সংসারে আশ্রিত মানুষের হাতে সংসারের ভার দিলে যে কি অনর্থ হয় তা বুঝতে বিপুলের কয়েক বছর লেগে গেল। বিপুল যেদিন প্রথম চাকরিতে জয়েন করতে গেল সেদিন সারারাত ট্রেনে যেতে যেতে একটাই কথা তার মাথায় ঘুরতে লাগল, তার মায়ের মৃত্যু আর তার দূর সম্পর্কের পিসিমার কথা। সারাটা ট্রেন বিপুল তাই ভাবল। পিসিমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সময় তার মনের ভিতর একটা প্রতিশোধের স্পৃহা যেন তৃপ্তি পেল। পিসিমা তার সাথে পুণেতে আসতে চেয়েছিলেন। বিপুল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে – না। এই না-টা বলার শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তাকে এগারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বিপুলের বয়েস এখন ছাব্বিশ। সে তখন সদ্য ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে। বাবা একদিন সন্ধ্যেবেলা পিসিমাকে নিয়ে আসেন, গ্রামের বাড়ি থেকে। তারা থাকত আগরপাড়ায়। তাদের নিজেদের বাড়ি। বিপুলের বাবা পরিতোষ রাজ্য সরকারের একটা ভালো পদে চাকরি করতেন। এই পিসিমার বাবা বিপুলের বাবার পড়াশোনায় প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। শুধু বিপুলের বাবা বলে না, উনি থাকতেন মুর্শিদাবাদের দিকে কোনো একটা গ্রামে। প্রচুর ছেলেমেয়েকেই নিজের টাকায় পড়াশোনা করিয়েছিলেন। তিনি রেলের গার্ড ছিলেন। তার মৃত্যুর পর পরিতোষবাবু খবর পান তার মেয়ে, পরিতোষবাবুর চাইতে বছর ছয়েকের বড়, বিধবা হয়ে সেই গ্রামের বাড়িতেই আছেন, তার বাবা বিশেষ কিছুই রেখে যেতে পারেননি, খুব কষ্টে দিন কাটছে তার। সেই পিসিমার এই বাড়িতে আসার সূত্রপাত।
প্রথম কয়েক বছর বিপুল কিছু টের পায়নি। সে টের পেতে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশান করার সময়। সে বোঝে সংসারের পুরো দায়িত্ব পিসিমা নিজের হাতে নিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। তার বাবা প্রতিবাদ করছেন না। তার ধারণা এতে তার মা একটু হাঁপ ছেড়ে নিজের মত বাঁচবে। বিপুলের বাবার সাথে তার মায়ের বয়েসের পার্থক্য ছিল প্রায় বারো বছরের। সেই কারণেই হোক, কিম্বা পরিতোষবাবুর অসম্ভব রাশভারি ব্যক্তিত্বের জন্যই হোক, তার মায়ের সাথে বাবার সম্পর্কটা খুব একটা সহজ ছিল না। বিপুলের মা কমলিকা চুপ করেই থাকতেন, এটাও বুঝতেন যে তার স্বামী তার গুরুকন্যার হাতে সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজেকে কোথাও একটা ঋণমুক্ত করতে চাইছেন। সেই কারণেই হয়ত কমলিকা আরো কিছু বলতেন না।
বিপুল আজ স্পষ্ট মনে করতে পারে তার পিসিমা, কানন, কিভাবে বিষাক্ত করে তোলে পুরো সংসারটা নিজের বিষে। সচেতনভাবে নয় যদিও, এটাই যেন উনি একমাত্র করতে পারতেন। অন্যথা করার মত ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই তার ছিল বলে আজ বিপুলের মনে হয় না। কিন্তু কেন এরকম হয়? বিপুল সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল। নানাভাবে তার পিসিমার চরিত্রটাকে বোঝার চেষ্টা করছিল। তার মায়ের ডায়েবেটিস ছিল। সেই হল তার মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণ। তার কারণ পিসিমার সুচতুর ষড়যন্ত্র। যে খাবারগুলো তার মায়ের খাওয়া বারণ প্রতিদিন সেই খাবার ঘুরে ফিরে পাতে চলে আসত। বারণ করা হলে চারদিন বন্ধ, তারপরের দিন আবার সেই এক, “আজ একটু কষ্ট করে খেয়ে নে নারে, কাল থেকে আবার ঠিক করে রান্নার বউটাকে বুঝিয়ে বলব, আসলে এত তাড়ায় থাকে নারে ও, কিছুই কথা শোনে না। যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে”। কমলিকা প্রথম প্রথম খেত না। তারপর বুঝল না খেয়ে তার মৃত্যু আরো ত্বরান্বিতই হবে। বিপুল বোঝে শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়েই তার মায়ের যা একটু বাঁচার তাগিদ জন্মাতো। ক্রমশঃ চেহারা ভাঙতে শুরু করল। মাঝে পরিতোষবাবুর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। যমের সাথে লড়ে বাড়ি ফিরলেন অর্ধেক জীবনীশক্তি নিয়ে। কানন যেন পুরো সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বিপুলের আজ যেন তাই মনে হয়। কিন্তু কেন? ভোগের ইচ্ছা? নিজের অবদমিত সাধগুলো পূরণের ইচ্ছা? কিন্তু সে তো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় গেলে আরো বেশি করে পেতেন, তবে কি ঈর্ষা?
