সৌরভ ভট্টাচার্য
7 January 2018
লুচ্চকবাবু কালরাতে স্বপ্ন দেখে কেঁদেছেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই ঠাকুরঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসক এসে বলেছেন ঘুমের ঘোরে তীব্র মানসিক আঘাত পেয়ে শিরা-ধমনী-স্নায়ু গিট্টু পাকিয়ে গেছে।
লুচ্চকবাবু আর কয়েক ঘন্টা টিকলেন। যতক্ষণ টিকলেন ঠাকুরঘরের দিকে আঙুল তুলে, 'উঁ উঁ' করে কিছু বলতে চাইলেন। ওনার স্ত্রী, দশ ছেলে, দশ ছেলের বউ, চল্লিশটা নাতি-নাতনি, পাঁচশো দাসদাসী ভাবলে, কত্তাবাবার ঈশ্বরদর্শন হয়েছে।
কত্তাবাবা চোখ বুজলে পর অষ্টপ্রহর কীর্তন হল। রামচরিতমানস, ভাগবত পাঠ হল পনেরোদিন ধরে। লুচ্চক তিওয়ারী থেকে স্বামী পরমহংস লুচ্চক মহারাজ মন্দির হল। মার্বেলের মেঝে, মার্বেলের লুচ্চক মহারাজের মূর্তি, সোনার চূড়া মন্দিরের মাথায়।
আসল ঘটনাটা কি হয়েছিল বলি। লুচ্চকবাবু শুতে গেলেন সেদিন রোজকারের মত রাত এগারোটায়। লুচ্চকবাবুদের বহু ব্যবসা। মা লক্ষ্মী আর মা ষষ্ঠী উভয়ের কৃপাই প্রবল। সে যা হোক। লুচ্চকবাবু স্বপ্ন দেখছেন।
একটা বিরাট বড় মার্সিডিজ এসে তার গোডাউনের সামনে দাঁড়ালো। লক্ষ্মীদেবী নামলেন, সাথে যক্ষ। টপাটপ ক্যাশবাক্স খুলে, আলমারি খুলে, সিন্দুক খুলে টাকা, গয়না, সোনার বিস্কুট থলেতে ভরছেন। ভরেই যাচ্ছেন, ভরেই যাচ্ছেন, কিন্তু থলে উপুড়-চুপুড় ভরতি আর হচ্ছে না। নারদ বললেন, কেসটা বুঝছিস না, তাই তো রে পাগলা! ওগুলো সব অনলাইন ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে, ওই উপরে... বলে নারদ ছাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন তর্জনী দিয়ে।
ছাদের দিকে তাকিয়ে লুচ্চকবাবুর চক্ষুচড়কগাছ। তার সাধের অত দামী ঝাড় লন্ঠনটার উপর বসে প্যাঁচাটা, মানে লক্ষ্মীদেবীর প্যাঁচা। তিনি তাকাতেই তার দিকে প্যাঁচাটা তাকিয়ে টুক্ করে হাগু করে দিল... লুচ্চকবাবু কিছু বোঝার আগেই সেটা তার হাঁ-মুখে ঢুকে জিভের গোড়ায়। কোঁৎ করে গিলেও ফেললেন। উপায় কি, দৈবী হাগু।
নারদ বললেন, এই দিকে দ্যাখ পাগলা। নারদের ডান দিকে বিশ্বকর্মা বসে অনলাইন ট্রান্সফার করে চলেছেন। হিসাব মেলাচ্ছেন গণেশ।
লক্ষ্মীদেবীর ফোন বেজে উঠলো। নারদ চোখ টিপে বললেন, প্রভুর ফোন। বলেই মৃদুস্বরে দু'বার 'নারায়ণ নারায়ণ' বলে উঠলেন হাই তুলতে তুলতে। লক্ষ্মীদেবী ঘড়ি দেখে বললেন, জগৎ ঘড়িতে আর আধঘন্টা সোনা, আসছি।
আধঘন্টায় সব ফাঁকা। লুচ্চকবাবু মেঝেতে মাথায় হাত দিয়ে বসে। কাকে ডাকবেন? এ যে স্বয়ং দেবতার মার! পুলিশের কাছে গিয়েই বা কি হবে। এমন সময় মাথায় কার স্পর্শ, মহাদেব। লুচ্চকবাবু পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। বললেন, আপনার মেয়ে আমায় পথে বসিয়ে দিয়ে গেল বাবা! বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
মহাদেব বললেন, তুই আমার লক্ষ্মী-গণেশের পুজোই তো করে আসছিস বরাবর, না?
- হ্যাঁ বাবা, লুচ্চকবাবুর করুণ কন্ঠস্বর।
- আমায় ডেকেছিস কখনো?
- না, মানে ইয়ে, আমার স্ত্রী ডাকে যে।
- ডাক তাকে।
স্ত্রী ঝুমকিবালা এলো।
- তুই আমার ব্রত করিস তো?
ঝুমকিবালা অধোবদনে দাঁড়াল।
- দাঁড়া রেজিস্টার দেখি, অ্যাই নন্দী...
নন্দী ল্যাপটপ অন্ করল। খানিক পরেই সে ঝুমকিবালার দিকে তাকিয়ে বললেন, অমিতাভ বচ্চন কে?
লুচ্চকবাবু বললেন, আজ্ঞে তিনি তো ফিলিম স্টার, কেন?
- কারণ উনি প্রত্যেকবার শিবরাত্রিতে ওনার নামেই তো উপোস করেন, বাবার কাছে পূজো দেন।
ঝুমকিবালা হাউমাউ করে কেঁদে লুচ্চকবাবুর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল। লুচ্চকবাবু কি বলবে, কি করবে বুঝতে না পেরে মহাদেবের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু এবার কেন জানি কান্নাটা তেমন বুক ঠেলে আসছে না। তবু কাঁদলো।
সব হাপিশ মুহূর্তেই। ঘরে লুচ্চকবাবু আর ঝুমকিবালা। ঝুমকিবালা ঘুমিয়ে পড়েছে। লুচ্চকবাবু বসে। ওঠার শক্তি নেই।
এমন সময় একটা রথ এসে দাঁড়ালো। চতুর্মুখ ব্রহ্মা নামলেন। নেমেই ঘরের চারদিক চোখ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ এটাই।
লুচ্চকবাবু শূন্যদৃষ্টি। ব্রহ্মার মুখের দিকে তাকিয়ে। ব্রহ্মা বললেন, বুঝছিস না তো জীব, কি বলছি। বুঝবিই বা কি করে, মায়ায় বদ্ধ। তবে শোন রে জীব, বিশ্বচরাচর ফরম্যাটিং হবে। আমার পাসওয়ার্ড মনে পড়ছিল না। তা 'ফরগেট পাসওয়ার্ড' মারতেই তোর বাড়ির ম্যাপটা দিল। অর্থাৎ তোর বাড়ির বাইশ হাত নীচে একটা স্বর্ণকলসে ওটা রাখা আছে। এই বাড়িটা ভাঙতে হবে বুঝলি?
লুচ্চকবাবু কিছু ভাবছে না। পাশে ঝুমকিবালার নাকডাকা। হঠাৎ মনে হল তার মাথার মধ্যে একটা বিরাট জোরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। তবে কি ঘর ভাঙা শুরু হয়ে গেল?
বাকি গল্পটা আপনাদের জানা।
(ছবি - সুমন)