Skip to main content
 
 
কপালে তিলক কেটে আয়নায় নিজের মুখটা ভালো করে দেখে ডাকল, এই ওঠ...ওঠ...
 
       ভোরের আলোয় ঘুম জড়ানো শরীরে মেয়েটা পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল।
 
       মন্দিরের দরজা খোলা হল। বাসি মেঝে মোছা হল। যুগান্তরের স্থির অভিব্যক্তি মুখে দেবতা পাথরের বেদির উপর স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
 
       ঘন্টার আওয়াজ। বাচ্চার চীৎকার। মালার গন্ধ। ধূপের গন্ধ। মন্ত্র উচ্চারণ। বিশ্বাসী মানুষদের কলরব।
 
       পুকুরের ওপারে বাসন মাজতে মাজতে মেয়েটা মন্দিরের ভিড়ের দিকে তাকাচ্ছে। পুরোহিত ভিতরে। মন্দিরের ভিতরের অন্ধকারে। এত দূর থেকে কাউকে চেনা যায় না। শুধু নানা রঙের পোশাক দেখা যায়। শুদ্ধ পোশাক। সবার স্নান করা শরীর।
 
       দুপুর গড়ায়। মন্দিরের দ্বিপ্রাহরিক অবকাশ। থালার অর্ধেকটা ভাত। পাশে দুটো তরকারি। থালার পাশে জল ভরা গ্লাস। মানুষটা গোগ্রাসে খাচ্ছে। খাচ্ছে না, গিলছে। সকাল থেকে খালি পেটে থাকতে হয়। দেবতা খালি পেটে পুজো নেন। মানুষটার জিভের লালা বন্যার মত খাবারগুলো হাজার হাত পেতে নিচ্ছে। লালার গন্ধ চেনে মেয়েটা; জিভে, ঠোঁটে, নাভিতে, যোনিতে। মেয়েটা দরজার কাছে বসে। সামনে একটা কুকুর। উচ্ছিষ্ট ভোগী। গ্রীষ্মের দুপুরের অত্যাচারী বাতাস। মুখে হল্কা লাগছে। পুকুরের ওপারে একচালা একটা ঘর। তার বাড়ি। তার বাড়ির উঠানে একটা পেয়ারা গাছ। এই পেয়ারা দেবতা নেন না। ছোটো জাতের বাড়ির উঠানের গাছের পেয়ারা, অশুদ্ধ।
 
       যৌনতা সমদর্শী। যৌনতা উদার। যৌনতা ব্রহ্মবিলাসী।
 
       চৌকির উপর ঘুমিয়ে ছাপান্ন বছরের বিপত্নীক নিঃসন্তান শিশুর মত অসহায়, দানবের মত ক্ষুধার্ত একজন পুরুষ – সমাজের দেবতাসেবক – পুরোহিত। জানলা দিয়ে আসা হল্কা হাওয়া আলনায় রাখা ধুতি, চাদরের শুদ্ধতা পরিমাপ করে যাচ্ছে। ভ্রুকুটি করছে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার তেত্রিশ বছরের শরীরের দিকে তাকিয়ে। হৃদয় বন্ধক রাখা যায়। ভয়ে। শরীর বড় অহংকারী। গ্রীষ্মের বাতাস জানে। সমাজ বাড়ে মোড়লের ঘামের গন্ধে।
 
       মেয়েটা এঁটোগুলো তুলে নিয়ে, মেঝেটা মুছে, পুকুরের এপারে বসে বাসনগুলো মেজে, আবার ওপারে গেল। তার বাড়ি।
 
 
       একা একা খেতে বসল। সকাল থেকে তারও খাওয়া হয় কই? ভালোবাসা গলার কাছে ধুতরো ফলের মত আটকে থাকে। ভালোবাসা বিষ। তার জিভ লালাহীন। মেয়েমানুষের জিভে লালা থাকতে নেই। সে লোভ। সমাজের হল্কা হাওয়ায় শুকিয়ে নিয়ে গেছে। ধর্ষক পুরুষকে ভালোবাসা যায়, আগে বিশ্বাস হত না। একদিন বিশ্বাস হল। সেদিন ছিল শ্রাবণ। আকাশে ঘন কালো মেঘ করে এলো। পুকুরের জল উঠে এলো তার উঠানে। পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের ঝড়ে ঝরে পড়া ফুলগুলো সেই জলের সাথে ভেসে এলো তার ঘরে। সেই এক উঠোন জল ঠেঙিয়ে, কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো ধুতির সাথে লাগিয়ে সেই পুরুষ এলো তার ঘরে। তাকে জিজ্ঞাসা করল, “খেয়েছিস?” 
 
       ব্যস, এইটুকুই। ভালোবাসা জন্মে গেল বিষাক্ত আগাছার মত বুকে। শিকড় ছড়িয়ে দিল জীবন থেকে মৃত্যু অবধি। বিনা সারে, বিনা যত্নে।
 
       এইটুকুই তো গল্প। সমাজ একটা বৃদ্ধ বট গাছ। তার ডালের আনাচে কানাচে এরকম অনেক ছোটো ছোটো ভালোবাসার চারা জন্মায়, সবার অলক্ষ্যে মরেও যায়। সমাজ জানতেও পারে না। সমাজ শরীর অবধি আসে। ঈশ্বর আসেন শুচিতা অবধি। অশুচি হৃদয় ডিঙিয়ে আসে একমাত্র ভালোবাসা। নইলে মানুষ সম্পূর্ণ হয় কি করে?