মানিয়ে তো নিতেই হবে। চ্যালেঞ্জটা হল নিজস্বতাকে হারাতে দেওয়া যাবে না। সেকি সম্ভব? নিজেকে না বদলে বদলকে মেনে নেওয়া যায়?
দর্জির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবছিল জনাই। তার ছিটটা আস্ত জামা হয়ে গেল। অথচ তার জীবনটা… নাহ্, ভালো দর্জি সে হতে পারল না। এখন আশা ছেলেটাকে নিয়ে। স্বপ্ন। ছেলেটা অঙ্ক করতে এসেছে। ক্লাস নাইনে পড়ে। রাত দশটায় ছাড়বেন স্যার। অর্ধেক মাইনে নেন।
নিজের টোটোটার দিকে তাকালো। মানুষ কত কি বানায়! লোহা পিটে, টিন পিটে, কাপড় কেটে। সামনের বড় বড় ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকালো। সিমেন্ট, ইট দিয়েই তো বানিয়েছে। মানুষের মাথায় কত কি ভাবনা! অথচ জীবনটা যেমন চায় বানাতে পারে না। কেন?
দোকানে টিভি চলছে। কত হিংসা, মারামারি, চালাকি। জনাই শার্টটা নিয়ে, টাকাটা দিয়ে টোটোতে এসে বসল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ন'টা চল্লিশ। দেরি আছে।
সব কই মেনে নিতে পেরেছে? ভাইরা ঠকিয়ে জমিটা নিল। বউটা ফেসবুকে রাত জেগে কাদের সঙ্গে গল্প করে। মেয়েটা, সিক্সে পড়ে, কিন্তু সারাদিন যা বলে, কি সব ভাষা! এ সব মেনে নিতে নিতে নিজেকে কেমন যেন ঘুমিয়ে আছে মনে হয়। কিন্তু বলবে কাকে? সবাই তাকে বুঝিয়ে দেয় সে-ই ভুল, বাকিরা সবাই ঠিক। ছেলেটাই যা একটু বোঝে। কিন্তু ছেলেটাকে নিয়েই তো ভয়। পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু চালাক চতুর নয়। তার মত হয়েছে।
"বাবা, কাল তোমায় স্যার টোটোটা নিয়ে সকালবেলা আসতে বলেছেন। স্যারের বউ আর মা মন্দিরে যাবেন।" ছেলে টোটোতে তার পাশে বসে বলল।
মানে সারাটা সকাল ভাড়া নেওয়া যাবে না। ভাড়াও নিতে পারবে না। ছেলেকে অর্ধেক টাকায় পড়ান। ভালো মানুষরা কেমন বাস্তব মানুষ হয়।
মন্দিরের সামনে টোটো নিয়ে বসে। ভীষণ গরম। ভ্যাপসা। বৃষ্টি নেই। মেঘ আছে।
মেয়ে স্কুলের ড্রেস পরে একটা ছেলের বাইকে বসে চলে গেল। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠে মিলিয়ে গেল। বুকের মধ্যে চোরাবালি একটা। সব ডুবে যায়। বউয়ের ফোনে ফোন করলেই এখন ব্যস্ত বলবে। বউ কল ব্যাক করবে না। সবাই জানে, জনাই ভালো মানুষ। বোকা মানুষ।
কিন্তু বোকা মানুষ তো সে থাকতে চায় না। মেয়েটাকে চড় মারতে চায়। বউকে যা নয় তাই বলতে চায়। ঝগড়া করতে গেলেই সে আর ভাষা পায় না। যতটা রাগ হয়, দুঃখ আর ভয় হয় তার চাইতে বেশি। কথা হারিয়ে যায়। সব হারিয়ে যায়।
একদিন মারল চড়। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। হাতটা লঙ্কাবাটার মত জ্বলে উঠল। মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতে পারল না। কানে একটা খিস্তি এলো। মেয়ের না, মায়ের।
প্রায় এক সপ্তাহ মেয়েটার দিকে তাকায়নি। টোটোর হাতল ধরতে জ্বালা করত।
একদিন বউয়ের মোবাইলও ঘেঁটেছিল। হোয়াটস অ্যাপে গিয়ে অবাক হয়েছিল। তার বউয়ের অনাবৃত স্তনের ছবি। তার ছোটো ভাইয়ের নাম্বারে পাঠানো। বুকের ভিতর একটা ভয় শ্রাবণের মেঘের মত কালো করে এসেছিল। একবার মনে হয়েছিল ভাইয়ের, বউয়ের পা ধরে কাঁদে। বলে তারা যেন এরকম না করে তার সঙ্গে। পারেনি। মানুষকে ঠকানো অত সোজা না। সে পারে না। সে বোকা। তার ঠকালে ঘুম হয় না। বুকের মধ্যে চামচিকে ডানা ঝাপটায়। কিন্তু তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়। কি অনায়াসে তার পাশে শোয়! দরকার পড়লে আদর করে। আদর নেয়। আবার ভাইয়ের সঙ্গেও… কি করে? এত সহজে শরীরের ভাষা বদলে বদলে ভালোবাসা দেওয়া যায়? নেওয়া যায়? যায় হয় তো।
এরপর শুরু হল রাতদিন স্বপ্ন দেখা। জনাই স্বপ্ন দেখে তার মেয়েকে কারা যেন ধর্ষণ করে পুকুরে মেরে ফেলে গেছে। তার বাড়ির উঠানে তার ভাই আর তার বউ সঙ্গম করছে। পাড়ার লোকেরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। জনাইকে বলছে, জনাই তুমি মরো… মরো...