বিপুলের রাতে ঘুম চলে গেল। তার গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট। চাকরির জন্য পড়ছে, কিন্তু হচ্ছে না। তার রাতের ঘুম চলে গেছে। কে আগে যাবে – বাবা না মা? বিপুলের মাথাটা পাগল পাগল লাগত। তার বারবার মনে হত মা যেন আগে যান, কারণ মায়ের চিকিৎসার খরচ আর পিসিমার কূটনীতির সাথে সে পেরে উঠবে না, না তো পারবে তার মায়ের ওই যন্ত্রণা দেখতে। তাই হল। কমলিকা সুগার ফল করে এক শীতের রাত্রে মারা গেলেন। ঘরে গ্লুকোজ আনা থাকত, যেহেতু ইনসুলিন চলত, কিন্তু সেই মধ্যরাতের চূড়ান্ত মুহূর্তে গ্লুকোজ পাওয়া গেল না। বিপুলের সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না। অনেক দিন পর রত্নাদি ঘর ঝাড়তে গিয়ে এমন একটা জায়গা থেকে সে গ্লুকোজের প্যাকেট উদ্ধার করে তাতে বিপুলের পুরো ঘটনাটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু তাও সে নিরুপায়। তার বাবার আরেকটা অ্যাটাক হয়ে গেছে। তিনি স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিয়েছেন। বাড়ি সম্পূর্ণ কর্ত্রী এখন কানন।
বিপুল বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের বাড়ি কাটায়। মাঝে কিছু বাজে নেশায় পড়ে। এক দাদাই বোঝায় যে এভাবে সব শেষ হবে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আবার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে চাকরির জন্য। দূরে দূরে ফর্ম ফিলাপ করে, যাতে বাড়ির কাছে কিছুতেই পোস্টিং না হয়। বাড়ির পরিস্থিতি আরো করুণ হতে শুরু করে। খাওয়ার অসুবিধা শুরু হয়। পিসিমার ইচ্ছা অনুযায়ী পদ হতে শুরু হয়। পরিতোষ জীবন থেকে যেন সমস্ত ইচ্ছা তুলে নিয়েছে বাঁচার। মাথাটাও ঠিক থাকে না। একদিন রাতে তবু বিপুলকে ডেকে খুব কান্নাকাটি করেন। বলেন, আমার বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল রে, নিজের ঋণের শোধ করতে তোর মায়ের জীবনটা বলিদান দিয়ে ফেললাম। বিপুল কিচ্ছু বলে না। তার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই এখন তার বাবার উপর। আগে ছিল। সে স্থির দৃষ্টিতে ভাবলেশহীনভাবে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই পর্বের শেষের অপেক্ষা করতে থাকল। জোর করে নিজেকে অন্যমনস্ক রাখছিল। মনে মনে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বাবাকে মারা গেলে কেমন দেখাবে চিন্তা করতে লাগল। এতে যদি কিছুটা অন্তত করুনা জন্মায়। জন্মালো না। ফিরে এলো।
