Skip to main content

"হতে পারে আমি শুরু থেকেই কোনো মানুষের উপর, কি কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর, কি ব্যবস্থার উপর শ্রদ্ধাহীন। আরেক হয় এক সময়ে শ্রদ্ধা ছিল, এখন বয়ে বেড়াচ্ছি নিহত শ্রদ্ধা। দ্বিতীয়টা পীড়দায়ক। কারণ বিগত শ্রদ্ধার স্মৃতি তখন আর সুখকর নয়, তখন তা মোহভঙ্গের আরেক নাম।"

নিত্য মহারাজ নিজের ডায়েরিতে এই কথাগুলো লিখে, তারপর সে পাতাটা ছিঁড়ে গিলে খেয়ে, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কারণ যে গুরুর নির্দেশে, যে গুরুকে ভালোবেসে সে জীবনের মোড় ফিরিয়েছিল, সে গুরুর প্রতি তার রাতারাতি শ্রদ্ধাভঙ্গ হয়।

নিত্য সেদিন রাতে শহরে গিয়েছিল আশ্রমের কিছু জিনিস কিনতে। রাতের বাস চলে যায়, আশ্রমে ফেরার কোনো বিকল্পপথ না থাকায় গুরুকে ফোন করে দেয় আজ শহরে থেকে কাল ভোরে প্রথম বাসে ফিরবে। শহরে থাকার কোনো অসুবিধাও ছিল না, অনেক ভক্তের বাড়ি, গেলে আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি হয় না। নিত্য মনে মনে খুশীই হয়। নিত্য জানে তার মনের মধ্যে এক ঘোর সংসারী আছে। যে ঘর চায়, স্নেহ চায়, ছায়া চায়, আদরও চায়। কিন্তু সে সংসারীকে না মারতে পারলে তো আত্মজ্ঞানের পথে পাওয়া যাবে না। আত্মজ্ঞান লাভ হলে সব দু:খ চলে যায়, একথাটা যতবার শোনে ততবার মনে মৌতাত লেগে যায়। তার চাই-ই আত্মজ্ঞান, ঈশ্বর, ভক্তি…. সব চাই। সবই এক, গুরু দিব্যানন্দ বলেন। তার সেই সুখ চাই। সে ডুবে যেতে চায়। তার কলেজের প্রফেসর ভাই, অনির্বাণ বলে, এ নাকি তার এসকেপিজিম, মানে জগতের রূঢ় বাস্তব থেকে গা ঢাকা দেওয়ার মতলব। কিন্তু তা তো নয়। জগতটাই যেখানে মায়া, নেই, সেখানে কার থেকে কে গা ঢাকা দেবে? নিত্যানন্দ তাই চায় সুখ, অখণ্ড, চিরস্থায়ী, ভয়হীন, দুশ্চিন্তাহীন জীবনের সুখ। যার আরেক নাম আত্মজ্ঞান, ঈশ্বর!

কথা অনুযায়ী এক ভক্তের বাড়ি উঠেছিল। সে ছিল ডাক্তার। সানন্দে নিত্যানন্দকে তারা রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। নিজেকে কৃতার্থ ভাবতে ভাবতে আশ্রমের অনেক গুণগান করল। নিত্যানন্দের এই যৌবনে সব ত্যাগ করে আশ্রমে যোগ দেওয়া, ঈশ্বরের পথে এগিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তকে হাজার মুখে প্রশংসা করল। নিত্যানন্দ রাতের খাবার খেতে খেতে পেট আর অহং দুইকে পুষ্ট করতে করতে শুনল ডাক্তারের ফোন এসেছে, এক রুগী ভীষণ অসুস্থ, যার বাড়ি তাদের আশ্রমের গ্রামেই। ডাক্তার বলল, যাবেন নাকি, আমি গাড়ি বার করছি।

নিত্যানন্দ সব সময় রাজী। গুরুকে ছেড়ে এক লহমা বাইরে থাকতে ইচ্ছা হয় না। গুরুর কৃপাই একমাত্র সিদ্ধ হওয়ার পথ।

======

আশ্রমের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে গেল। নিত্যানন্দ বাজার ভর্তি দুই ব্যাগ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে আশ্রমের দরজা খুলে ঢুকতেই চমকে গেল। গুরুদেবের ঘর থেকে ভেসে আসছে এক মহিলা কণ্ঠ। কেন? এত রাতে? কেউ কি কাঁদছে? কারোর কি স্বামী কি ছেলেমেয়ে মারা গেছে? কারোর কি কঠিন রোগ ধরা পড়েছে? কেউ কি স্বপ্নে ঈশ্বরের নাম পেয়েছে? কোনো ভক্তের কি ভাব হয়েছে?

