সৌরভ ভট্টাচার্য
2 February 2018
বাজারটা থমথম করছে এখনও। পুলিশ এখনও বডি নিতে আসেনি। ছেলেটাকে এদিকে কেউ আগে দেখেছে বলেও চিনতে পারছে না। কিন্তু এরকম দিন দুপুরে খুন এই তল্লাটে আগে কবে হয়েছে মনে করতে পারছেন না বিশ্বনাথ দাস। বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে, ভুরু কুঁচকিয়ে পরেশের চায়ের দোকানে বসে আছেন। সাদা পায়জামা আর সাদা পাঞ্জাবি গায়ে। বয়েস সত্তরের কোটায়। সাংবাদিকতা করতেন। আন্দুল স্টেশান থেকে তার বাড়ি হেঁটে পনেরো মিনিট হবে। বাজার করতে বেরিয়েছিলেন। খুনটা প্রায় ওনার চোখের সামনেই ঘটে গেল। ছেলেটার বয়েস চব্বিশ পঁচিশ হবে। লোকে বলছে ছেলেটা এদিককার নয়।
বিশ্বনাথবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। "পরেশ একটা চা দাও তো", বলে ব্যাগটা পাশে রেখে পাদুটো বেঞ্চে তুলে বাবু হয়ে বসলেন।
"কি কাণ্ডটা হল দেগলেন ?" নিবারণ মুখুজ্জে এসে উল্টোদিকের বেঞ্চটায় বসলেন। নিবারণ মুখুজ্জে, দুধের ব্যবসা। বিশ্বনাথবাবুর থেকে বছর দশেক ছোটো।
"খালি পা কেন?"
"পুজো দিতে গেসলাম, মেয়েটার ছেলে হল"
"অ, তা খুনের ব্যাপারে কি বলছিলেন, দেখার কি আছে নতুন আর। খবরের কাগজ পড়েন না? এতো আকছার ঘটছে মশায় এখন। ওই বিদেশে কি হল, একটা লোক এক মাঠ লোক, গান শুনছিল দিল গুলি করে, ঠ্যা রারারা... কার কি হল? কার কি এলোগেলো মশায়?"
"তা বটে, দে তো রে চা এককাপ। চিনি দিস। সুগারটা ফল করবে মনে হচ্ছে... বডিটা দেখলেন?"
"নাহ, ওতে আর রুচি নাই, ও কত দেখসি ধুস... আচ্ছা পরেশ তুমি দুধ কোন দোকান থেকে নাও বলতো? তোমার দুধের রঙ তো বেশ সাদা, আর ঘনও মনে হচ্ছে, একটু হাতে দাও তো..."
পরেশ একটা ছোট গ্লাসে দুধ এগিয়ে দিয়ে বলল,"খেয়ে দেখেন, আমার শ্বশুরবাড়ির দুধ, শাশুড়ির খোদ নিজের হাতে দোয়া "
বিশ্বনাথবাবু হাত বাড়িয়ে নিলেন।
"ছেলেটা এদিককার না, কি বলেন?", রতন মাঝি এসে নিবারণ বাবুর পশে বসলেন। রাজ্য সরকারে চাকরি করেন।
"না ই তো মনে হচ্ছে, তা আজ এত বেলায় যে, অফিস নেই?", নিবারণবাবু জানতে চাইলেন।
"যাই নি, অরে আরেকটু হলে গুলিটা আমারই লাগত হয়ত, আমি ওই রেল লাইনের ধারে একটু হালকা হয়ে সদ্য পায়জামার দড়িটা বেঁধেছি কি বাঁধিনি... কি বলব বিশ্বনাথদা সাঁ করে কানের পাস্ দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিটা, ছেলেটাকে আগে খেয়াল করিনি, বেচারা বটুকের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, সত্যিই মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চ্য়তা নেই আজকাল।"
"বেচারা বলছেন কেন? ও যে ধোয়া তুলসীপাতা আপনি জানলেন কি করে?" বিশ্বনাথবাবুর ঝাঁঝালো প্রশ্ন।
"না তা তো বলিনি, তবে সে যাই হোক তা বলে একটা মানুষকে এমন দিন দাহারে মেরে ফেলা যায় নাকি? দেশে আইন কানুন বলেও তো একটা ব্যবস্থা আছে নাকি? পরেশ চা..."
"আর আইন যদি অন্ধ হয়ে থাকে? কতটা খোঁজ খবর রাখেন চারপাশে যা ঘটে চলেছে সে সম্বন্ধে? যান তো একটা ধ্যাড়ধড়ে অফিসে, তাও গরুমোষ গুনতে সরকারের, জানেন তলে তলে সমাজটা কোথায় এসে ঠেকেছে?”
“আপনি এরকম ভাবে কথা বলছেন কেন? আমি তো একটা সাধারণ নিয়মের কথা...”
