দিদিমণি গোছের কেউ মুখ টিপে হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল… বিকাশ বলে যেতে লাগল মনে মনে… “তুমি আমার, শুধু আমার…”
     অশ্রু হাসল? ওর মুখের কোণে যেন একটা হাসির ঝিলিক না? হতে পারে। ও সব বুঝে যায়... সব... সব... সব বুঝে যায়....

১০
---------
     আচমকা থমকে গিয়ে রিদিমা নীলাঞ্জনাকে বলল, "ঘুচু, এখানে একটা দারুন কফিশপ আছে, চ, যাবি?"
     নীলাঞ্জনার মুখটা খুশীতে দপ্ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। সে অনেকবার এই মার্কেটে মায়ের সাথে এসেছে। কফিশপটাও চেনে। কি সুন্দর কফির গন্ধ বেরোয় ওরা পাশ দিয়ে গেলে। তাদের বাড়িতে শীতকালে মাঝে মাঝে কফি হয়। তার দারুন লাগে।
     নীলাঞ্জনা সামনের শাড়ির দোকানের কাঁচে নিজেকে একবার দেখল। এইরকম শালোয়ার পরে যাওয়া যায়? তাছাড়া সে আজ ডিওটাও মেখে আসেনি। এবারে পূজোয় কিনেছে। যাবে কি? যাওয়ার ইচ্ছাটাও খুব হচ্ছে।
     রিদিমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, "এমন কিছু খারাপ জামা না ঘুচু, চ..."
একরকম টানতে টানতেই কফিশপে আনল রিদিমা তাকে। এসি চলছে। একটা ইংরাজী গান বাজছে। নীলাঞ্জনার মনে হচ্ছিল হেডদিদিমণির ঘরে ঢুকে পড়েছে যেন। ভয়ে বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এখনো তার হাতটা রিদিমাদির হাতে। তার হাত ঘামছে।
     রিদিমা আর সে একটা টেবিলে বসল। লোক বেশি নেই। রিদিমা উঠে গিয়ে কি সব বলল কফি বানানোর লোকটাকে। তারপর কফি নিয়ে আসল দু'কাপ। কি স্মার্ট রিদিমাদি! তার দাদাটা যেন কেমন ভোঁদলা। ওর পাশে মানাবে ওকে?
     "কিরে কি ভাবছিস?" রিদিমা নীলাঞ্জনার হাতে একটা চাপড় মেরে জিজ্ঞাসা করল।
     "আচ্ছা রিদিমাদি, তুমি কি দাদার বেস্টফ্রেণ্ড?"
     রিদিমার কানটা গরম হয়ে গিয়ে লাল হয়ে উঠল। এত সরাসরি প্রশ্নটা ও আশা করেনি। বেস্টফ্রেণ্ড মানে কি বোঝাতে চাইছে ঘুচু রিদিমা বোঝে।
     ঘুচুও কথাটা এভাবে এত সরাসরি বলে ফেলবে বুঝতে পারেনি। আসলে এই পরিবেশটায় বসে বসে তার মনটা কেমন অন্যরকম লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন হিন্দি সিনেমার হিরোইনদের মত খুব দামী একটা জায়গায় বসে আছে। তার বাবার যেন সাইকেল সারানোর দোকান না। তারা যেন গরীব না। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন। এটাই সত্যি।
     ঘুচু একটু বোকার মত হেসে কফি কাপে চুমুক দিল। নাকের নীচে কফি লাগল গোঁফের মত।
     রিদিমা হেসে বলল, "কফিটা মোছ।"
     ঘুচু কফি মুছতে মুছতে বলল, "কি দারুন বানায় না গো এরা?"
     রিদিমা বলল, "হুম। তোর দাদা কি বলে আমার ব্যাপারে?"
     ঘুচু হঠাৎ নড়েচড়ে বসল। এই তো একটা বড়দের মত কাজ পেয়েছে সে অ্যাদ্দিনে। সে কফিতে খুব বিজ্ঞের মত একটা চুমুক দিয়ে (যেমন ভাবে সিরিয়ালে খায় আর কি) বলল,
"তোমার কথা বললেই খুব লজ্জা পায় জানো। আমি তোমার ফিলিংসটা বুঝি। ওরটাও বুঝি। তোমার আমাদের ফ্যামিলি নিয়ে একটু কনফিউশান আছে না? কিন্তু আমরা ততটাও গরীব না জানো.. (তার মনে হল এটা সে কি বলছে?? তবু জিভটা যেন নিজে নিজেই বলতে শুরু করেছে)...
