ক্ষমা পরম তপস্যা।
বুদ্ধ বললেন। তপস্যা বললেন। চেষ্টা বললেন না।
উপনিষদ বললেন, তর্ক, মেধা দ্বারা পাওয়া যায় না। বাক্য মন দ্বারাও না। সে সবের অতীত সে বস্তু।
কি?
বুদ্ধ বললেন, মৈত্রী।
উপনিষদ বললেন, ব্রহ্ম।
আমার চোখ আজ মাইলের পর মাইলের পর দেখতে পায়। বিজ্ঞান সে ব্যবস্থা করেছে।
আমার কান আজ শতাব্দী প্রাচীন স্বর শুনতে পায়। ক্ষীণতম ধ্বনিকে কর্ণগোচর করতে পারে। বিজ্ঞান সহজ করে দিয়েছে।
আমার বুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষতম তর্ক, বিশ্লেষণ, পরিমাপ, এমনকি ভবিষ্যৎ কথন পর্যন্ত করতে পারে। আমার বিজ্ঞান আমাকে এতটা ক্ষমতাশালী করেছে।
তবু কেউ বলতে পারছে না, এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে! সেদিনের পাথরের উপর নাকি অশোক নিজের অনুতাপের কথা লিখেছিলেন। আমি পড়েছি পণ্ডিতদের বইতে। তাদের মেধার সুক্ষ্ম ধারালো জ্ঞানের আলোকে জেনেছি সে কথা।
তবু কেউ বলতে পারে না, কে কখন কোথায় খুন হবে, ধর্ষিত হবে, লাঞ্ছিত হবে, নিপীড়িত হবে, শোষিত হবে।
আমার শ্রবণ, দর্শন আর মেধার ক্ষমতা আজ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে এক লহমায়। হচ্ছে তো! কিন্তু আমার চিত্ত? সে ঝাঁ চকচকে শপিংমলের পাশে বসে থাকা ভিখারির মত, উন্মাদের মত এদিকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রবণের তপস্যা আছে, দর্শনের তপস্যা আছে, সুক্ষ্ম জ্ঞান-তর্ক-গবেষণার তপস্যা আছে। সে তপস্যার ফলও পাওয়া যায় হাতেনাতে। টাটকা। কত নাম, কত পুরষ্কার, কত প্রচার, কত হাততালি তার জন্য। কিন্তু চিত্তের তপস্যা? দীনহীনের মত কাঙাল সে। বিকৃত সুখের বাসা হচ্ছে দিনদিন। যেমন হয় ভাঙা বাসায় চামচিকের থান, দুর্বল শরীরে যেমন জীবাণুর পোয়াবারো!
বুদ্ধ বলেছিলেন। মহাপুরুষ হবেন বলে বলতে চাননি। কিছু অনুভব করেছিলেন বলেই বলেছিলেন। মৈত্রীতে স্থির হও। যে দুর্বল, যে সবল, যে ভীত, যে সাহসী, যে বৃহৎ, যে ক্ষুদ্র, যাকে দেখা যায়, যাকে দেখা যায় না, যে জন্মেছে, যে ভবিষ্যতে জন্মাবে - ইচ্ছা করো সবাই সুখী হোক, সবাই ভয়হীন হোক। ক্রোধে বা বদ-ইচ্ছায় কারোর অমঙ্গল চেও না। এই কথা দাঁড়াতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে রেখো।
তুলসীদাস বলছেন, পরহিত যার মনে বাস করে, ত্রিজগতের সব সুখ তার। কবীর বলছেন, প্রেম, এই আড়াইখানা শব্দই তো সার। প্রেম মানে মৈত্রী। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, প্রার্থনা করো যেন পোকাটারও নিন্দা না করি। মা সারদা বলছেন, শান্তি চাও তো দোষ খুঁজে বেড়িও না। কাঁদছেন, প্রার্থনা করছেন, হে ঈশ্বর আমার চোখে যেন কারোর দোষ না পড়ে। মা সারদা প্রার্থনা করছেন। কাঁদতে কাঁদতে। স্বার্থের জন্য নয়। পরমার্থের জন্য। যখন পরমার্থ মানে মনুষ্যত্বের মহিমাকে খোঁজার তাগিদ। তাকে জন্ম দুরাচারী ব্যাখ্যা করে বিকারের উল্লাস নয়। সবাই বলছেন এ কথা। প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি সব আলোকপ্রাপ্ত মানুষ বলছেন এক কথা। মানুষ মানে কিছু বিকারের সমষ্টি নয়। তার মনুষ্যত্ব আছে। আছেই।
তাকে পাওয়া যায় কি করে? তর্কের দ্বারা না, পাণ্ডিত্যের দ্বারা না, মেধার দ্বারা না, মন-বুদ্ধি-বাক্যের দ্বারা না। কেবলমাত্র চিত্তের প্রসারের মাধ্যমে। অনুভবকে শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে। শুদ্ধিকরণের উপায় কি? বুদ্ধ বলছেন, বৈরিতা ছাড়ো। অমঙ্গল চেও না। কারোর অমঙ্গল চেও না। শুরু করো নিজেকে দিয়ে। নিজের মঙ্গল চাও? তবে আজ থেকে কারোর অমঙ্গল চেও না।
এইটুকুই ধর্ম। বুদ্ধ বলছেন। এই তপস্যা। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে কি তুলে দিয়ে যাব? শুধুই মারণাস্ত্র আর একটা অসুস্থ পৃথিবী? কোন চালাকি, কোন কূটনীতি বাঁচাবে শেষমেশ আমাদের?
বৈরিতা নাশ হওয়াই ধর্ম। বাকি সব শুধুই ছেলেখেলা। পাগলামি। নেশা। আর অহমের ভড়ং।