নিত্যানন্দ ঘামছে। গেরুয়া ভিজে যাচ্ছে। জানে সে যা ভাবতে চাইছে না আসলে তা-ই ভেবে যাচ্ছে মনের গোপন কক্ষে, কিন্তু বাইরের ঘরে চিন্তার কিতকিত খেলেছে। আসল কথাটা কি তবে?

ব্যাগদুটো গেটের কাছে রেখে ধীরে ধীরে পা ফেলে গুরুদেবের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। দরজা বন্ধ ভিতর থেকে। আশ্রমে রাতে সে আর গুরুদেব ছাড়া কেউ থাকে না। দিনে বাকিরা আসে, মালী, রাঁধুনি, ফাইফরমাশের লোক। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল নিত্য, "কে ভিতরে? কার সঙ্গে?"

এমনভাবে বলল যেন সে বোঝাতে চাইছে গুরুকক্ষে অন্য দু’জন মানুষ… রতিক্রীড়া রত। নিত্য এখন মনের গোপন কক্ষের আওতায়। সেখান থেকে খেলছে। এখান থেকে দাবার চালের মত বুঝেসুঝে চাল দেওয়া যায়।

======

গুরুদেব বেরিয়ে এলো। বিছানায় বিবস্ত্র এক নারী। চাঁদের আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছে।

গুরুদেবের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। যেন অনেকগুলো চাল একসঙ্গে দিয়ে ফেলল গুরুদেব। চোখে চোখে দাবা খেলা এখন। কে কাকে কিস্তিমাত করে।

হঠাৎ নিত্যের দুটো হাত ধরে ফেলল গুরুদেব। ঘরে ডেকে নিল। নিত্যের শরীর অবশ হয় গুরুর স্পর্শে। ধীরে ঢুকে গেল ঘরে। গুরুদেব নিত্যের পোশাক খুলতে খুলতে বলছে, এ হে এক্কেবারে ঘেমে গেছিস যে রে! খোল খোল সব খোল।

গুরুদেবের গলায় কি এক মাদকতা। নিত্য অবশ হয়ে আসছে। তার দাবার চাল গুলিয়ে যাচ্ছে। খাটে বিবস্ত্রা নারী উঠে বসেছে। হাসছে যেন তার দিকে তাকিয়ে। স্পষ্ট দেখা যায় না। নিত্য একবার বলতে গেল, কি করছেন?

গুরুদেব কানে কানে বলল, এই ভোগ না করলে সংস্কার যাবে না নিত্য। এ বাজারি মেয়েছেলে। এরা কামকলা জানে। চৌষট্টি মতে। আমাদের এর ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কামকে জয় করতে হবে নিত্য। আয় আয়….

গুরুদেব নিজেও কখন নিজেকে নগ্ন করেছে খেয়াল করেনি নিত্য। হয় তো শুরু থেকেই তাই ছিলেন। নিত্য নিজেই মনে মনে পোশাক পরিয়েছিল।

গুরুদেব দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয়। তার হাত ধরে। বলছেন, আজ মা'ই তোকে ডেকে এনেছেন। আজ তোর এক অদ্ভুত যোগাযোগের দিন। আজ তুই সিদ্ধ হওয়ার দিকে আরো একশো ধাপ এগিয়ে গেলি নিত্য…. আহা আজ যে কি আনন্দের দিন….

দেখতে দেখতে সে মহিলা এসে তাকে পিছন দিক থেকে আলিঙ্গন করল। কানে কানে বলল, আসুন…. নিজেকে বঞ্চিত করে কেউ কিছু পায়নি কোনোদিন….. ক্ষুধার্তের খাদ্যের তৃষ্ণা না মিটলে…. রাতদিন সে খাদ্যের স্বপ্নে বিভোর থাকে… নিজেকে ঠকাবেন না আর…. আসুন… আমিও এরই দীক্ষিত… শিষ্যা…. আপনারই মত…..