     "আমাদের দু'বার মাংস হয় প্রতিমাসে। দাদার পাঁঠা প্রিয়, ওদিকে বাবার বারণ, তাই চিকেনটাই বেশি হয়। (কেন এসব বলছি... ছি ছি.... এগুলো তো বাচ্চাদের মত কথা)
     "দাদা তোমায় খুব ভালোবাসে জানো রিদিমাদি... আমি সিওর..."
     রিদিমা এভাবে ঘুচুকে দেখেনি এর আগে, এত বাচ্চাদের মত কথা বলে ও! এত উত্তেজিতও দেখেনি... রিদিমা কথা আর না বাড়িয়ে বলল, "হুম, তাড়াতাড়ি খা... ভিড় বাড়বে এবার.... আর তোর দাদার বড্ড ঘ্যাম জানিস..."
     ঘুচু হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল শেষের কথাটা শুনে। বড় বড় চোখ করে মুখটা তুলে বলল, "যা!! ও তোমায় দেখলে হেব্বি লজ্জা পায় আসলে..."
     রিদিমা হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, "চ... এগোই", ঘুচু রিদিমার পিছন পিছন বেরিয়ে এলো কফিশপ থেকে। উফ্, কি গরম বাইরে!
     হঠাৎ তার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। সে যেন আবার ঘুচু হয়ে গেল। তার বাবার সাইকেলের দোকান।
     সে থেমে গিয়ে রিদিমার দিকে তাকিয়ে বলল, "পীযুষদা না খুব ভালো ছেলে জানো। আমি জানি। লোকে ভুল বোঝে ওকে..."
     রিদিমা চমকে গেল, বিস্মিত হয়ে ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো.... আজ এত অপরিচিত লাগছে কেন ঘুচুকে তার? একটু আগে যার চোখে বাচ্চার ঝিলিক দেখছিল, তার চোখ এত পালটে গেল?! এইটুকু সময়েই?... তাও পীযুষের জন্য???

১১
-------
     ওম ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে এসে সারাদিন শুয়েই কাটাল। পিসী কোন এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ীতে পূজোর জামা দিতে গেছে। রান্নার দিদি রেঁধে গিয়েছিল। ওম ঘুম থেকে উঠল যখন ঘড়ি দেখল, তখন বিকেল পাঁচটা। খেতে ইচ্ছে করছে না তবু পিসীর ভয়ে খাবার টেবিলে বসল। দু-তিন গাল খেয়ে বুঝল ক্ষিধেটা খুবই পেয়েছিল।
     খাওয়া দাওয়া সেরে থালা-বাসনগুলো ধুয়ে রেখে ওম ছাদে আসল। তাদের বাড়ীটা গলির একটা প্রান্তে। পূবদিকে একটা বড়ো ডোবা। তার ওপাশে ফ্ল্যাটগুলো দেখা যায়। ওমের বাবা-মায়ের মুখটা মনে পড়ে না। তার জন্মাবার চার বছরের মাথাতেই মা আর বাবা মুর্শিদাবাদে একটা গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা যায়। ওমের ছাদে পায়চারী করতে করতে হঠাৎ মাথায় আসল, আরে! আজ ইংরেজী পড়া না...? পীযুষের বাড়ীতে...! একদম ভুলে গিয়েছিল। যাক গে আর যাবে না। অলরেডী সাড়ে পাঁচটা বাজে। পড়তে যাবে না ভাবতে তার মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল হঠাৎ। একটা সারপ্রাইজ দিল নিজেকে যেন। নিজেকে সারপ্রাইজ দিতে বেশ লাগে ওমের।
     ভগবান তাকে যে সারপ্রাইজটা দিয়েছে সেটা সে বুঝেছিল ক্লাস সেভেন এইটে। সব ছেলেরা যখন মেয়েদের কথা বলত সে কোন উৎসাহই পেত না। একদমই না। বরঞ্চ বড় বড় ছেলেদের বুকের লোম, হাত-পায়ের মাস্‌ল, ঘামের গন্ধ তার শরীর মন উদ্বেল করে দিত। কাউকে বলতে পারত না। পীযুষ প্রথম ওকে ক্লাস নাইনে বলে, “তুই ব্যাটা 'গে'।” তারপর সে বাড়ীতে এসে পিসীর মোবাইলে ইন্টারনেট সার্চ করে শব্দটার মানে দ্যাখে। কত ছবি এসেছিল গুগল সার্চে দিতেই! তার প্রচন্ড ভয় আর আনন্দ একসাথে লেগেছিল। ভয়, কারণ সে সবার মত নয়। আবার আনন্দও, অনেকেই তার মত।
