সৌরভ ভট্টাচার্য
30 March 2020
উন্নতি যে হচ্ছে না তা নয়, ভালোই হচ্ছে। শুরুর দিকে এঁটো বাসনকোসনগুলো যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, এখন থাকছে না। ওরা আমি সিঙ্কের কাছে দাঁড়ালেই একটু নার্ভাস হয়ে আমার দিকে তাকাতো, নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে বলত, ওই যে মূর্তিমান আবার এসে গেছেন!
কিন্তু এই ক'দিনে ওদের সাথে আমার একটা সুন্দর বোঝাপড়া হতে শুরু করেছে। আমরা একে অন্যের উপর ভরসা করতে শিখছি। এবং এই কাজে যে দ্রুততা জন্মেছে তাতে বেশ কিছুটা গর্বও যে অনুভব করছি না, তাও নয়।
আমার একটি আকাঙ্ক্ষার কথা আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানেন। আজ বেশ ভালোভাবেই জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। ছোটো থেকে আমার একটা শখ ছিল কাজের লোক হব। বেশ সক্কালবেলা কয়েক বাড়ি বাসনকোসন মেজে দেব, ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে দেব, ওরাই জলখাবারটা দিয়ে দেবে, তারপর দুপুরের খাওয়ারটাও কোনো একটা বাড়ি থেকে দিয়ে দেবে, সেটা বাড়িতে নিয়ে এসে খেয়ে সারা দুপুর বই পড়ব। সন্ধ্যেতেও পড়ব। রাতেও পড়ব। রাঁধব না, বাজার থেকে দুটো রুটি নিয়ে আসব, আর ঘরে মজুত থাকবে চিনি নয় গুড়, তাই দিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ব বই নিয়ে, বই পড়তে পড়তে অনেক রাত হবে, ঘুমিয়ে পড়ব।
স্কুলের ছুটির সময় কত গ্রীষ্মের দুপুর আমার এই দিবাস্বপ্নে কেটেছে। এতে কতকগুলো সুবিধা আছে। এক, কাজের চাপ থাকলেও বিশাল কিছু মাথা খাটাতে হবে না, অগত্যা আমার মাথাটা বইতে ডুবিয়ে রাখা যাবে, আর যেহেতু সমাজে এটা খুব একটা গরিমার কাজ বলে কেউ দেখে না, তাই যা হোক একটা জামাকাপড় পরলেই হল, আর যেহেতু আমি সমাজে এলেবেলে তাই আমার সাথে কথা বলতেও লোকে তেমন চাইবে না। অগত্যা পুরো সময়টা আমি বই পড়েই কাটাবো। লোকে যা মাইনে দেবে তাতে চলার মত টাকাটা রেখে শুধু বই কিনব আর পড়ব। এমনকি পুজো এলে বলব, আমায় জামাকাপড় দিতে হবেনি কো, টাকা দিও, বই কিনব। কেমন একটা নিরহঙ্কার, পাঠমগ্ন জীবন হত, না? কেন যে অহংকার ত্যাগ করতে লোকে অত বড় বড় বাবাজী, সাধু ইত্যাদি সেজে বসে থাকে কে জানে, ওতে কি অহং ত্যাগ হয়? ওতে তো আরো বেড়ে যায়! তার চাইতে এইটে অনেক ভালো না? সমাজ জানবেই না তুমি কখন ছিলে আর কখন ছিলে না! তোমায় শপিংমলে দেখা যায় না, বড় বড় ধর্মসভায় দেখা যায় না, শুধুমাত্র একটা হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে কখন এ বাড়ি সে বাড়ি সামলে ভদ্রপাড়া পেরিয়ে চলে গেলে কেউ খেয়ালই রাখল না। এতে ঈশ্বর রাজি হয় না? শুনেছি তিনি তো নাকি দীনবন্ধু, নয় কি?
