খবরটা দেখামাত্র উনি লাইব্রেরি ঢুকলেন। স্ত্রী, ছেলে, মা, বাবা, চাকর, বন্ধুবান্ধব --- সব্বাইকে বললেন, বিরক্ত না করতে। দরজার কাছেই খাবার রেখে আসতে।
উনি শুরু করলেন পড়া। প্রথমে বিশ্বসৃষ্টির রহস্য। নানা মত। সায়ানোজেন মতবাদ। ওপারেন হ্যাল্ডেনের কথা। দানিকেনের কথা।
তারপর পড়লেন আর্কিওজোয়িক যুগ থেকে সিনোজোয়িক যুগ অবধি নানা প্রাণী, উদ্ভিদ সৃষ্টির কথা।
ইতিমধ্যে ডাক্তার এসে বলেছেন, সুগার-প্রেসারটা বাড়ছে। উনি, লালচক্ষু, হাতের ইশারায় বললেন, যান আপনি।
চিকিৎসক ফি নিয়ে চলে গেলেন। উনি আবার পড়ায় ডুবলেন। এসে পড়লেন আফগানিস্তানের জন্মসূত্রে। আব্রাহাম থেকে ইহুদি, খ্রীষ্ট, মুসলমান, বৌদ্ধধর্ম নিয়ে লেখা সব বই পড়ে ফেললেন।
প্রেসার সুগার আরো বাড়ল। চোখ আরো গেল ধাঁধিয়ে। তারপর নানা অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, উগ্রনীতি, নরমনীতি নিয়ে পড়ে যখন বুঝলেন আফগানিস্তানের অবস্থা, তখন ওনার দাঁড়াবার শক্তি নেই। ক্ষীণ হাতে দরজাটা খুলে বাইরে এসে বললেন, জল।
মূর্ছা গেলেন।
জ্ঞান ফিরল আরো দু'দিন পর। জ্ঞান ফিরতেই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, চাকরবাকর --- সবাই ঘিরে ধরল। এতবড় সমস্যার কিছু একটা সমাধান উনি পেয়েছেন নিশ্চয়ই। এমন বই অন্তপ্রাণ মানুষ আজকাল দেখা যায় কই?
উনি চুপ করে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছুই বলেন না। হঠাৎ স্ত্রী আর থাকতে না পেরে বললেন, হ্যাঁগো শুনেছ, ওখানে মেয়েদের ভীষণ...
বলতে বলতে স্ত্রী'র চোখের কোল ভরে এলো জলে..
ভদ্রলোক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চীৎকার করে বললেন, ফোন…. কই আমার ফোন।
সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে গেল ছেলে। তিনি ল্যাবে ফোন করে বললেন, তুরন্ত আও... ডাবল ফি মিলেগা….
ল্যাব থেকে লোক এলো, পি.পি.ই. কিট পরে। ভদ্রলোক বললেন, তাড়াতাড়ি আপনি ওর চোখের জলের স্যাম্পলটা নিয়ে নিন….
এই বলেই লাফ দিয়ে স্ত্রীর প্রায় কোলের কাছে এসে বসলেন... বললেন, তুমি কাঁদছ না কেন?..
স্ত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে ছিলেন মেঝেতেই।
ভদ্রলোক হাত পা ছুঁড়ে বললেন, টিভি চালাও... নিউজ চ্যানেল লাগাও….
মহিলা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। চোখে জল এলো। স্যাম্পল নেওয়া হল। ভদ্রলোক ল্যাবের ছেলেটিকে বললেন, রিপোর্ট আমায় মেল করে দিও হে…. আমায় পড়তে হবে... বইয়ের মধ্যে ডুবতে হবে…. দেখতে হবে কাকে বলে কান্না…. কাকে বলে কষ্ট... কোন নার্ভের আন্দোলনে এই জলের উদগীরণ হয়…. কেন হয়... এটি আধিভৌতিক না আধিদৈবিক... পাশ্চাত্য বিজ্ঞান কি বলে.. নিউরোসায়েন্স, কগনিটিভ সায়েন্স কি বলে... ভারতীয় দর্শন মতে এটি মায়া না দয়া? আত্মার পক্ষে বন্ধনমূলক না মোক্ষদায়ী….
উনি লাইব্রেরিতে ঢুকে গেলেন। পেপারব্যাক, হার্ডকভার, ইবুক... সবে ডুবে গেলেন। দরজায় খিল পড়ল।
স্ত্রী একটা চিরকুটে কিছু লিখে দরজার তলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। "ওগো, গুরুদেবের কথা কি ভুলে গেলে... বই পড়ে বই হয়ে যেয়ো না…."
চিরকুট ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়ালো। কখনও বিছানায়, কখনও সোফায়, কখনও ল্যাপটপের মাথায়…. উনি খেয়াল করলেন না। অবশেষে খাটের তলায় ধুলোর মধ্যে গেল ডুবে। সেখানে পুরোনো বইয়ের স্তূপ। তার নীচে আরো পুরোনো বইয়ের স্তূপ। তার নীচে আরো। খাট ঠেকেছে প্রায় ছাদ ছুঁয়ে। উনি অবশ্য বলেন, উচ্চচিন্তা ছাড়া কি আছে জীবনে…. তার জন্য চাই উচ্চশয়ন।