কোনো এক গ্রামে এক বালক থাকত। তার নাম রাতুল। উদাসীন, আত্মভোলা ছেলেটা সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াত। গান গাইত। গরু চরাত। খেলাধুলাতে মন ছিল না তেমন। মাটি ভিজিয়ে নরম করে শিব গড়ত। সাদা কাগজের উপর দুর্গা, কালী ছবি আঁকত। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম মুখস্থ গাইতে পারত। শিবের স্তব গাইত। শ্যামাসঙ্গীত যে কত তার কন্ঠস্থ ছিল সে নিজেও জানত না।
একদিন রাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। বুকের ভিতরটা কেমন টাটিয়ে আছে। যেন কেউ গুলতি ছুঁড়েছে টিপ করে তার কলিজায়। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। রাত গভীর। বাইরে এসে দাঁড়ালো। পূর্ণিমা গেছে গতকাল, বেশ বড় চাঁদ। বাইরেটা দেখে মনে হল মিছিমিছি সে এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছিল। কি সুন্দর জোনাকি জ্বলছে চারদিকে, যেন আরতি হচ্ছে। চাঁদের আলোয় কে যেন চাদর পেতে গেছে পুরো মাঠ জুড়ে। আকাশের তারাগুলোও যেন পৃথিবীর কত কাছাকাছি এসে গেছে।
রাতুল পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের জলে চাঁদের ছায়া টলটল করছে। একটা ব্যাঙ যেই লাফ দিয়ে জলে পড়ল অমনি গোল গোল ঢেউ খেলে গেল জলে। চাঁদের প্রতিবিম্ব দুলে উঠল। রাতুলের কান্না পেল। সে স্থির রাখতে চায়। তার বুকে থেকে থেকেই কার যেন প্রতিবিম্ব পড়ে। তার গানে সে সাড়া দেয়, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ, কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায় না। বুকটা আনন্দে উথলে ওঠে। চোখ বেয়ে ধারা নামে। সামনের মাঠে চরা গরু, গাছপালা, আকাশ, দূরে তাদের গ্রামের বাড়ি - সব মিলিয়ে কার যেন বাঁশির সুরে বেজে ওঠে। আবার সে সুর চাপা পড়ে যায়। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কষ্ট হয় রাতুলের।
রাতুল পুকুরের জলে মুখ ধুয়ে মাঠের মাঝে যে রাস্তাটা, সেই রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করল। একটু দূরেই মায়ের মন্দির। রাতুল মন্দিরের দরজায় ঠেলা দিল। দরজা খুলে গেল। রাতুল জানে কোথায় দেশলাই রাখা থাকে। হাতড়ে দেশলাইয়ের বাক্সটা ছুঁলো। একটা কাঠি বার করে জ্বেলেই মায়ের মুখের দিকে তাকালো। মায়ের নথ, কানের দুল, গলার হার চকচক করে উঠল। না, তা ঠিক না। মায়ের মুখটা হাসিতে আনন্দে ভরে উঠল। রাতুল প্রদীপ জ্বেলে মায়ের সামনে বসল। মায়ের মুখের দিকে গভীর প্রাণে তাকালো। মা ডেকে পাঠালো তাকে?
সামনে তিনটে বাটি রাখা। ছোটো ছোটো কাঁসার বাটি। তার মধ্যে একটাতে দুধ, একটাতে ঘি আর একটাতে মধু।
রাতুল বলল, এগুলো কেন মা?
মা তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন। বললেন, দেখ, এই দুধ হল জ্ঞানের। ঘি হল শক্তির। আর মধু হল ভক্তির। তুই কি চাস, ভেবে বল।
রাতুল বলল, শক্তি মানে কি?
মা বললেন, অর্থশক্তি, খ্যাতির শক্তি, নানা প্রতিভার শক্তি।
রাতুল একটু ভাবল, তারপর মধুর বাটির মধ্যে দুধের বাটি উপুড় করে মিশিয়ে এক ঢোকে সমস্তটা পান করে নিল।
মা হাসলেন, তবে তুই জ্ঞান আর ভক্তি চাস?
রাতুল মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
মা বললেন, আর কিছু না?
রাতুল মাথা নেড়ে বলল, না না না।
গল্প শেষ হল। গোঁসাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, জ্ঞান কি গোঁসাই?
গোঁসাই বলল, আত্মবোধনের মন্ত্র।
বললাম, মানে কি?
গোঁসাই বলল, বোধন মানে কি আগে বল?
বোধন মানে মহাষষ্ঠীর দিন দুর্গামণ্ডপে যা হয়, পুজোর শুরু।
গোঁসাই হাসল। বোধন মানে হল দেবীর জাগরণ ঘটানো। বলেই হো হো করে হেসে উঠল গোঁসাই...
বললাম, হাসলে যে?
গোঁসাই বলল, তা হাসব না? যার জাগায় আমাদের সবার জাগা, তাকে কিনা আমরা জাগাচ্ছি... তা মাটির প্রতিমা তো জাগে না... কিন্তু আমাদের ভিতরের বোধন কে করাবে রে?
আমাদের বোধন মানে কি?
মানে আমাদের চিত্তের জ্ঞানোন্মুখী হওয়া কবে হবে? জ্ঞানের দিকে ফেরাই হল বোধন... গোঁসাই গাইছে.. ”কুঁড়ি চায়, আঁধার রাতে শিশিরের রসে মাতে.... ফোটা ফুল চায় না নিশা, প্রাণে তার আলোর তৃষা... কাঁদে সে অন্ধকারে... যে থাকে থাক্-না দ্বারে, যে যাবি, যা-না পারে…”
গোঁসাই ভোরের আলোয় মিলিয়ে গেল। কি ধাঁধাঁয় চোখ ঝলসিয়ে গেল। শিশিরে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছি। মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমার বোধনের মন্ত্র। আমাদের বোধন কবে হবে? কে করাবে? আমি আমার সামনে আসন পেতে কবে বসব? কবে নিজেকে বলব, জাগো! সমস্ত অজ্ঞানতার মোহকে দূর করে এ বিশ্বের বুকের উপর কান পেতে কবে শুনব সেই বাঁশি... যে বাঁশিতে সমস্ত বিদ্বেষ হবে দূর, সমস্ত ভয় হবে অপগত, সমস্ত ক্ষুদ্রতা হবে অতীত? নিজের ভিতরে শুনব, শান্তি... শান্তি... শান্তি... অনাহত ধ্বনি....