     তবু মনের মধ্যে কোথাও একটা খচখচ করত। একবার ক্লাস টেনে পড়তে টুয়েল্‌ভে ফাঁকা ঘরে পীযুষ তাকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ পীযুষ নিজের প্যান্টের চেন খুলে ওমকে হাত দিতে বলে। ওমের কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করে। তবু খুব গভীর থেকে মনে হয় এটাই সে চেয়েছিল। তারপর পীযুষ ওকে ওরাল সেক্স অফার করেছিল। ওম পারেনি, গা গোলাচ্ছিল। স্যারকে বলে বাড়ী চলে এসেছিল। সেদিন বাড়ী ফেরার পর তার শরীরে ও মনে ঘটনাটার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সে বুঝতে পারেনি তার ভাল লাগছে না খারাপ লাগছে। অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
     পরের দিন সকাল থেকে তার মনের মধ্যে বারবার মনে হয় সে এরকম হবে না। কিছুতেই হবে না। ওম জানতো, তাদের বাথরুমে পিছনের দিকের দরজায় একটা ফুটো আছে। পিসী স্নান করতে যাওয়ার পর ওম চোরের মত সে ফুটোতে চোখ রাখে। পিসীর বয়েস কত? আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ হবে - ঠিক জানে না। তবু পিসীকে বয়স্কা কিছুতেই লাগে না। বাথরুমে পিসী যখন সম্পূর্ণ জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে, পিসীকে পুরো নগ্ন দেখেও তার কোন অনুভুতি হয় না। ফুটো দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জোর করে মাস্টারবেট করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।
ধীরে ধীরে সে মানতে শুরু করে, সে 'গে'।
     নীচে হঠাৎ সাইকেলের আওয়াজ। তাড়াতাড়ি কার্ণিশের কাছে সে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিলু। ওম বলে, “কী রে, পড়তে যাস নি?”
     "তুই যাস নি কেন?” নীলু সাইকেল থেকে না নেমে উপরদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
     ওম বলল, "আসছি দাঁড়া”
     নীলু বলল, "দাঁড়া দাঁড়া, একবারে রেডি হয়ে আয়। ঘুচু আর রিদিমা কী একটা জামা কাপড় পাল্টাতে বাজারে গেছে। মা বলছিল ওদের সাথে যেতে। যাবি?”
     ওম এক সেকেণ্ড ভেবেই বলল, "দাঁড়া আসছি, যাব।”

১২
--------

     পীযুষ তুহিনদের বাড়ী আসার আগেই ওদের ইংরাজী স্যারকে (বাচ্চুকাকু) ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল ওরা আজ বাড়ী থাকবে না, তাই যেন পড়াতে না আসেন। বাকী বন্ধুদেরও পার্সোনালী মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিল। পীযুষরা যখন তুহিনদের বাড়ি থেকে বের হল তখন সন্ধ্যে হয় হয়। মাঝরাস্তায় অম্লানের সঙ্গে পীযুষের কী নিয়ে একটা ঝামেলা বাধল। পরে জানা গিয়েছিল কারনটা নীলাঞ্জনা। অম্লান এখানকার খুব বড় একজন মাছ আড়তদারের ছেলে। বয়স অনুযায়ী পড়ার কথা ফার্স্ট ইয়ারে, কিন্তু মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা এগোয়নি।
     অম্লান বলল, "তুই নীলাঞ্জনাকে নিয়ে কোন কথা বলবি না... ও আমার মাল... আমি তুলব। তোর বাপের সাধ্য নেই আমি যা দিতে পারি ওকে, তা দেবে।”