“সাধারণ নিয়ম? কাকে সাধারণ নিয়ম দেখাচ্ছেন আপনি? একজন সাংবাদিককে? এই যে আপনি নিবারণবাবু, কি বললেন, আমি বডি দেখেছি কিনা? না দেখিনি। আপনি দেখেছেন? না দেখেন নি? শালা একটা মাকড়সা গায়ে পড়লে এমন আর্তনাদ করেন যেন গায়ে কেউ অ্যানাকন্ডা ছেড়ে দিয়েছে, আর আপনি দেখতে যাবেন বডি...শালা...ভীতু হারামির দল।”
“আপনার শরীর ঠিক আছে?” নিবারণবাবু শান্ত গলায় বললেন।
“কেন? আপনি কি ডাক্তারিটাও শিখছেন নাকি আজকাল? হোমিওপ্যাথি...”, বিশ্বনাথবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন...নিবারণবাবু অপ্রস্তুত হয়ে চায়ের গ্লাসে চুমুক দিলেন। রতনবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিবারণবাবুর দিকে তাকিয়ে। পরেশ চা পাশে রেখে গেল।
“দেখুন রতনবাবু আপনি যদি মনে করে থাকেন আমি ঝোঁকের মাথায় এসব কথা বলছি খুব ভুল ভাবছেন, আপনি একজন নিরীহ ভীতু বাঙালী প্রজাতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কত টাকা চাঁদা দেন পাড়ার পূজোয়? আমি জানি। বারো হাজার। কারণ পাড়ার ছেলেরা যাতে আপনার যুবতী মেয়ের দিকে না তাকায়, ডিস্টার্ব না করে... কতদিন? আর কতদিন এই অসুরকূলের মুখে খাবার তুলে রেহাই পাবেন? আমি পেয়েছি? পাইনি। মল্লিকার চিকিৎসায় কত খরচ হয় জানেন? কোনো আন্দাজ নেই। তার উপর ফ্ল্যাট করার জন্য দালালের রোজ চাপ... ওরা কত রকম ট্যাক্টিস জানে আপনার আন্দাজ আছে?”
“আপনি কথা অন্যদিকে ঘোরাচ্ছেন” রতনবাবু বললেন।
“ঘোরাচ্ছি না মহাশয়, বোঝাচ্ছি। যাতে ঘটে কিছু বাস্তবজ্ঞান ঢোকে, বুঝলেন? সারারাত বাড়ির সামনে বসে থাকবে। মাঝরাতে দরজায় নক করবে, পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করবে, যখন তখন আপনার সামনে এসে পড়ে বলবে মেশো একটু ভাবুন... কার কাছে নালিশ জানাতে যাবেন? সব পকেটের মধ্যে... হে হে... বলছি কি?”
“দেখুন আমার মনে হয় জলে থেকে কুমীরের সাথে সমঝোতা করে চলাই ভালো”, রতনবাবুর গলার স্বর ভারী।
“মানেটা কি? জলে যে শুধু কুমীরই আছে কে বলেছে আপনাকে? আর কুমীর শুধু থাকলেই যে তা একজাতের তাই বা জানলেন কি করে?” বিশ্বনাথ ঝুঁকে এসেছেন রতনবাবুর দিকে।
“মানে আপনি বলতে চান কাজটা ঠিক করেছে... মানে এই খুনটা...”
“আলবাৎ ঠিক করেছে... ওই দেখুন পুলিশের গাড়ি... কত পুলিশ... আপনি যান দেখি আপনার পাড়ার কেসটা বলুন... আপনার স্ত্রী কেন গদাইয়ের (কুখ্যাত মস্তান) ছেলের জন্মদিনের পার্টি থেকে রাত করে ফিরেছিল, কি অবস্থায় গদাই আর আপনার স্ত্রীকে দেখা গিয়েছিল বলুন গিয়ে পুলিশকে... যান... উঠুন... পাড়ায় থাকতে কেন তোলা যোগাতে হচ্ছে বোঝান আপনার আইনি কুশীলবদের”
“আহ্, কি হচ্ছে বিশ্বনাথদা... ছাড়ুন না...” নিবারণবাবুর ফিসফিসে চাপা উদ্বিগ্ন গলা।
রতন মাঝি মাথা নীচু করে চায়ের কাপ ধরে বসে আছেন। পরেশ খবরের কাগজ খুলে পাতায় ইতস্তত চোখ বোলাচ্ছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে এদিকে তাকাচ্ছে। তার ঠোঁটের আগায় একটা চাপা হাসি।
“উঠি বুঝলেন, আজ ভাবছি বেলার দিকে একবার অফিসটা ঘুরেই আসি।“ রতন মাঝি উঠে দাঁড়ালেন। বিশ্বনাথবাবু তীক্ষ্ম নজরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে।
“পালাচ্চো?”
“হ্যাঁ পালাচ্ছি, অন্তত আমার সে ক্ষমতা আছে, পালিয়ে লুকিয়েও বাড়ির কেচ্ছা বাড়িতেই রাখার। আপনার স্ত্রী? সে তো কত বছর যেন? এই নিবারণদা, আপনি বলুন না... কত বছর পালিয়ে গিয়েছিল যেন ওই লাফাঙ্গাটার সাথে?...
("উফ্... আপনারা কি শুরু করলেন বলুন তো...", নিবারণের উক্তি... ক্ষীণ স্বরে)
"বলুন...সে বেলা?", আমি হলে ওকে আর ঢুকতে দিতাম? মঞ্জু যা করেছে সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে... আর মল্লিকাদি... ছি ছি... সাধে আপনাকে নপুংসক বলি... একটা ইস্যুও তো দিল না ভগবান আপনাকে...”
“আহা... বেশ তো আমায় গাল পাড়ছিলে রতন আবার ওই নপুংসক স্বর্গস্থ পিতাকে কেন...”
“আপনি একটা অসহ্য...”
"পরেশ চা..."
পুলিশ বডি নিয়ে চলে গেল।