Skip to main content


---
"গড়গড় করে নামতা বলতে পারো না? তবে কি পারো? লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে পারো? রিকশায় বসে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজেকে নিজে গল্প শোনাতে পারো? পা'টা সুড়সুড় করছে? কোথায় যাবে? এত যাওয়া যাওয়া কেন?"
এতসব কথা মাথায় নিয়ে বসে থাকা যায়? বিষ্টুবাবু উঠে দাঁড়ালেন। অফিসের টেবিলের পাশেই জানলা। নীচে ব্যস্ত কলকাতা। চারতলার উপর থেকে পঞ্চাশ বয়সের বিষ্টুবাবু কি মায়া নিয়ে এই কলকাতা শহরটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর বাড়ি হাওড়ায়। হলে কি হবে, স্কুল, কলেজ, প্রেম, রাজনীতি সবই তো কলকাতায়। কলকাতাকে অনেকটা নিজের মায়ের মত লাগে বিষ্টুবাবুর। বিশেষ করে যখন এই সূর্যাস্তের সময় হয়। মনে হয় মা একটা বড় সিঁদুরের টিপ পরে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনটা একটা তুলোর মত মায়ায় ভরে ওঠে। 
বিষ্টুবাবু অনেক কিছু হতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মত লেখক, হেমন্তর মত গায়ক, উত্তম কুমারের মত নায়ক, সত্যজিতের মত পরিচালক, চে গুয়েভরার মত নেতা। কিচ্ছু হওয়া হল না। কতবার স্বপ্ন দেখেছেন, উনি অস্কার পাচ্ছেন, কিম্বা নোবেল; আর প্রথম সারিতে বসে ওনার মা, স্ত্রী, মেয়ে, পাড়ার জগাদা, কাজের মাসি আরতি, পেপারওয়ালা মধু, জমাদার পাড়ুই, মুদিওয়ালা হেরম্বদা। ওরা কখনো বিদেশ যায়নি। বিষ্টুবাবুর এটাই বড় সুখ যে তারা তার এই পুরষ্কারটা পাওয়ার জন্য প্লেনে উঠতে পারল, বিদেশ ঘুরতে পারল। 
বিষ্টুবাবু এসব স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখেন না। জেগে দেখেন। অফিসের চেয়ারে কাজের ফাঁকে, কমোডে কলের জল ঘাঁটতে ঘাঁটতে, ট্রামের কোণের সিটে চোখ বুজে গা এলিয়ে, একা একা হাঁটতে হাঁটতে, এরকম নানা জায়গায় উনি স্বপ্ন দেখে চলেন। 
আজ মনটা খুব খারাপ। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এমন কিছু কাজের চাপও নেই। খুব সামান্য একটা কাজই করেন। বিষ্টুবাবু জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বিকাল পাঁচটা। আর দু'ঘন্টা অফিস খোলা। ওনার হাতে আর মাত্র চারটে ফাইল আছে। কিছু সংখ্যা টুকে ফেয়ার করে অন্য ফাইলে রাখতে হবে। আজই করতে হবে। বিষ্টুবাবু ঘড়ি দেখলেন, এখনো সময় আছে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে স্বপ্নে মজে গেলেন। 
হুঁশ এলো সাড়ে ছটায়। দাসবাবুর ডাকে। তিনি এত মজে গিয়েছিলেন? আজ অবশ্য তিনি হয়েছিলেন মার্টিন লুথার। তাই এতটা সময় লাগল। নতুন স্বপ্নে অনেকটা সময় লাগে। কয়েকবার দেখা হয়ে গেলে কয়েকটা দৃশ্য স্বপ্নের কেটে দেন। 
যা হোক, তিনি কাজে বসলেন। আটটা তো বাজবেই। সিকিউরিটিকে বললেন রাত করে খেয়ে আসতে। উনি আটটার আগে বেরোবেন না।


 
---
বসলেন কাজে। অফিসে কেউ নেই। শীতকাল। শুধু দেওয়াল ঘড়িটার আওয়াজ আসছে। 
- মে আই কাম ইন স্যার?
- কে?
- এসে বলি?