     পীযুষ মুখটা বিকৃত করে সজোরে অম্লানের নাকে একটা ঘুষি চালায়... "শালা মাল বল তোর মা'কে।”
     অম্লানের নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। রাস্তাতেই অম্লান পীযুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তুমুল হাতাহাতি বেধে যায়। অম্লানের জিম করা ডাকাবুকো শরীর পীযুষ কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। তার মাথাটা একটা ইঁটে লেগে ফেটে যায়। বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে গিয়েও ছাড়াতে পারে না, কারণ নেশার চোটে তাদেরও শরীরে সে শক্তি নেই। আশেপাশে লোক জমা হতে থাকে, নানারকম মন্তব্য করে কিন্তু কেউ এগোয় না। বিকাশ আর অশ্রু ফিরছিল ওই রাস্তা দিয়ে। আর ঘটনাচক্রে ওম আর নীলুও ওই রাস্তা দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল। নীলু ঘটনাটা বুঝতে পেরেই সাইকেলটা রাস্তার একদিকে ছুঁড়ে ফেলে অম্লানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অম্লান গোঙাতে গোঙাতে রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। পীযুষের তখন একটা আচ্ছন্ন অবস্থা। সে তবু বলে যাচ্ছে, "নীলাঞ্জনা মাল না... ও আমার... ও আমার...”
     নীলুর কান গরম হয়ে যায়। বিকাশদা এসে পড়ে। অশ্রু চিৎকার করে ভীড় সরায়। একটা ভ্যানে করে তাড়াতাড়ি দু’জনকে তুলে পাশেই লাইফ লাইন নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। পীযুষ ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে। অম্লানের জ্ঞান আছে।
     অম্লানকে ফার্স্ট এইড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পীযুষকে এডমিট করে নেয়। ততক্ষণে আরোও বন্ধুরা খবর পেয়ে নার্সিং হোমের নীচে ভীড় জমিয়ে দিয়েছে। তুহিনও এসে গেছে। বিকাশ অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি শিগগিরি পীযুষের বাড়ী যাও। কাকীমা নিশ্চই এতক্ষণে জেনে গেছেন।”
     বিকাশ নীলুকে খুঁজছে। কারণ ও জানে পীযুষের মুখ থেকে নীলু কি শুনেছে। বিকাশ গিয়ে দেখে নীলু একটা বেঞ্চে বসে আছে। তার পাশে বসে ওম তাকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। বিকাশ ওমকে বলে, "তুই একটু উপরে যা তো। পীযুষের বাবা এখনই চলে আসবে, ফোনে কথা হয়েছে। তুই ওদিকটা সামলা।”
     ওম কিছু একটা বুঝতে পেরে উঠে যায়। বিকাশ বসে নীলুর পিঠে হাত রাখে। "আমি জানি পুরো ব্যাপারটা। তুই প্লীজ এইসময় কিছু রি-এক্ট করিস না। আমি পরে ব্যাপারটা দেখছি।” নীলু মুখ তুলে বিকাশের দিকে তাকায়, নীলুর চোখ দুটো লাল।
     ওম পীযুষের কেবিনের বাইরে এসে দেখে তুহিন দাড়িয়ে। তুহিন বলে, "বোস। আমি বাকিদের নীচে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। উপরে এসে বেকার বাওয়াল করবে।” তুহিন তার হাতটা ওমের হাতে দেয়। তুহিনের চোখদুটো ছলছল করছে। বলল, "হ্যাঁ রে, ছেলেটা কি মরে যাবে?” তুহিনের গলা বুজে আসল। দুটো আঙ্গুলে চোখের কোণা দুটো চিপে ওমের কাঁধে মাথা রেখে আচমকা কাঁদতে শুরু করল। ওম একটা হাত ওর পিঠে রেখে বলল, "কিচ্ছু হবে না।”