পরিতোষবাবু মারা গেলেন। তার আগেই বিপুলের রেলে স্টেশান মাষ্টারের চাকরি হয়ে গেছে। জয়েনিং-এর অপেক্ষায় ছিল। একদিন রাতে কানন তার ঘরে এসে তার পাশে বসল। বিপুল বুঝল কেন এসেছে। সে তার মনের সমস্ত শক্তি, ঘেন্না, রাগ একটা জায়গায় জড়ো করে তীক্ষ্ণ করতে লাগল তার জিভের গোড়া। পিসিমা বলল, আমার আর তোর তো কেউ রইল না রে, আমি তাহলে বাঁধাছাঁদা শুরু করি। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে আমাদের দু'জনের, তারপর থিতু হয়ে তোর একটা বিয়ে দিয়ে আমার মুক্তি। কোনো আশ্রমেই কাটিয়ে দেব। কানন কাঁদতে শুরু করল। বিপুল এই কান্না আগে অনেকবার দেখেছে তার মা চলে যাওয়ার পর। তার ঘেন্না লাগে দেখলে। একটা কান্না এত পোশাকি, বেমানান হতে পারে তার আগে জানা ছিল না।
সে উঠে গিয়ে একটা ফাইল আনল। বলল, বাবা তোমার বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। আগামী পরশু তোমায় রেখে আসব। এ বাড়ি বিক্রি করে দেব। আমার বন্ধু, যে প্রোমোটারি করে ওর সাথে কথা হয়ে গেছে। তুমি যাও আমার এখন কিছু কাজ আছে।
কাননের মুখটা দেখতে ইচ্ছা করল খুব বিপুলের। কিন্তু সে তাকালো না। চুপ করে ল্যাপটপের স্ক্রিনে খোলা পিডিএফের পাতায় চোখ আটকে রাখল – কালকূটের ‘কোথায় পাব তারে’ খোলা। কালকূটকে বিপুল বলে তার পাতের শেষে মিষ্টি দই। বিপুল বিষটা গলায় রাখল। কোথাও একটা যন্ত্রণাও হল। সেকি নিষ্ঠুরতা করল ভীষণ? কাননের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছে। এতদিন যেন সে একটা সত্যি কান্না শুনল ওই মহিলার কাছ থেকে। তার ঘেন্না লাগল না। করুণাও হল না। কোথাও একটা প্রতিশোধের স্পৃহা তৃপ্ত হল।
অনেক রাত। ট্রেনটা কোনো একটা স্টেশানে দাঁড়িয়ে। অখ্যাত কোনো স্টেশান। সামনে একটা বড় বটগাছ। আজ বিপুলের কেউ কোত্থাও নেই। সে একা। কোনো একটা প্রাণে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। মোবাইলটা অন করল। পিসিমার নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এই একটা বিষাক্ত মানুষই তাকে চেনে। আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। আকাশ ভরতি তারা। অমাবস্যা। বিপুল মায়ের ছবিটা পার্স থেকে বার করল। জানলা দিয়ে আসা ক্ষীণ আলোয় মায়ের চোখটার দিকে তাকাতে তাকাতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মায়ের কপালে একটা চুমু খেল। হঠাৎ বাইরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, কেন সে একা হবে? তার আর কেউ না থাক কালকুট আছে। কালকূট তাকে চেনে। ব্যাগটা পাড়ল। ‘কোথায় পাব তারে’ বার করল। বুকের উপর রেখে চোখটা বন্ধ করল। মনে মনে বলল, আমায় শক্তি দাও। তোমার মত দেখার শক্তি দাও। অনুভব করার শক্তি দাও। আরো কান্না দাও। আরো ভালোবাসা দাও। আমায় এ জনসমুদ্রে স্থান দাও – যত ছোটো হয় হোক।
ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিল। সে তাকালো বাইরে। আকাশটা তার সাথে সাথে চলতে শুরু করল। মাটি পাল্টালো, আকাশ পাল্টালো না। বিপুল বইটাকে আঁকড়ে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।
সৌরভ ভট্টাচার্য
25 May 2018