সৌরভ ভট্টাচার্য
28 January 2020
প্রতিবার বইমেলার আগে অনেকেই ফেসবুকে যারা নিয়মিত লেখালেখি করেন তারা বই বেরোনো নিয়ে পোস্ট করেন। সেটা ভালো লাগে। মজার কথা হচ্ছে নিয়মিতভাবে তাদের নিয়ে আরেকদল মানুষ নানা ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন। সেগুলো পড়তেও মজা লাগে, কারণ তাদের মধ্যে অনেকে আবার অল্প বিখ্যাত, মাঝারি বিখ্যাত। আবার একদমই খ্যাতির দিকের নন এমন মানুষও থাকেন।
দুর্ভাগ্য যে এ বছর আমার নামটাও সেই বই "ফেসবুক লেখক", "যারা টাকা দিয়ে বই বার করে", "যাদের বই দু-একজন পরিচিত ছাড়া বিশেষ কেউ কেনেন না, পাতা উল্টিয়েও দেখেন না", "একজন আরেকজনের পিঠ চুলকে দেন" - তাদের দলে ঢুকে গেছে। কেউ কেউ ঈর্ষায় সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। কেউ উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ উদাসীন থাকছেন।
মুশকিল হচ্ছে আমার নিজেকে নিয়ে। আমি কোনো কিছুতেই ঠিক না তো উৎসাহিত হতে পারছি, না তো উচ্ছ্বসিত হতে পারছি। আমি শুধু কষ্ট পাচ্ছি। তার কারণ, যারা ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন তাদের জন্য। দুই, আমার বন্ধুদের অত্যন্ত আবেগপ্রবণ অত্যন্ত উৎসাহের জন্য, যা আমার কাছে শুধুমাত্র আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসার জন্য, যার আদৌ যোগ্য আমি নই, এ আমার বিনয় নয়, হৃদয়ের মর্মস্থলের সত্য অনুভব।
আসলে কথাটা কি জানেন, আমি পাত্র দেখি না, পাত্রস্থ বস্তুটিকে দেখি। বহু অত্যন্ত প্রতিভাবান ছেলেমেয়েকে যখন ইউটিউবে তাদের গান, তাদের অসামান্য কৌতুক ক্ষমতা, বাচন ক্ষমতা ইত্যাদি নানা প্রতিভার পরিচয় পাই, মনে হয় না ইউটিউবে দেখছি বলে তাদের মান কমছে। আমার তাদের প্রতিভার পরিচয় পেতে কোথায় অসুবিধা হচ্ছে মনে হয় না। একটা ঘটনা মনে পড়ল, একবার ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, সন্ধ্যেবেলা, আমি একটা মুদির দোকানে নিজেকে ভেজার হাত থেকে বাঁচাতে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ কানে এলো এক অসামান্য কণ্ঠস্বর, কৃষ্ণনাম গাইছে, তাকিয়ে দেখলাম, এক ভিখারি, শাড়িটা শতচ্ছিন্ন, সারা শরীরে সভ্য সমাজের চূড়ান্ত উপেক্ষা, অবহেলার ছাপ, সে উদাস হয়ে গাইছে, মাধব বহুত বিনতি করু তোঁহে... বিদ্যাপতির পদ। কোথায় শিখেছে সে জানি না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর, তার আবেদন, তার অসামান্য সুরের উপর দখল, সর্বোপরি তার সরল খাঁটি হৃদয়ের আকুতি আমার চোখকে সিক্ত করল। আমার গলার কাছে দলা পাকানো কান্না তখন। নাই বা হল সে কোনো খ্যাতনামা সিডি কোম্পানি থেকে বেরোনো, দামী সিডি প্লেয়ারের থেকে নির্গত গান, হৃদয় কি বহির্যামী?