     তুহিন ওমের কাঁধ থেকে মাথা তুলে খুব আবেগের সঙ্গে বলল, "পীযুষটা নীলের বোনটাকে ভীষণ ভালবাসে রে। ও একবার ‘হ্যাঁ’ বললে ছেলেটা পাল্টে যায়। কিন্তু নীলুর ভয়ে পীযুষ এগোতে পারে না। তুই একবার নীলুকে বুঝিয়ে দ্যাখ না। বলিস তো আমিও কথা বলব। অম্লান কী থার্ডক্লাস ছেলে সেটা আমি আর পীযুষ ছাড়া কেউ জানে না। অম্লান আর ওর বন্ধুরা মিলে একবার নীলাঞ্জনার পিছু নিয়েছিল। পীযুষ ঘটাকাকা আর ওর সাগরেদদের সাথে মিলে অম্লানকে কী মার মেরেছিল সে শুধু আমরাই জানি। এটা এই বিশ্বকর্মা পূজোর রাতের ঘটনা। তারপর ঘটাকাকার হাতে পায়ে অম্লানের বাবা এসে ধরে। জানিসই তো অম্লানের বাবার কি ইনফ্লুয়েন্স, তাই ঘটাকাকা পুরো ব্যাপারটা চেপে যায়। অথচ নীলাঞ্জনাকে পীযুষ বাড়িতে এসব জানাতে বারণ করেছিল। বেকার বেকার টেনশান। ওর বাবার দোকানটাই হয় তো উঠিয়ে দিল।"
     হঠাৎ নীচ থেকে চীৎকার আসল। তুহিন ধড়মড় করে উঠে পড়ল। পীযুষের মা।

১৩
-------
     পীযুষকে ছাড়ল দু'দিন পরে। ঘটনাটা যেদিন ঘটে সেদিন অনেক রাতে অম্লানের বাবা পীযুষদের বাড়ীতে কিছু লোক নিয়ে চড়াও হয়। হুমকি দিয়ে আসে কোনরকম পুলিশ কেস হলে প্রোমোটার লেলিয়ে দিয়ে পাড়াছাড়া করবে। ঘুষ হিসাবে দু'পেটি বিদেশি মদ রফা হয়।
     মণীষা প্রায় উন্মাদের মত হয়ে যায়। পীযুষ নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর সম্পূর্ণ গুম মেরে যায়। সেদিন বিকালে বন্ধুরা দেখা করতে এসেছিল, পীযুষ একটা কথাও বলে না, শুধু ইন্দ্রনীলকে একবারই জিজ্ঞাসা করেছিল, “নীলু কেমন আছে?”

     মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটল এর আরো দু'দিন পর। নীলুর সেদিনের মারামারির ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই রাত্রে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না। দেরী করে উঠছে। সামনে পূজো বলে টিউশনগুলোতেও অতটা চাপ নেই। মহালয়ার তিনদিন আগে বৃহষ্পতিবার সকালবেলা নীলুকে ধড়মড় করে ঠেলে তুলল রমা। নীলু কিছুটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বলল, "কী হয়েছে?” দেখে সামনে তার বাবা চেয়ারে বসে, মুখে হাত চাপা। রমা বলল, "পীযুষের ভাইটা ভোররাতে মারা গেছে।” নীলু ফ্যালফ্যাল করে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বলল, "কে বলল?”
     রমা বলল, "তুই বাইরে যা, ওম তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
     নীলু চোখেমুখে জল না দিয়েই সাইকেলটা নিয়ে ছুটল পীযুষের বাড়ীর দিকে। পীযুষের বাড়ীতে ও ইংরাজী পড়তে যেত। ওর ভাইকে সে কবে থেকে দেখছে। নীলু এও জানে পীযুষ ওর ভাইটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।
     পীযুষদের বাড়ীর সামনে ভীষণ ভীড়। নীলু সাইকেলটা একরকম ফেলে দিয়ে একে ওকে ঠেলে ঘরের দিকে এগোতে লাগল। বিকাশদা, অশ্রুদি, রিদিমা সবার মুখে চোখ পড়ল, কিছু বলল না। বিশ্বকর্মা পূজোর রাতের ঘটনাটা ওম সব বলে দিয়েছে নীলুকে। নীলাঞ্জনার কাছেও শুনেছে। অ্যাদ্দিন চেপে গিয়েছিল বলে ঠাঁটিয়ে ঘুচুর গালে একটা চড়ও মেরেছে। ঘুচু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল শুধু, পীযুষদা দিব্যি করিয়েছিল যে। নীলু ঘটাকাকার কাছে গিয়ে সবটা যাচাইও করেছে। ঘটাকাকা বারবার বলেছে, "পীযুষ খারাপ ছেলে নয় রে। আমি নিজে তো খারাপ, তাই খারাপটা সবার আগে আমার চোখে পড়ে। পীযুষ খাঁটি ছেলে। ওর বাইরেটাতেই যত জঞ্জাল। সেটা ওর বাবার ওপর রাগে অভিমানে ও বানিয়ে রেখেছে।”