বিষ্টুবাবুর চোখে শুধু প্লাস পাওয়ারের চশমাটা লাগানো, কে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেননি। চশমা পাল্টাতেও ইচ্ছা করল না। একে তো দেরি হল। তার ওপর আজ মেয়েটা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল, পাড়ায় একটা নাচের অনুষ্ঠান আছে আজ। মেয়েটা নাচবে। 
তিনি একটু বিরক্তির সুরেই বললেন, "আসুন।"
একজন বয়স্ক মানুষ ধুতি পাঞ্জাবী পরে ঢুকলেন, "বসতে পারি?"
বিষ্টুবাবু বললেন, "বসুন।"
তিনি পাশের চেয়ারটায় বসলেন। বিষ্টুবাবুর দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, "ভাবছেন কে আপদ উড়ে এসে জুড়ে বসল? এই অধমের নাম কার্তিক মোদক। আমি এককালে এই সিটেই চল্লিশটা বছর কাটিয়েছি।"
বিষ্টুবাবুর মুখটায় অসংখ্য ভাঁজ পড়ে। ঘড়ি দেখলেন, সাতটা পোনেরো। 
-ঘড়ি দেখে লাভ নেই। তুমি আমায় ফাইলগুলো দাও দেখি আমি ঝটপট সেরে দিই। 
বিষ্টুবাবু কিছু বলার আগেই উনি খাতা দেখে ঝড়ের বেগে কাজ শুরু করে দিলেন। কুড়ি মিনিটের মধ্যে সব সেরে ফেললেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেনটা বন্ধ করে বললেন, "অনেকদিন পর এইদিকে আসলাম। কাউকে যে পাব ভাবিনি। আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ দেখলাম আপনি কি করছেন। দেখলাম খুব অন্যমনস্ক আপনি মশায়।"
বলেই আগন্তুক ভদ্রলোক হো হো করে হেসে ফেললেন। এদিকে বিষ্টুবাবু কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বললেন, "পিছনে এসে দাঁড়ালেন কখন, আপনি তো পারমিশান চাইলেন দরজা থেকে?"
- আরে ধুর সে তো আপনি যাতে ভয়টয় না পান তার জন্যে মশায়।
বিষ্টুবাবু শুকনো গলায় বললেন, "ভয় পাব মানে?"
- আরে ভুত বলে কথা। হাওয়া হয়ে ঘুরি। তা বলে তো আর হাওয়া হয়ে কথা বলা যায় না? আর হাওয়ায় কথা বলছে শুনলে আপনারও আমার বর্তমান দশার মত কিছু একটা হত। কি ভুল বললাম? 
বিষ্টুবাবু ভাবছেন এ কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! সন্ধ্যেবেলায় খোদ কলকাতার বুকে ভুত! কিছু একটা বলতে যাবেন, সামনের ভদ্রলোক অমনি হাওয়া হয়ে গেলেন। পরক্ষণেই সামনে একগাল হেসে আবির্ভাব হয়ে বললেন, "কি বিশ্বাস হল তো? খাঁটি ভুত।"
- তা আপনি..., বিষ্টুবাবুর গলা কাঁপছে। 
ভুতমশায় বললেন, "অত ঘাবড়াবেন না, আমায় শরীর ছাড়া মানুষ ভাবুন, ব্যাপারটা ইজি হয়ে যাবে।" বিষ্টুবাবু চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। ঘড়ি দেখে বুঝলেন রতনের আসার সময় হয়ে এসেছে। আটটায় আসার কথা। ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন রতনের কথা ভাবছেন তো, সে আসতে আসতে ন'টা বাজাবে। ওর বাড়িই হয়ে আসছি। ওতো আমার শালার ছেলে মশায়। জোর করে ঢোকানো চাকরীতে। ভুল পথে যাচ্ছিল।" 
বিষ্টুবাবুর রাগ হচ্ছে এবার। ভুত হোক যাই হোক, ভীষণ গায়ে পড়া কিন্তু। ভুতমশায় বললেন, "আমি কি চলে যাব? আপনার অস্বস্তি হচ্ছে? তবে বলি কি আজ অফিসেই থেকে যান, আপনার বাড়ি যেতে যে চৌধুরীপাড়া পড়ে সেখানে আজ রাতে একটা বড় ধরণের গোলমাল হওয়ার আশঙ্কা আছে পটা বলছিল, আপনি তো আবার অ্যান্টিপার্টি। পটাকে মনে নেই? আরে পাঁচ বছর আগে বোম বাঁধতে গিয়ে মারা গেল না? সে।"
বিষ্টুবাবুর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছে না। অগত্যা ভুতমশায় কথা শুরু করলেন।


 
---
কাত্তিকবাবু (উনি নামটা ওরকমই উচ্চারণ করেন) চারদিকটা একবার ভালো করে চোখ বুলালেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, "বুঝলেন মশায়। আমি মারা গেলাম তা প্রায় বছর তিরিশ তো হবেই। এই তো অফিস থেকে বেরোতে না বেরোতেই একটা ডবল ডেকারের তলায়..."