তাই আজ আমি যখন সেই দলে এসে পড়েইছি কালের গতিতে, একটা কথা বলে যাই। আমার বয়েস তেতাল্লিশে পড়েছে। আমার বই বেরোনো না বেরোনো নিয়ে কোনো উদ্দীপনা আমার নেই, জীবনে নিজেকে "ছাপাখানার লেখক" হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চাইতে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমার সামনে আছে, কিন্তু সে ফেসবুকে লেখা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো, কিম্বা যে মানুষটার খুব স্বপ্ন তার একটা বই বেরোক, তাদের দিকে তাকিয়ে অন্তত আপনাদের ব্যাঙ্গ বিদ্রুপগুলো একটু কম ধারালো, কম নির্মম করুন। সদ্য জন্মানো স্বপ্নরা খোলস ছাড়া অক্টোপাসের মত বড্ড করুণ, বিপজ্জনক, অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভোগে। তাদের আঘাতটাও লাগে বড় বেশি।
আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন যারা লিটল ম্যাগাজিন বার করত, লেখালেখি করত সেখানে তাদের নিয়েও এমন ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ মাঝারি-কম খ্যাতনামা মানুষদের শুনেছি। সে এক প্রথা আজও বর্তমান। সুনীল শক্তির সেই প্রথম দিনের লিটল ম্যাগাজিনের সময়ের নানা স্মৃতিকথাতেও তা আছে। আসলে কি জানেন, আমি জানতাম বই ছাপাতে টাকা লাগে, কিন্তু এটা জানতাম না যে এত পরিশ্রম করতে হয় তার জন্য। এত এত পরিশ্রম। বারবার ছাপাখানায় যাও, বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রুফ দেখো, সে প্রুফ দেখা কি চাট্টিখানি কথা! যার একটাও আমি করিনি। একটা কাজও না। তাদের প্রবল উৎসাহকে বরং থামাতে চেয়েছি হাজারবার।
কিন্তু যারা সবটা নিজেরা করেন? শুধুমাত্র নিজের স্বপ্নটাকে সাকার দেখবেন বলে? এত শ্রম, টাকা সব সবটাই তো তাকে নিজেকে একা একা করতে হয়, তারপর? মাঝে মাঝেই আপনাদের ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টের মুখোমুখি। কেউ কেউ বলেন পীড়াপীড়ি করে যে! আমি জানি। কিন্তু সেটাকে আমি যখন না-ছাপিয়ের দলে ছিলাম, আবদার দেখেছি, ব্যাকুলতা দেখেছি, অত্যাচার দেখিনি। যে মানুষটা আমার দরজায় আমার সমস্ত দুর্ব্যবহার, তাচ্ছিল্যকে সহ্য করে নেবে পণ করে সেলসম্যান হয়ে এসে দাঁড়ায়, তাকে যেমন আমার উৎপাত বলে মনে হয় না, এও তেমন।
এই পোস্টের জন্য হয় তো আমার বন্ধুরা আমার উপর অভিমান করতে পারেন, কিন্তু এই কথাগুলো না বললে আমি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমার ঘরের এ দেওয়াল, সে দেওয়াল জুড়ে রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মার্কেজ, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, ব্যসদেব, বাল্মিকী, সুনীল, শক্তি, নীরেন্দ্রনাথ প্রমুখ আকাশ, সাগর আর হিমালয়তুল্য প্রতিবেশীরা। সেখানে নিজের যোগ্যতা নিয়ে কোনো মোহ হওয়ার রসদ আমার নেই, বয়েসও বেড়ে পশ্চিমাকাশ যাত্রী। মোহরদির মুখে একবার শুনেছিলাম, এত কঠোর, নির্মম নবাগতদের প্রতি হয়ো না, এতে ওদের বিকাশ হয় না, আটকে যায়। তাই যতই নীতিবাগীশ হই না কেন হৃদয়টা না বাড়লে শুধু মাঝারি হয়েই চারদিকটা শেষ হয়ে যায়। এটা কাম্য নয়।