     পীযুষের মায়ের চীৎকার কানে আসছে। নীলু থমকে ওর বাড়ীর দরজাটার সামনে দাঁড়াল। চটির পর চটি। চটিটা খুলে যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে সে ঘরে ঢুকেই খাটের ওপর ধীমানকে শোয়ানো দেখল। চোখ বোজা, মুখটা শক্ত। নীলুর গলার কাছে একদলা কান্না জমাট বাধল। বুকের কাছে নিঃশ্বাসটা আটকে রেখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পীযুষকে খুঁজল, পেল না। আচমকা কাঁধে কে হাত রাখল। ফিরে দেখল অশ্রুদি। অশ্রুদি ইশারা করে কোণের ঘরটা দেখাল। নীলু ক্ষিপ্রগতিতে কোণের ঘরটার দরজার কাছে এসে দেখে পীযুষ, মাথায় ব্যান্ডেজ, শূন্য দৃষ্টিতে পাখার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে।
     নীলু চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবল ঢুকবে কি ঢুকবে না। ভাবতে ভাবতেই পীযুষের চোখ তার ওপর পড়ল। পীযুষের নীচের ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল। করুণভাবে তাকিয়ে বল, "সব আমার পাপে নীলু...”
     নীলু গিয়ে ওর পাশে বসতেই পীযুষ ওর কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছে। নীলুর হঠাৎ ওর বোনের মুখটা মনে পড়ল... সাথে বিশ্বকর্মা পূজোর রাতের ঘটনা... সাথে ঘটাকাকার বলা কথাগুলো... সেও পীযুষকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।
     কতক্ষণ এভাবে কাটল তারাও জানে না। বিকাশদা ও অশ্রুদি এসে তাদের দু’পাশে বসল। নীলু বলল, "বিকাশদা, একটু রিদিমাকে ডাকো না।”

১৪
---------
     বিকাশদা রিদিমাকে ডেকে নিয়ে আসল। রিদিমার চোখদুটো লাল। নীলু তাকে বলল, "তুই একবার ঘুচুকে ডেকে নিয়ে আয় তো।”
     পীযুষ চমকে গিয়ে "না না তার কোন দরকার নেই। ও বাচ্চা, ও এখানে এসে কী করবে? ভয় পাবে।”
     নীলু কঠিন গলায় বলল, "তুই চুপ কর।”
     অশ্রুদি বলল, "আমি যাচ্ছি রিদিমার সঙ্গে।” ওরা বেরিয়ে গেল।
     ওম পীযুষদের বাড়ীর উঠানের একটা কোণে মাটিতেই বসেছিল। তুহিন এসে ওর পাশে বসল। দুজনেই কেউ কোন কথা বলছে না। তুহিন হঠাৎ বলল, "ওম আমার মনের ভিতরটা ভীষণ উথাল পাথাল হয়ে গেছে। এত কাছ থেকে আমি মৃত্যুকে কোনদিন দেখিনি। আমার ভীষণ ভয় করছে। বাবা মা তো কারো চিরকাল সঙ্গে থাকে না। আমি পুরো একা হয়ে যাব রে বড় হলে?”
ওম বলল, "তাই তো মানুষ বিয়ে করে রে বোকা।” বলে সে ভীড়ের একদিকে ইঙ্গিত করল। তুহিন চোখ তুলে তাকাল, বর্ষা দাঁড়িয়ে। তুহিন আচমকা সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ওমকে বলল, "আর আমি যদি বলি আমি তোকে চাই।” ওম থতমত খেয়ে গেল। উঠে পড়তে যাবে, তুহিন ওকে হাত ধরে বসিয়ে দিল। বলল, "আজ আমি যা বলতে পারব হয়তো কাল ভয়ে আর বলতে পারব না। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি। কিম্বা হয়তো বুঝলেও মানতে পারছি না...”
