বনবিবির মন্দিরের সামনে একটা বড় গুঁড়ি পড়ে। ঝড়ে গাছটা উল্টেছিল। সেই থেকে পড়ে। এখন ওর উপর বড়রা, ছোটোরা, মাঝে মাঝে বাড়ির মেয়েরা, বউরা এসে বসে।
গুঁড়িটার উপরে এসে বসল মনা আর বাচ্চু। বাচ্চুর হাতে একটা কেক। কাল রাতে গোসাবা থেকে বাবা এনেছে। আজ বড়দিন। কেক খেতে হয়।
মনার বাবা নেই। বাঘে খেয়েছে। ঠাকুর্দাকেও বাঘে খেয়েছে। মনা আর মনার মা এখন। ভাই ছিল। কি একটা জ্বরে মারা গেছে।
মনা বলল, যীশুর গল্প আমি পড়েছি। স্কুলে।
দুজনেই ক্লাস নাইনে পড়ে।
বাচ্চু বলল, আমিও দেখেছি, টিভিতে।
বনবিবির মন্দিরের সামনে রোদ এসে পড়েছে। একটা কুকুর তার বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। বাচ্চাগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়ে মায়ের কোলের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে।
মনার হাতে এক টুকরো কেক দিয়ে বাচ্চু বলল, বনবিবি আর যীশু, কে বড় বল তো?
মনা বলল, জানি না। চার্চে গেছিস?
বাচ্চু বলল, না, মা বলে যেতে হবে না।
মনা বলল, হুম। একটু চুপ করে থেকে বলল, কুকুরের বাচ্চাগুলোকে কেক দিবি?
বাচ্চুর কথাটা শুনেই প্রথমে রাগ হল। এইটুকু তো কেক। রোজ রোজ তো বাবা আনে না। তার থেকে ওই কুকুরগুলোকে দিলে থাকবে কতটুকু? কিন্তু মনাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে না। ভীষণ গরীব ওরা। তাদের থেকেও গরীব। মা মাঝে মাঝে এটা সেটা পাঠায়। বাবা পছন্দ করে না। মা লুকিয়ে পাঠায়।
বাচ্চু একটা বড় টুকরো মুখে পুরে বলল, চ…এইটা দিই।
বাচ্চুর হাতে একটা ছোটো কেকের টুকরো।
মনা বুঝল। সে নিজের হাতেরটা অল্প একটু ভেঙে মুখে পুরে বলল, চল এইটা দিয়ে দিই। আমরা তো বড় হয়ে অনেক কেক খেতে পারব। কিন্তু এরা আর কোনোদিনই হয় তো পাবে না বল…. বন্যায় ভেসে যাবে, কি বাঘের পেটে যাবে….
বাচ্চুর নিজেকে অপরাধী লাগল এইবার। কাজটা উচিৎ হল না। কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই তো লোভী সে। কিন্তু কার কাছে ক্ষমা চাইবে, যীশু, না বনবিবি?
