সৌরভ ভট্টাচার্য
25 May 2020
লকডাউন। ধানক্ষেতের পাশে রাস্তা। রাস্তার উপরে মাচা। মাচার মাথায় ছাউনি। একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা ছেলে, কপালে কাজলের দাগ, লাল প্যান্ট পরে বাবার সাথে বসে। আশেপাশে কয়েকজন মানুষ। সবাই পুরুষ। মাচায় আর কেন মহিলা বসবেন। বাচ্চাটা একটা গ্লাস নিয়ে খেলছে। বাকি পুরুষেরা গল্প করছে। একজন যুবক তার প্রেমের গল্প করছে। তার প্রেমিকা তাকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ব্লক করে রেখেছে - এই হল গল্পের বিষয়। একজন ধুতি পরা প্রৌঢ় মানুষ আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে গল্প শুনছেন।
হঠাৎ সাইকেলের আওয়াজ শুনে চোখ মেললেন, কে যাস রে...? গোবিন্দ... আমায় একটু জল খাওয়া না রে বাবা....
গোবিন্দ কুড়ি-বাইশের রোগা ছেলে একটা। খালি গা, একটা সাদা পায়জামা পরে সাইকেল নিয়ে মাচার দিকে এগিয়ে গেল। প্রৌঢ় মানুষটার বাড়িয়ে দেওয়া জলের ফাঁকা বোতলটা সাইকেলের সামনে ঝোলানো ব্যাগে আরো বোতলগুলোর সাথে নিয়ে নিল।
আবার গল্প শুরু হল। প্রেমিকার গোঁসায় যে প্রেমিকের কিছুই আসে যায় না সেই কথা প্রেমিক খুব গর্বের সাথে বলছে। এক-একবার ধানক্ষেতের দিকে তাকাচ্ছে। ডুবন্ত সূর্য দু'দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে জমে যাওয়া জলের উপর প্রতিবিম্ব ভাসিয়ে বসে, যেন ছিপ ফেলেছে। একটা বক লম্বা লম্বা পা ফেলে সূর্যের প্রতিবিম্ব মাড়িয়ে ঠোঁটটাকে জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাবার খুঁজছে।
বাচ্চাটা বাবার কোলের উপর চড়ে বলল, বাবা বায়ি...। তার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছাটাকে বাবারূপী মানুষটা কোনো গুরুত্ব না দিয়ে গল্প শুনতে মশগুল। বাচ্চাটা আবার বলল, বাবা হিসি....
বাবার মুখে বিরক্তি। বাচ্চাটাকে বাঁ-হাতে মাচা থেকে নামিয়ে বলল, করে নে। আবার গল্পে ঢুকে গেল বাবা। প্রেমিকার আগের গোঁসার গল্প চলছে। প্রৌঢ় মানুষটা রাস্তার দিকে তাকালো দু'বার চোখ খুলে। জল এলো?
বাচ্চাটা বাবাকে নীচ থেকে দু'বার বলল, উই বক... বক...
বাবার কানে গেল না কথাটা। বাবা তাকালোও না। বাচ্চাটা উঁচু জমি থেকে নেমে আল ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। তার মস্ত ছায়া কাটা ধানের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। খালি পা। ভিজে মাটি পায়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে বকেরা দাঁড়িয়ে। উই বক, উই... উই...
কিছুটা দূরে ধান ঝাড়ছে চার-পাঁচজন। একজন বাচ্চাটাকে দেখে বলল, রমেশের বাচ্চা না?
পাশ থেকে আরেকজন ঝাড়া ধান জড়ো করতে করতে একবার মাথা তুলে দেখে বলল, তাই তো.....
বাচ্চাটা বকের দিকে এগোচ্ছে। বক উড়ে গিয়ে আবার দূরে বসছে। বাচ্চাটার নাগালে নেই।
বাচ্চাটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আলের উপর। ওদিকে ধান ঝাড়ার আওয়াজ। সামনে বকেরা। দূরে বাবা আলের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে।
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, এদ্দূর চলে এসেছিস...!!!
হ্যাঁ গো রমেশদা, কাজ শুরু হয়নি এখনও?....
বাচ্চাটাকে কাঁধের উপর বসিয়ে আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাথা নাড়ল রমেশ। হয়নি শুরু কাজ। ওই মাচার উপরে যারা বসে তাদের কারোরই শুরু হয়নি। প্রৌঢ় মানুষটার ডায়ালেসিস বাকি অনেকগুলো।
গোবিন্দ জল ভরে দিয়ে গেছে। বাচ্চাটা মাচার উপর বসে আবার বলল, বাবা বক....
রমেশ তার পায়ের তলায় লেগে থাকা মাটি দেখে বলল, একি করেছিস!... চ... চ....
প্রৌঢ় মানুষটা জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, এই তে ধুয়ে নে... কলের ওখানে যাস না... গতকাল একটা গোখরো দেখেছিলাম....
বাচ্চাটার পা ধুয়ে রমেশ চুপ করে বসে। বাকি পুরুষেরাও চুপ। আর কত গল্প বানাবে? আর কতদিনের অপেক্ষা? মারণ রোগ তো এই আজকের। খিদে তো সেই প্রাচীন রোগ। সবাই ধান ঝাড়ার আওয়াজ শুনছে। পাখিদের ঘরে ফেরার আওয়াজ ছাপিয়ে আওয়াজ আসছে, ঝপাৎ.... ঝপাৎ....
সূর্য অস্ত গেল। সবার ঘরে ফেরার সময়। কিন্তু ঘরে ফেরার ভয়। বাচ্চাটা কোলের উপর ঘুমিয়ে। ঘুম ভাঙাতে ভয়। মাচার উপর কয়েকজন নিঃশব্দ মানুষ। গল্প খুঁজছে। আকাশে তারারা চাদর বিছিয়ে বসে। চারদিকে অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে। প্রৌঢ় ঘুমিয়ে। নাক ডাকছে। মৃত্যু বড় কাছাকাছি যেন। কারোর মনে হচ্ছে কলপাড়ে। কারোর মনে হচ্ছে মাঠে আলের উপর। কারোর মনে হচ্ছে গঙ্গা পেরিয়ে আসছে যেন। কে হবে শিকার তাদের মধ্যে প্রথম? গল্প খুঁজছে সবাই আবার। আরব্য রজনী'র মত অফুরান গল্প। ভালোবাসার গল্প, চোর-ডাকাতের গল্প, ঝড়ের গল্প, বন্যার গল্প, যুদ্ধের গল্প। গল্পে যেন মৃত্যু না থাকে। লড়াই থাক। ভরা পেট খাবারের অনুভব থাক।
বাচ্চাটা ঘুমের মধ্যে কয়েকবার বলে উঠল, বাবা... বক... বক... স্বপ্নেও বকগুলো যেন সরে সরে যাচ্ছে... বাবা মাথার উপর হাত রেখে... বাবা যেন আল ধরে ছুটে আসছে... নাকি আসতে আসতে হারিয়ে যাচ্ছে... বাচ্চাটা ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে উঠল... বাবা মাথার উপর থাবড়িয়ে বলল, ঘুমা... ঘুমা.....