বিষ্টুবাবু অনেকটা ধাতস্থ এখন। একটা সিগারেট ধরালেন। ভুত সিগারেট খায় কিনা জানেন না, তবু ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞাসা করতেই উনি বলে উঠলেন, "আরে না মশায়, ভুতের সাথে আগুনটা ঠিক যায় না।"
না যাক। বিষ্টুবাবুর মুখে আগুন জ্বলে উঠল। 
কাত্তিকবাবু বললেন, "আপনার মনে এত অশান্তি কেন? এই কাজ ভালো লাগছে না? উচ্চাকাঙ্খা ছিল নাকি জীবনে খুব?"
বিষ্টুবাবু সিগারেটের একটা ধোঁয়া মুখটা একটু কাত করে ঘুরিয়ে ছেড়ে বললেন, "তা ছিল, সবার থেকে একটু বেশিই ছিল। আসলে বাড়ির তোল্লাটা খুব খেয়েছি ছোটবেলায় তো। দাদু দিদা, ঠাকুমা ঠাকুর্দা, আর বাবা – এদের সবার নয়নের মণি ছিলাম। যাই করি 'আহা কি দারুন, কি দারুন বাহবা' পাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বুঝলেন তো... সেই স্বভাবটা ছাড়তে পারিনি এখনও। সব সময় মনে হয়, কিছু একটা সত্যিই এমন করি যাতে সবাই বেশ আহা আহা করে... এটা একটা চারিত্রিক দুর্বলতা বলতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা এখন খুব সিরিয়াস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে একটা কেউকেটা প্রমাণ না করতে পারলে যেন সারা জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। রাতে ঘুম হয় না। খাবার হজম হয় না। কারোর সাথে ভালো করে কথা বলতে পারি না। চাই না, তবু খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। অথচ দেখুন আমার সব ক'টা স্বপ্নে ওরাই থাকে একটা বড় অংশ জুড়ে। এমনকি আমাদের দুধওয়ালা, পেপারওয়ালা, জমাদার পর্যন্ত। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চাই। কিন্তু অসাধারণ হয়ে বাঁচতে চাই। সাধারণ হয়ে বাঁচাটা যেন ভীষণ অর্থহীন আমার কাছে। আমি একটুও শান্তি পাচ্ছি না জানেন? মনের মধ্যে পুড়ে মরছি সারাদিন অথচ কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারি না। শুনলেও লোকে গুরুত্ব দেয় না। বলতে চেষ্টা করিনি তা তো নয়, কিন্তু সবাই খুব লাইটলি নেয় ব্যাপারটা। আমার আরো ডিপ্রেশান বেড়ে যায়।"
একটানা এতক্ষণ নিজের কথা শেষ কবে বলেছেন মনে করতে পারেন না বিষ্টুবাবু। লজ্জা পেয়ে যান। ফর্সা কানদুটো লাল হয়ে যায়। সিগারেটটায় একটা সলজ্জ টান দিতে দিতে আড়চোখে তাকান কাত্তিকবাবুর দিকে। ভুত কি বোর হয়? ভুতের সবটাই তো খুব বোরিং মনে হয়। এক ডাইমেনশনাল লাইফ। শুধু ভয় দেখিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা। 
