Skip to main content
বিপরীত

(একটা দ্বিতল বাড়ির বারান্দায় দুই বন্ধুর কথোপকথন। বয়েস আনুমানিক, পঁচিশ। একজন সংস্কৃতের ছাত্র, অপরজনের নামে রসায়ন, আদতে কিছুরই ছাত্র না।)

ছাত্র ২ঃ সব কথা বলা এত সোজা? কথার কত তলা বুকের ভিতর? কত তলা অবধি নামতে পারা গেছে বাবুরাম? কত কথায় জট পাকিয়েছে? এত সোজা হিসাব করে টকটক করে সব বলে দেওয়া?
চুপ থেকে, বেড়ালের মত নিঃশব্দে ধীরে ধীরে ভিতরে এসো। কি দেখছ? কিচ্ছু না। ফাঁকা। যেন একটা শূন্য মহলায় এসে দাঁড়ালে, একা। এই শূন্য মহলা নিয়েই মানুষের অহংকারের অন্ত নেই। ভিতরে কি জমে গা? কিচ্ছু না। সব ফাঁকি। সব ফাঁকি। যত সাজগোজ, যত হম্বিতম্বি সব ওই মহলের বাইরের চুনকাম নিয়ে।
ছাত্র ১ঃ তবে যে শাস্ত্রে এত এত ভালো ভালো কথা লিখেছে, মনের মধ্যে আলোর বাস, ঈশ্বরের বাস ইত্যাদি এইসব?
ছাত্র ২ঃ আ মোলো, তুই সে সব সত্যি ভাবিস নাকি? আরে ওসব সাধুসন্তের কথা। বড্ড হেঁয়ালি। মনের মধ্যে আলো, তা হলেই হল। যত্তসব আজগুবি কথা! ধ্যান করতে করতে মাথা গরম হয়ে কি দেখতে কি দেখত। আসলে বাবাজীবন আমার কোত্থাও কিচ্ছুটি নাই। সব শূন্য।
ছাত্র ১ঃ আচ্ছা তবে বলো, এই যে সব শূন্য – এই কথাটা তবে কে বোধ করছে? কেউ যদি না থাকে তবে এটা কে বুঝছে?
ছাত্র ২ঃ উফ্‌, এতো আচ্ছা দার্শনিকের পাল্লায় পড়লুম। তা বলি কে বুঝছে আবার, তুমিই বুঝছ।
ছাত্র ১ঃ তবে আমি কে?
ছাত্র ২ঃ ন্যাকা আমার, জানো না যেন। কার ছেলে এরই মধ্যে গুলিয়ে বসলি। আমি তোকে হাজারবার বলেছি, ওই শক্ত শক্ত বইগুলো সারাদিন পড়িসনি বাছা পড়িসনি... এবার বোঝো ঠ্যালা। আমি কে? কে অনুভব করে? আরে আপদ এই সব জানলেও কি বাজারদর কমবে? গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমবে? যে সব কঠিন কঠিন রোগব্যাধিতে লোকেদের প্রাণান্ত হয়ে যাচ্ছে তার কিছু কি সুরাহা হবে?
ছাত্র ১ঃ এসব অনুভব করছে কে?
ছাত্র ২ঃ আমার মুণ্ডু অনুভব করে বলছে আর তোর মুণ্ডু শুনছে, আবার কে?
ছাত্র ১ঃ কার মুণ্ডু?
ছাত্র ২ঃ ওগো কে কোথায় আছো আমায় বাঁচাও গো..
ছাত্র ১ঃ এই যে অসহায় বোধটা তোমার...
ছাত্র ২ঃ তুই থামবি? না গলাটা টিপে দেব?
ছাত্র ১ঃ ন জায়তে বা ম্রিয়তে বা কদাচিন্...
ছাত্র ২ঃ কি হল? মন্ত্র আওড়াস কেন?
ছাত্র ১ঃ মন্ত্র না, গীতা। বললে না, গলা টিপে ধরবে, তাই বললাম, আত্মা মরেও না জন্মায়ও না...
ছাত্র ২ঃ সে না জন্মাক, তুই তো শালা মরবি। তা হলেই হবে, তারপর আত্মা মরুক কি বাঁচুক আমার দেখার দরকার নেই।
ছাত্র ১ঃ অর্বাচীনের মত কথা বোলো না। আমি আর আমার আত্মা এক।
ছাত্র ২ঃ তবে রে আয় দিই গলা টিপে...
(গলা টিপতে উদ্যত হতেই বন্ধুর পলায়ন)
বাড়ির ভিতর থেকে দাদামশায়ের আগমন, পিছনে পিছনে প্রথম পলায়ক সংস্কৃতজ্ঞ, আত্মজ্ঞানী, ভয়ে ভয়ে।
দাদুঃ কি হে ছোকরা, কি বলেছ তুমি আমার দাদুভাইকে?
ছাত্র ২ঃ আজ্ঞে সেরকম কিছু না, ওই আত্মার অমরত্ব পরীক্ষা করতে যাচ্ছিলাম আর কি, বিজ্ঞানের ছাত্র তো, তাই সব কিছুই একটু বাজিয়ে দেখা অভ্যেস, হে হে...
দাদুঃ ভাল। তা তুমি তাহলে নাস্তিক।
ছাত্র ২ঃ আজ্ঞে সেরকমই বলতে পারেন।