তো সে যাক, আমার যে ক্ষিপ্রতার সাথে বাসন মাজার স্পিড বাড়ছে, সে রীতিমত প্রশংসার যোগ্য। এর মধ্যে অবশ্য একটা অন্যরকম কিছুও আছে। যেমন ধরুন আমার বাবা, তিনি অসুস্থ মানুষ, হাঁটাচলা বেশি করা বারণ। এখন তাঁকে দেখাশোনা করার মানুষটিও ট্রেন বন্ধের কারণে আসতে পারছেন না। আমি বাবার এঁটো বাসন তুলতে যেতেই দেখি বাবা ইতস্তত করছেন, বললাম, কি হল? বাবা একটু অপ্রস্তুত অপরাধীর মত হেসে বললেন, তুই মাছ খাস না, মাছের গন্ধও সহ্য করতে পারিস না...
আমি বললাম, আরে আমি জন্মদিনে ক’টা করে ফুস ফুস পাই জানো? ফুস ফুস মানে হল ডিও, বাবা ডিওডোরেন্টকে বলেন ফুস ফুস। বললাম, আমি তো সারাবছর ওগুলো মেখে কুল করতে পারি না, ওগুলো কাজে লেগে যাবে... ভেবো না...
কিন্তু ওগুলো হাতে দিবি...! ডান এঁটো হাতটা সামনে এনে দেখালেন।
বললাম, বেশ ডেটল তো আছে, ওই গন্ধটায় তিমি মাছের গন্ধও চলে যায়, আর এতো সামান্য রুই, ভেবো না, চলে যাবে।
ভাগ্যে বাবা জিজ্ঞাসা করেননি তিমির গন্ধ কেমন তুই জানলি কি করে? তবু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে বললাম, মায়ের সব কাজ করেছিলাম মনে নেই তোমার? তবে?
বাবা চোখটা নামিয়ে একটা আজব কথা বললেন, তোর মা ছিলেন মহীয়সী, কিন্তু আমি তো সাধারণ মানুষ রে...
হাসলাম। এর কি কোনো উত্তর হয়? বললাম, তা সেই মহীয়সীটি যদি সেখান থেকে দেখেন এই লকডাউনে তুমি হাঁটুর উপর লুঙ্গিটাকে জড়িয়ে, উবু হয়ে বসে এঁটো বাসন মাজছ, খুব কি আহ্লাদিত হবেন বলো?
এই পর্ব এখানেই শেষ হল। কিন্তু বাকি কাজগুলো নিজের মধ্যে এমন একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছে মনে হচ্ছে লকডাউনটা উঠলেই কয়েক বাড়ি গিয়ে প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলি। বলি শুধুমাত্র নারীরাই এই কাজে কেন একছত্র অধিকার নিয়ে থাকবে পুরুষকে বঞ্চিত করে? কতকাল আমরা এ সহ্য করব? আজকাল যদি নার্সও পুরুষ হচ্ছে তবে কাজের মেসোই বা হবে না কেন?
আসলে সব কাজই করা যায়। না জানলেও শিখে নেওয়াই যায়। মা একটা গল্প বলতেন মাঝে মাঝে। আমার দিদার একজন ননদ ছিলেন তখনকার দিনে বেশ উচ্চশিক্ষিতা। তা তার যখন বিয়ে হয়, এবং বিয়ের পরেরদিন যখন শ্বশুরবাড়ির কোনো একজন কেউ তাকে উঠানটা ঝাঁট দিয়ে দিতে বলেন, তিনি নাকি বলেছিলেন, আমি ঝাঁট দোবো কেন লো, আমি যে শিক্ষিত মেয়ে লো...