বাচ্চু মনে মনে বনবিবির কাছে ক্ষমা চাইল। দক্ষিণরায়কে বলল, সরি।
ততক্ষণে মনাকে ঘিরে ধরেছে কুকুরের চারটে বাচ্চা। তিনটে লাল রঙের। একটা কালো। মনা একটু একটু ভেঙে ভেঙে কেকের টুকরো ওদের সামনে হাতে রাখছে। ওরা খাচ্ছে। ওদের মা রোদে বসে বসেই লেজ নাড়ছে। আসছে না। সব মায়েরাই কি অদ্ভুত। বাচ্চুর মনার মায়ের মুখটা মনে পড়ল। কত খারাপ কথা বলে বাবা ওর মাকে। তবু আসে। মনার জন্যেই আসে। বাচ্চু সব বোঝে।
বাচ্চু ওর হাতের টুকরোটা ওর মায়ের কাছে নিয়ে গেল। হাতে করে খাওয়ালো। মা কুকুরটা বাচ্চুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। চোখেই বলল। মায়েদের চোখগুলো একরকম হয়। মনার মায়ের চোখের চাহনিটাও এমনই। বিশেষ করে যখন ও বাটিতে করে খাবার নিয়ে ওদের বাড়ি গিয়ে মনার মায়ের হাতে দেয়।
মনা পা ছড়িয়ে বসে। ওর ফ্রকের উপর কুকুরের বাচ্চাগুলো গুটিসুটি মেরে শুয়ে। বাচ্চু বনবিবির মন্দিরের চাতালে এসে বসল। পায়ে রোদ পড়ছে। আরাম লাগছে। মনা চোখ বুজে আকাশের দিকে মুখ করে। ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছে। ও নাকি বাবার কথা শুনতে পায়। দক্ষিণারায় বলেছে, ওর বাবা ভালো আছে। বাঘের কামড়ের ঘা শুকিয়ে গেছে। ওখানে রোজ মধু পাড়ে। বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। টাকা জমায়। ওখানে যখন মনা আর ওর মা যাবে, কোনো অসুবিধা হবে না। ওখানে বাঘ নেই।
বাচ্চুর এসব বিশ্বাস হয় না। আবার হয়ও। মনা যখন বলে বিশ্বাস হয়। বাড়ি গিয়ে একা একা যখন থাকে বিশ্বাস হয় না। বাচ্চুর পিসির কথা মনে পড়ছে। ওই ঝোপের ওদিকে যে মাঠ, ওখানেই খুন করে ফেলে গিয়েছিল পিসিকে। পিসির নাকি পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল। মা দিদুকে বলছিল ফোনে। বাচ্চু ঘুমানোর ভান করে শুয়ে শুয়ে শুনছিল। পিসির বিয়ে হয়নি, সারা গায়ে শ্বেতী ছিল পিসির। বাচ্চু জানত বাঘের আঁচড়। পিসিই গল্প করত। বাঘে নাকি আঁচড় দিয়ে দিয়ে সাদা দাগ করে দিয়েছিল। ওর বাড়ির লোকেরাই নাকি খুন করিয়েছিল। কি করে পেটে বাচ্চা চলে আসে এখন জানে বাচ্চু। মোবাইলে দেখেছে। হরেন কাকা দেখিয়েছে। দেখাতে দেখাতে খারাপ কাজ করছিল। বাচ্চুকেও বলছিল করতে। বাচ্চু আর যায় না হরেন কাকার বাড়ি। বাজে লোক।
মনা বলল, এই… কি ভাবছিস… চল….
বাচ্চু মনাকে খেয়াল করেনি এতক্ষণ। চারপাশটা হঠাৎ চোখ খুলে তাকাতে কেমন অন্যরকম লাগছে। বাচ্চাগুলো মায়ের দুধ খাচ্ছে। মনা তার সামনে দাঁড়িয়ে। মনার ছায়াটা মাঠের উপর পড়েছে। কি লম্বা লাগছে মনাকে।
বাচ্চু হঠাৎ বলল, তুই কিন্তু হরেনকাকার দোকানে একা যাবি না…..
মনা বলল, কেন?
বাচ্চু হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, যাবি না বলেছি যখন যাবি না… ব্যস….
মনা বাচ্চুর দিকে তাকালো। বাচ্চুর মুখের উপর রোদ এসে পড়েছে। বাচ্চুর পিছনে মন্দিরে বনবিবি আর দক্ষিণারায়ের দিকে তাকালো। দক্ষিণারায় বলল, যাস না।
বাচ্চু আর মনা ফিরছে। বাচ্চুর দাঁতের ফাঁকে এখনও এক টুকরো কেকের সঙ্গে থাকা মোরোব্বার টুকরো লেগে। বাচ্চু মাঝে মাঝে জিভ দিয়ে চাটছে। বাচ্চু মনাকে বলল, তুই বড় হয়ে কি হবি?
মনা বলল, দিদিমণি। তুই?
বাচ্চু বলল, পুলিশ।