দাদুঃ তা জন্ম থেকেই?
ছাত্র ২ঃ না না, একটা ব্যাঙের জন্য নাস্তিক হলুম।
দাদুঃ (ভ্রু কুঁচকিয়ে, রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে) মানে?
ছাত্র ২ঃ আসলে আমার দাদু ছিলেন খুব বৈষ্ণব। কৃষ্ণকে ডেকে ডেকে রাতদিন পাগল। তা একদিন বললেন, যে দীনহীন তার সাথে কৃষ্ণ সদা সর্বদা থাকেন। রক্ষা করেন।
তা একদিন হল কি... রথের দিন বেড়াতে বেরিয়েছি। দেখি একটা বড় কোলাব্যাঙকে একটা বড় ট্রাক এসে চাপা দিয়ে চলে গেল চোখের সামনে। তা ভাবুন, আমি ওই ব্যাঙের থেকে দীনহীন হতে পারব না? এই যে আমরা ল্যাবে ওদের ডেকে নিয়ে এসে বুক চিরে মেরে ফেলি, টুঁ শব্দটা করে না! তবেই ভাবুন, এমন অবলা (ততটা অবলা নয় অবশ্য) জীবকেও যদি কৃষ্ণ রক্ষা করতে না পারেন তবে আমাদের আর কি...
দাদুঃ (একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন) হুম সত্য বটে। সবই তাঁর লীলা।
ছাত্র ২ঃ গাঁজাখুরে গোঁজামিলে কথা। দাদুকেও দেখেছি, যেখানেই মেলাতে পারল না, অমনি বলে দিল, সবই তাঁর লীলা... দেখুন আমি পড়াশোনায় বিস্তর ফাঁকি মারি, তা বলে মিথ্যাকে মিথ্যা বলার মত জোর বা বুদ্ধি আছে। আপনাদের তা নেই কেন? কিসের এত ভয় আপনাদের? মরার? তা তাঁকে ডাকুন চাই না ডাকুন মরবেন তো নিশ্চই, হ্যাঁ কি না?
দাদুঃ আচ্ছা বলো দেখি, তুমি যা করো তাতে কোথাও তোমার কোনো সংশয় নেই? সব ব্যাপারেই একদম নিশ্চিত তুমি যে সেটাই ঠিক?
ছাত্র ২ঃ না তা কেন? তবে সংশয়টা মেনে নিই, গোঁজামিলে ঢাকি না।
দাদুঃ তবে তুমি এই বিষয়ে নিশ্চিত, এই সব ধর্ম, ঈশ্বর, মহাপুরুষেরা সব কিছুই মিথ্যা?
ছাত্র ২ঃ হ্যাঁ, সংগঠিত মিথ্যা। সব্বাই মিলে বলছে, মানছে, যুগযুগ ধরে। আর এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই ভাবতে হয় না।
দাদুর মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বললেন, "বাহ্‌, এই যে এটা পরিষ্কার করে বুঝেছ, এটাই ধরে থেকো। একেই ধর্ম বলে। কিছু মানাকে ধর্ম বলে না। কিছুকে জোর করে লাভের আশায় অন্ধ অনুসরণ করাকে ধর্ম বলে না ভাই, যেটা সত্যি বলে বুঝেছ, সেটাকে ধরে চলাই ধর্ম।"
ছাত্র ১ঃ তা কি করে হয়? কেউ যদি চুরি করা, খুন করাকে সত্য বলে মানে, সেটাই তবে তার ধর্ম?
দাদুঃ নিশ্চই! তবে তার পরিণাম বা ফলাফল যা হবে সেটাকে স্বীকার করে নেওয়াটাও তার ভাগ্য। আমার অনুভূত সত্যকে জগতে এনে দাঁড় করালে তার কি পরিণাম হয় সেটা না বুঝতে চাইলে তাকে নিজেকে সরে যেতে হবে, যদি সেটা বিশ্বসংসারের নিরিখে ভুল প্রমাণিত হয় তো।
আর যদি সে নিজের বোধের মধ্যে কিছু অসঙ্গতি দেখে তার উচিৎ সেটাকে সংশোধন করে নেওয়া। একেই তো বিজ্ঞান বলে, নাকি হে ইয়ং বিজ্ঞানী?
দুই ছাত্রই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। ঘাড় নেড়ে বলল, "হ্যাঁ।"
দাদু বলল, "চল তবে, পেটে কিছু দেওয়া যাক। আত্মা আছে কি না এ নিয়ে সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু পেট? তা নিয়ে তো কোনো মতবিরোধ নেই, কি বলো?"
দুই বন্ধুই 'হো হো' করে হেসে উঠল... সাথে দাদুও...


(ছবিঃ সুমন)

Category