কাত্তিকবাবু খুব মন দিয়ে সবটা শুনলেন। সবটা শোনার পর ওনার মুখের ভাবটা উদাস হয়ে গেল। তারপর বললেন, "আমারও এই এক রোগ ছিল, জানেন। আর এই যে আমার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার কথাটা বললাম না? ওটা পুরোটা সত্যি নয় আসলে। কি হল বলি। 
আমি তখন ঠিক আপনারই মত অবসাদে ভুগছি। ছোটবেলা থেকে আমার শখ ছিল খুব উঁচু পোস্টে কাজ করব। অনেক টাকা থাকবে তো অবশ্যই, সাথে থাকবে প্রভূত ক্ষমতা। যখন যা খুশী করতে পারব। এই ক্ষমতার নেশাটা আমায় এমন পেয়ে বসল যে নিজের বসের সাথেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিতাম। পাড়ায় রুলিং পার্টির সাথে যোগাযোগ রাখতাম। গভীর যোগাযোগ। প্রায় না খেয়েও পার্টির ফাণ্ডে চাঁদা দিতাম, মোটা অঙ্কের চাঁদা, যাতে আমার প্রভাবটা থাকে। মিথ্যা বলব না, ছিলও। অনেকে আসত আমার কাছে চাকরি ইত্যাদি করে দেওয়ার জন্য। ওদের অসহায় করুণ মুখটা দেখে একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি লাভ করতাম। কিন্তু সে ওই মুহুর্তটুকুই, পরক্ষণেই মনে হত, এতে কি হবে? আরো ক্ষমতা না থাকলে জীবন কি? কিচ্ছু না। ক্রমশঃ আমার ব্যবহার রুঢ় হতে শুরু করল। যাকে তাকে যা তা বলে দিতাম। স্ত্রী ও পুত্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে লাগল। মদ ধরলাম, ভুল বললাম, আমায় মদ ধরল। সাথে আরো নানারকম নেশা। ভোটে দাঁড়ালাম অনেক টাকা খরচ করে। কি করে টাকা পেলাম জানেন? ততদিনে তো আমার পার্টির সাথে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে। দোষটা আমারই ছিল, নিজের যোগ্যতার অতিরিক্ত ক্ষমতা দাবি করতাম ওদের কাছ থেকে। পেতাম না। বিশাল ঝামেলা করতাম। অগত্যা বার করে দিল আমায়, না হলে ওদের নাম ডোবাচ্ছিলাম আমি। 
বেরিয়ে এসে নির্দল হয়ে দাঁড়ালাম। বউ তদ্দিনে বাপের বাড়ি চলে গেছে ছেলে নিয়ে। আমি ওর গয়নাগুলো চাইতাম সারাক্ষণ ওর কাছে। মাথায় চেপেছিল নিজের একটা পার্টি খোলার ইচ্ছা। ও চলে গেল সব নিয়ে। ঠিকই করেছিল, না হলে ওর চলত কি করে বলুন? ছেলেটারই বা ভবিষ্যৎ কি হত? আমার সঞ্চয় বলে তো কিছুই ছিল না। জমি বিক্রী করে ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। ভোট হল। গোহারা হারলাম। খবর পেতে লাগলাম ছেলেটা বকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তখন ও কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কলেজের একটা মেয়ের সাথে নোংরা ঘটনা ঘটালো। মেয়েটা আত্মহত্যা করল। ওর জেল হল। আমার স্ত্রী হার্টফেল করে সব বাঁধন ছিন্ন করে চলে গেল। আমি ওর সাথে জেলে দেখা করতে চেষ্টা করলাম, ও করল না। কোনো যোগাযোগই রাখতে চাইত না। আর কেনই বা রাখবে বলুন, বাপ হয়ে কোন কর্তব্যটা করেছি ওর জন্যে?"