যদি বাড়ির কোনো টুকটাক কাজে আমি রাজি না হতাম, মা এই কথাটা বলে আমায় নিয়ে এমন মজা করতেন, বাধ্য হয়ে কাজে নামতেই হত। আসলে আদিখ্যেতাটা মা কোনোকালেই পছন্দ করতেন না, ভাগ্যে করতেন না। আজ যখন শুনি এটা করতে ওটা করতে নাকি অসুবিধা হচ্ছে এর তার, তখন বুঝি অসুবিধাটা অনভ্যাসের নয়, ভুল চিন্তার, ভুল মানসিকতার।
তবে কি এর মানে আমি সব পারি? কখনওই নয়। যেহেতু খাদ্যরসিক নই, তাই ডালসিদ্ধ, ভাত, ডিমসিদ্ধ, ম্যাগীর বেশি সেদিকে কোনো দক্ষতা নেই। ওই চালিয়ে নেওয়ার মতন। তবে এই সময়টাকে যদি অন্যরকমভাবে কাজে লাগানো যায়? আমার বাড়িতে আজ তেমন কেউ নেই, আমার অসুস্থ বাবা আর খুব সুস্থ নন জেঠিমা ছাড়া। শুরুর দিকে এতদিনের লকডাউন শুনে সত্যিই ভীষণ নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। কি করে সামলাবো, কেউ তো কাজে আসতে পারবে না... কি হবে? কিচ্ছু আকাশ ভেঙে মাথায় পড়েনি, সব ঠিক আছে। পড়াতে পারছি না, এটাই যা সমস্যা, সেটা ভীষণ সমস্যা। পড়ানো আমার প্রথম ভালোবাসা, বাকি সব তারপরে। কিন্তু সে না হয় হল। যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, যাদের বাড়িতে সবাই সুস্থ, মানুষজনও অনেক পরিবারে, সেখানে এই সুযোগটা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সেরে নেওয়ার একটা দুর্দান্ত সময় নয় কি? ঘর তো আমরা রোজ ঝাড়ি, মুছি। কিন্তু মহালয়ার আগে যে বিশেষ ঝাড়মোছ হয়, তখন কত কি বেরিয়ে পড়ে না? কিম্বা ঘর বদলের সময়? কত না খোলা কৌটো, না খোলা বাক্সের একদম তলায় চাপা পড়ে থাকা চিঠির গুচ্ছ, হয় তো উত্তর দেওয়ার ছিল দেওয়া হয়ে ওঠেনি, ময়লা পড়া ঝিনুক, না ব্যবহার করা শখ করে কেনা ছোটো হয়ে যাওয়া জামা, কারোর বুনে দেওয়া ফুটো হয়ে যাওয়া সোয়েটার...
এরকম আমাদের মনেরও অনেক কথা আছে, জমে আছে, অনাদরে, হেলায়। নিজের প্রতি অন্যের হেলার চাইতে নিজের হেলার মূল্য অনেক বেশি দিতে হয়। মাঝে মাঝে যারা প্রশ্ন করি নিজেকে, আচ্ছা আগের মত ভালোবাসতে পারি না কেন? আগের মত অনুভব করতে পারি না কেন? আগের মত কৌতুহল হয় না কেন এটাসেটা নিয়ে? এ সবই নিজের উপর নিজের অবহেলার লক্ষণ।
এই সময়টা সেই সময়, যে সময়ে দূরত্বগুলোকে কমিয়ে ফেলা যায়, বাড়ির কোন জানলা দিয়ে কোন সময়ে রোদ আসে জেনে নেওয়া যায়, কোন সময়ে কোন পাখি জানলায় এসে বসে, কোন সময়ে কুকারে ক'টা সিটি পড়ে, কোন সময়ে কল খোলা হয়, কোন সময়ে টিভির সামনে কে কোথায় বসে, কোন সময়ে কেউ উদাস হয়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়, কোন সময়ে কেউ ফোন নিয়ে আড়াল খোঁজে, কোন সময়ে কেউ গুনগুন করে গান গায়, গান বদলায় --- সব জেনে নেওয়া যায়।
এই সময়টায় তাই শুধু লকডাউন হয় না, লক ওপেনও হয়... 'আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে ভিতর দুয়ার খোলা'। সদর দরজায় তালা লেগেছে, কিন্তু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার দরজায় তো নয়, দেখুন না, বাড়ির এমন অনেক ঘর আছে যার দরজায় টোকা দেওয়া হয়নি বহুকাল, সে ঘরে পা রাখা হয়নি, এই তো সময়, সে দরজাটা না-ই বা বন্ধ থাকল আর!
আচ্ছা, এতটা লিখে আমার মনে হল, কাজের মেসো এত কথা বললে, লোকে কাজে রাখবে? নাকি বলবে, কি তত্ত্বজ্ঞানী কাজের মেসো রে বাবা! হয় বিদেয় করো নয় দুটো চালভাজা দাও, চিবোতে চিবোতে বাসন মাজুক। কে জানে?