- মায়ের নাম কি?
- বলতে নেই
এখনও মায়ের নাম বলতে দ্বিধা। অবচেতন খটকা। ঠিক হবে কি? এটা বিবেক না। এটা সংস্কার। কুসংস্কার না। ভুল সংস্কার। কারণ বাবা প্রধান। মা দ্বিতীয় অভিভাবক। মায়ের নামে আবার কিসের পরিচয়? বাড়ির নেমপ্লেটে দেখেছি বাবার নাম, তারপর তাদের কৃতী সন্তানদের নাম। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। সে ইদানীং চোখে পড়ে টুকটাক। কিন্তু মায়ের নাম নেই। যদি তিনি তথাকথিত শুধুমাত্র গৃহবধূ হন তবে তো আরো সে নাম থাকার প্রশ্নই আসছে না।
সেই বিন্দুর ছেলে গল্পটা মনে আছে। সেখানে বাচ্চাটাকে কি শেখানো হয়েছিল? সে তার মায়ের কাছে গেলেই সেই মা, তার প্রাণপ্রিয় মা মারা যাবে। আসলে যদিও সে কাকিমা। কিন্তু গল্পে সে-ই মা। আসল মা তো দিদি। সেই মায়ের কাছে গেলেই মারা যাবে। এ কুশিক্ষা না, ভুল শিক্ষা।
আমিও ছোটোবেলায় শিখেছি মায়ের নাম বলতে নেই। বললে মা মারা যাবেন বা অসুস্থ হবেন। ভয়ে বলিনি কোনোদিন। ভাবটা এমন আমার আর বাবার মধ্যে মা যেন শুধু একটা মাধ্যম। তার বিশেষ কি পরিচয় থাকতে পারে, আর তা জেনে কাজই বা কি সমাজের? আজ টাইমস অব ইণ্ডিয়া'র এডিটোরিয়ালে এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে একটা চমৎকার শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছে - change this.
'লিপস্টিক আণ্ডার মাই বোরখা' সিনেমায় রত্না পাঠক যেমন ভুলেই গিয়েছিলেন ওর নাম উষা। তার অস্তিত্ব 'বুয়াজি' নামের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল। আর সে বলে চাপা পড়া?! এমন চাপা পড়ল যে নিজেই যেন ভুলে গিয়েছিলেন তার আসল নাম কি? একদিন ঘটনাক্রমে একজন যখন তাকে তার নিজের নামে ডাকলেন, তিনি সাড়া দিতেই ভুলে গেলেন। এই নাম তার?
কি সুক্ষ্মভাবে, কি অজ্ঞাতে আমাদের ভিতরে এই সংস্কারগুলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে গড়িয়ে যায়। নিঃশব্দে চলে যায়। তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর নাম উচ্চারণ করা যায়, মায়ের নাম উচ্চারণ করা যায় না। কি লজ্জার! কারণটাও কত চাতুরীর সঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, নাম বললেই ঘটে যাবে অঘটন। মানুষটার নামের মান না থাক, তার অস্তিত্বের সুবিধা তো অনেক!
মায়ের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ কিছু নয়, এই বোধটা সত্যিই তৈরি হওয়া দরকার। আমাদের অজ্ঞাতে এ ভয়, এ সংকোচ অনেক দূর অবধি চারিয়ে আছে। মা কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকুন বা না থাকুন, তার নামটা বাবার নামের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই উচ্চারিত হোক। এই স্বাভাবিক প্রথা হয়ে উঠুক পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
যখন আমার একটা বই বার করল আমার বন্ধুরা পরম উৎসাহে, সেদিন সেই বইয়ের উৎসর্গীকৃত নাম হল আমার মায়ের নাম - শান্তা ভট্টাচার্য।