=====

নিত্য কথা বলা বন্ধ করে দিল এ ঘটনার পরেরদিন থেকেই। আশ্রমে, গ্রামে ছড়িয়ে গেল ছোটো মহারাজ মৌন নিয়েছেন। সামনের অমাবস্যাতেই সিদ্ধ হবেন। এ বড় কঠোর সাধনা। ঘর থেকেও বার হতে চান না।

নিত্য সত্যিই ঘরের বাইরে আসতে চায় না আর। গোটা সংসার ধুলোঝড়ে মিলিয়ে গেছে। তার চোখের উপর ঘুমাতে গেলেই ভাসে গুরুদেবের নগ্ন শরীর। তার শরীরে জ্বালা ধরে। সে জ্বালায় সুখ, না ব্যথা বোঝে না নিত্য। তার পেটের পেশীতে মোচড় দেয়। সে ভালোবাসা চায়নি, সুখ চায়নি, সে নিরাপদ, শান্তির জীবন চেয়েছিল একটা। যাকে মানুষে বলে ঈশ্বর। এত রাগ, এত ক্ষোভ, এত বিতৃষ্ণা যে মানুষের মনে জন্মাতে পারে কোনো ধারণা ছিল না নিত্যের। ছোটোখাটো সুখ-দু:খে কেটেছে জীবন। বড় সুখ, বড় দু:খ, দুটোকেই ভয় পেয়ে এসেছে আজীবন। কিন্তু আজ একি হল তার! একে সামলাবে কি করে? যে মন শান্তি চায়, গা ঢাকা দিয়ে, গোপন কক্ষে তালা লাগিয়ে থাকতে চায়, তাকে চেনে নিত্য। তাকেই লালন করে এসেছে এতদিন নানা শাস্ত্রের প্রশ্রয়ে। কিন্তু এই বিষখাগী মনকে ঠাণ্ডা করবে কি দিয়ে? এ যে মনের গোপন ডেরা ভেঙে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে কি বিধ্বংসী উল্লাসে মেতে আছে। এ মন কি মানুষের!

====

বিষ খেয়েছিল নিত্য। অপেক্ষা করেছিল গুরুদেব আসবে। তাকে আলিঙ্গন করে বলবে, আমার সব কিছু তোর নিত্য। আমার সম্পদ যা কিছু সব তোকে দিয়ে যাব।

কিন্তু গুরুদেব আসেনি একদিনও। নিত্য বিছানা নিয়েছে শুনেও আসেনি। নিত্যের ঘোর লেগেছে, মনে হয়েছে মা মাথার কাছে বসে ডাকছে… আয় নিত্য… আয়।

নিত্য মায়ের শেষ সময়েও যায়নি। গুরুদেবের সঙ্গে কাশীতে ছিল। মন সবটুকু তো দিয়েছে একজনকে, কতজনকে দেবে আর?

নিত্য বিষ খেল। বেলায় রাঁধুনি এসে জানালো নিত্যের মুখ থেকে গেঁজলা বেরিয়ে আছে। ডাক্তার এসে জানালো মারা গেছে। পুলিশ বলল, পোস্টমর্টেম হবে। কিন্তু দায় তো তার নিজের। তাই কেউ অপরাধী নয়।

গুরুদেব বলল, সাধনার সময় ভৈরবে চড় মেরেছিল নিত্যকে। অমন হয় কারো কারো। আবার সে জন্মাবে যোগভ্রষ্ট হয়ে। সিদ্ধ হবে।

নিত্যের ফাঁকা ঘর এড়িয়ে যায় দিব্যানন্দ। কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়, ঈশ্বরের থেকে বেশি সত্যি। ভয়।

একদিন ঘরটা ভেঙেই ফেলা হল। সেখানে এখন একটা পেয়ারা গাছ লাগানো। বেড়া দিয়ে ঘেরা। গোপন কথা মন না হজম করলে গাছকে দিয়ে যেতে হয়। গাছ বছর বছর ধরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। দিব্যানন্দ সেই গাছের নীচে ধ্যানে বসে। বলে, পেয়ারা হল অমৃতফল। প্রসাদী পেয়ারা গাছ এটা। নিত্যানন্দের আশীর্বাদী।