কাত্তিকবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর জানলার কাছে এগিয়ে দাঁড়ালেন, বললেন, "একবার এদিকে আসুন বিষ্টুবাবু।"


 
---
বিষ্টুবাবু উঠে দাঁড়ালেন। উঠতে গিয়েই কোমরে একটা খচ্ করে ব্যাথা লাগল বলে মনে হল। অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলেই এটা হয়। হাঁটতে গিয়ে বুঝলেন ওনার পা’টা বেশ আড়ষ্ঠ। ভয়ে না জড়তায়? ভীষণ ভয় করছে বিষ্টুবাবুর হঠাৎ। ভুত কাত্তিকবাবুকে না। নিজেকে। নিজের দিকে তাকাতে গেলে যেন আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন, ভুতের চেয়েও ভয়ংকর যেন তিনি নিজে। যা হোক জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পাশেই রাস্তার দিকে মুখ করে তাকিয়ে কাত্তিকবাবু। মুখের ভাব বেশ গম্ভীর। 
কাত্তিকবাবু বললেন, "ওই চৌমাথাটা দেখছেন, ঠিক ওইখানে। এই সন্ধ্যের সময়টাতেই। সেদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। আমার এক বন্ধু খবর দিল বাবুকে ছেড়ে দিয়েছে জেল থেকে, ও কোথায় গেছে কেউ জানে না। ওর মামারাও না। আমি তখন চেরাকাঠের ফাঁকে আটকে। একদিকে আমার উচ্চাকাঙ্খার অন্ধ পাগলামী, অন্যদিকে পিতৃত্বের অমোঘ টান। জেরবার হয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। এ ক'দিন ধরে প্ল্যান করছিলাম আরেকটা পার্টিতে জয়েন করলে কেমন হয়? উত্তরবঙ্গের কয়েকজনের সাথে কথা বলে সব ঠিকও হয়ে গিয়েছিল জানেন। তবু কিছুতেই এবারটা মন মানছিল না। একটা ক্লান্তি এসে গিয়েছিল। 
যা হোক। আমি তো বেরোলাম অফিস থেকে। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছাতাটা খুলে ওই চৌমাথাটার দিকে যাচ্ছি। ওটা ক্রস করে ওপার থেকে ট্রাম ধরে বাড়ি। রাস্তাটা পার হচ্ছি, চশমার কাঁচে জলের ঝাপটায় ঝাপসা, হঠাৎ দেখি দুটো খুব বড়ো আলো তেড়ে আসছে আমার দিকে। আশেপাশে লোকজন চীৎকার করছে, আমি ভাবছি কারোর কি কোনো বিপদ হল?... ভাবতে ভাবতেই দেখি আলোটা... কাছে... আমি বুঝে গেলাম জানেন কি ঘটতে চলেছে... সরলাম না। কি হবে সরে? ক্ষণিকের জন্য বাবুর আর ওর মায়ের মুখটা মনে পড়ল। ক্ষমাও চাইলাম বোধহয়। তারপর সেই আলো.... ঘন অন্ধকার... তীব্র যন্ত্রণা... সব শেষ।"
বিষ্টুবাবুর চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে কখন। মেয়ের আর বউয়ের মুখটা মনে পড়ল তাঁর। কেঁদে ফেললেন। চোখ মুছে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দেখেন রতন আসছে। সামনে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই? কোথায় গেলেন? চারদিক তাকিয়ে কোত্থাও খুঁজে পেলেন না কাত্তিকবাবুকে। রতন উঠছে টের পাচ্ছেন। হঠাৎ অফিসের ফোনটা বেজে উঠল।
"শুনছো? তুমি আজ বাড়ি ফিরো না। পাঁচুদের দল তোমার খোঁজ করে গেছে ক'বার, হাড়ুদের সাথে নাকি কি বোঝাপড়া আছে। তোমায় ডাকতে এসেছিল। আমার খুব ভয় করছে গো। তুমি ফিরো না বুঝলে। একটা হোটেলে থেকে যেও। অফিসে তো থাকতে পারো না বলো?"
রতন এলো। বিষ্টুবাবু বললেন, "হ্যাঁ রে ভিজিস নি তো?"
রতন হাঁ করে তাকিয়ে বলল, "কি ঠাট্টা করছেন, বৃষ্টি কোথায় যে ভিজব? যা ঠাণ্ডা বাইরে। বেরোবেন তো?"
বিষ্টুবাবু লজ্জা পেয়ে গেলেন। রতনকে বললেন, "চল ভালো করে কোথাও একটা খেয়ে আসি। আজ তোর সাথেই রাতে থাকব অফিসে।"
বিষ্টুবাবু সেদিন অফিসে থাকলেন। সাধারণ দোকানে খেলেন, সাধারণ গল্প করলেন। সাধারণ মানুষদের গল্প শুনলেন। একবারও ভাবলেন না সেসব কথা। হ্যাঁ সেসব কথাই। ওরা ভুতের চাইতেও ভয়ংকর। বাকি জীবনে একদিনও বিষ্টুবাবু সে স্বপ্ন আর দেখেননি, পরম শান্তিতে কাটিয়েছেন বলা যায়।