     ওমের কানে কিছু ঢুকছে না। সে বোকার মত শুধু মনের মধ্যে ভেবে চলেছে, এও কি সম্ভব... এও কি সম্ভব... এও কি সম্ভব... তুহিন!!!
     অশ্রু নীলাঞ্জনাকে নিয়ে ঢুকল। নীলাঞ্জনাকে পীযুষের ঘরটায় যেতে বলল। নীলু পীযুষের পাশেই বসেছিল, ঘুচুকে আসতে দেখেই সে বিকাশদাকে বলল, "ওম কোথায় গো?”
     ঘুচুকে বসতে বলে নীলু বাইরে চলে আসল। সে জানে না সে ঠিক করছে, না ভুল করছে। শুধু তার মনে হচ্ছে এটা তাকে করতেই হবে। পিছনে পিছনে দেখল রিদিমা এসে দাঁড়িয়েছে।

১৫
--------
     শ্মশান থেকে ফিরে কেউ বাড়ি গেল না। সবাই বেশ রাত অবধি পীযুষদের বাড়ী রয়ে গেল। বিকাশ আর অশ্রু একটা কোণে বসে উঠানে। এখানে ওখানে ছিটকে তাদের ছাত্রছাত্রীরা। ওদের গার্জেনরা এসে দেখা করে ফিরে গেছে। ছেলেমেয়েগুলো কেউ যেতে চায়নি। গার্জেনরা এসে বিকাশ আর অশ্রুকে বারবার বলে গেছে, তোমরা এদের একটু বাড়ী পৌছে দিও তো গো।
প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল বিকাশ আর অশ্রু পাশপাশি বসে, কোন কথা বলছে না। বিকাশ হঠাৎ বলল, "আচ্ছা এই ছেলেমেয়েগুলোর ওপর আমাদের কোন দায়িত্ব নেই? আমরা যদি শুধু ছেলেমেয়ে পড়িয়ে আমাদের জীবনটা কাটিয়ে দিই, খুব কি ক্ষতি হবে? আর না হয় হলই, দুটো প্রাণীর ক্ষতিতে সমাজের কি খুব বড় ক্ষতি হবে? আমরা যদি এদের ভালবাসতে শেখাই, একে অন্যকে বুঝতে শেখাই... না হয় সেগুলো কোন সিলেবাসেই নেই, এদের জীবনগুলো কি নষ্ট হয়ে যাবে?” আরোও কি বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ অশ্রুর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ থেকে ফোঁটাফোঁটা জল পড়ছে। বিকাশ বলল, "আমি কি কিছু ভুল বললাম? দেখো আমার কি মনে হচ্ছে জানো তুমি আমার জন্য জীবনটা নষ্ট কোরো না, তুমি অনেক ভাল ছেলে পাবে... তুমি বিয়ে করে নাও... আমার জন্য জীবনটা নষ্ট কোরো না প্লীজ... আমি এদের ছেড়ে যেতে পারবো না... এরকম আরো তো কত আসবে বল ভবিষ্যতে... গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে এখানে ওখানে ঠোকা খেয়েই কি এদের জীবনগুলো শেষ হয়ে যাবে? না... না... না...”
     হঠাৎ বিকাশ খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। তার গলা বুজে আসল। পাদুটোকে জড়ো করে হাঁটুতে মাথাটা ঠেকিয়ে চুপ করে বসে থাকল। হঠাৎ রিদিমার গলা পেয়ে মুখ তুলে তাকাল।
     "বিকাশদা, কাকিমা চা খেতে ডাকছে...” সে উঠতে যাবে অশ্রু রিদিমাকে বলল, "তুই যা আমরা আসছি।”
     অশ্রু বিকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। এক মুখ অভিমান নিয়ে বলল, "তুমি আমাকে এতদিনে এই চিনলে?” আরো কি বলতে যাচ্ছিল। পারল না। বিকাশ অপরাধীর মত বসে রইল খানিক। তারপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, "বেশ, বেশ। তাই হোক। তুমি যেও না। আমি মরে যাব। এটা বলতে খুব স্বার্থপরের মত লাগে। তবু আজ বলছি অশ্রু, কারণ...."

     বিকাশের গলা বুজে এলো। অশ্রু ওর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে বিকাশের ডানহাতের কড়ে আঙুলটা ছুঁয়ে থাকল।