========
জনাই মরল না। কিন্তু সব স্বপ্নগুলো একদিন মাথার মধ্যে তুবড়ির মত ফেটে গেলো। ডাক্তার বলল আর কোনোদিন সে নড়তে চড়তে পারবে না। কথা বলতে পারবে না।
আঠারো বছর গড়িয়ে গেল। জনাই সারাদিন ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে। ভাই তার বউকে নিয়ে সংসার পেতেছে। মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। ছেলেটা কলকাতায় চাকরি করে। আলাদা থাকে।
জনাই দেখে শুধু ঝুল চারদিকে। সেই ঝুলে ভগবান আর বোকা লোকগুলো আটকে। যত ছাড়াতে যাচ্ছে তত জড়িয়ে যাচ্ছে।
"মামা কেমন আছ?"
সুতপা। তার ভাগ্নী। সে-ই একমাত্র সংসারে যে তার ভাষা বোঝে। জনাই জড়িয়ে উচ্চারণ করল, বিষ…
গোটা সংসারে এখন বিষের চাইতে দামী তার কাছে কিছু নেই। যখন হাত-পা নাড়িয়ে চলতে পারত, তখন কেন যে বিষ নিজে নিয়ে খেল না! আসলেই বোকা তো সে। এখন কে এনে দেবে হাতে করে বিষ?
ভাগ্নী বালিশের ভাঁজে টাকা গুঁজে দিয়ে যায়। যাওয়ার সময় কাঁদে। বোকা মেয়ে বলেই কাঁদে। জনাইয়ের চোখের কোল বেয়ে জল গড়ায়। ভাগ্নী বলে, কি পাপ যে করেছিলে মামা!
পাপ? পাপ কেন হবে রে? বোকা ছিল। আছেও। বোকামি মানেই পাপ। আজ আর ইচ্ছা করে না ওসব ভাবতে। ঝুল জড়ানো চোখে, ঝুল জড়ানো মাথায় নিজের বুকের কোনায় কোনায় টিপে টিপে দেখে। এখনও উইপোকার মত ভালোবাসা কিলবিল করছে। ঘরে যখন কেউ থাকে না, তখন তার শরীর থেকে নেমে বেড়ায়। তার কাছে কেউ আসে না। সারা শরীরে শুয়ে শুয়ে ঘা। দুর্গন্ধ ছাড়ে। লোকে নাকে কাপড় দিয়ে দেখতে আসে। একবেলা খায়। খাইয়ে দেয় কেউ কেউ। আবার দেয়ও না। দুর্গাপুজোর সময় দু'দিন তার কথা মনেই পড়েনি। জনাই উইপোকাদের হাঁটা দেখেছে। নিজেকে বলেছে, আর কত খাবি রে শুয়ে শুয়ে?
ভাগ্নীকে বলেছে, ডাক… আমাকে তুলে নিতে বল উপরে..
চিতায় আগুন জ্বালানো হল যখন জনাই তখন পাশেই দাঁড়িয়ে, একটা ঘেয়ো কুকুরের পাশে। কুকুরটা তার সদ্য শরীর ছাড়া শরীরটাকে চাটছে। জনাই দেখছে উইপোকার দল শরীর থেকে বেরিয়ে তার দিকে উড়ে উড়ে আসছে। জনাই দৌড় লাগালো। পারল না। ঝুলে আটকে হোঁচট খেলো। সে আর উইপোকা চায় না। সে আর ভালোবাসা চায় না। সে চায় তার হৃদয়টা রাস্তার মত হোক। সবাই যাক। কিন্তু সে যেন কোথাও না যায়। কাউকে না চায়। কাউকে না ডাকে। কাউকে না যেতে বলে। রাস্তা কাউকে মনে রাখে না। রাস্তাকেও কেউ মনে রাখে না পেরিয়ে গেলে। সে-ই ভালো। জনাইকে নিজেকে বলে, সেই ভালো।
ভাগ্নীটার মাথায় হাত রাখল। মেয়েটা কাঁদছে। স্বস্তির কান্না। ভালোবাসার মানুষের দুর্ভোগ শেষ হলে স্বস্তির কান্না আসে। তার ছেলে আসেনি। সময় পায়নি। তার গ্রামের জলে পেট খারাপ হয়। তার ছেলেরও হয়।
জনাই উইপোকার ঢিবি হয়ে পুকুরধারে থেকে গেলো। উইপোকাগুলো মাটি চিবিয়ে চিবিয়ে পৃথিবীর বুকের কাছে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকের কাছে নাকি এখনও ভালোবাসার স্তন্যধারা বয়। তাই নাকি সূর্যের আলো আজও পৃথিবীকে ছেড়ে যায়নি। ভগবান বলে গেল তাকে, একটা কাক হয়ে।