Skip to main content

আজ বলে না। নরহরিবাবুর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা মা কালীর নামে একটা জীবনবিমা করেন। ডেট অব বার্থ নিয়ে একটু সমস্যা আছে, কিন্তু নরহরিবাবুর শালা সুড়ঙ্গ সিকদার সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। সুড়ঙ্গবাবু পেপারমিলে কাজ করেন। সাইডে হাত দেখার ব্যবসা থুড়ি সাধনা। খোদ কামাখ্যায় গিয়ে রপ্ত করেছেন, সুড়সুড়িবাবার কাছে। তিনিই তার বলাইচাঁদ নামটা এপিঠ-ওপিঠ করিয়ে সুড়ঙ্গ সিকদার করেছেন।

        তো হল কি, নরহরিবাবু রোজই মন্দিরে যান, দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, কামাখ্যা, তারাপীঠ কিচ্ছু বাকি রাখেননি, কিন্তু কেউ রাজি নয়। আজ এসেছেন রামপ্রসাদের ভিটেতে। যদি রাজি করানো যায়। কি এমন লাগবে, একটা ফুল সাইজ ছবি, দেবোত্তর সম্পত্তির দলিলের ফটোকপি, আর মায়ের একটা আঙুলের ছাপ। তাও দেবে না? কি হাড়বজ্জাৎ লোকগুলো? কেন রে? মা কি তোদের একার? নিজেদের ভবিষ্যতটা তো বেশ গুছিয়ে নিলি নকুলদানা, কালাকাঁদ, লাড্ডু ঠেকিয়ে। এবার ওনার ভবিষ্যৎটা ভাব? বলি দেশে যে হারে নাস্তিকের সংখ্যা বাড়ছে! আর আস্তিকই বা বলি কাকে? সব শালা অনাচারীর দল!
        নরহরির প্রাণটা কেঁদে উঠল। রামপ্রসাদের ভিটের এক কোণে বসে অস্ফুটে বললেন, "মা!" বাইরে তখন কেউ বেসুরো গলায় রামপ্রসাদী গাইছে। তা গাইবে না? কেউ তখন বুদ্ধি করে গানগুলোর বীমা করেছিল? কেউ করে নি? অমন সরলসোজা মানুষটার গানগুলো নিয়ে কি নয়ছয়ই না করেছে! রবীন্দ্রনাথ কিরকম বীমা করে গেছিলেন সব গানগুলোর? কি বললেন, কপিরাইট? ওই একই হল যত্তসব। ওই সুক্ষ্মবিচার করেই তো বাঙালী জাতটা শেষ হয়ে গেল, কি বলেন?
        নরহরিবাবু বাইরে এসে দাঁড়ালেন। আকাশের মুখভার। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। মা গো মা! কেউ ভাবে না তোর কথা! সব স্বার্থপরের দল! হাড়হাবাতের দল!

"এই যে দাদা শুনছেন?"
নরহরিবাবু কিছুটা আত্মমগ্ন ছিলেন। সম্বিৎ ফিরে তাকিয়ে দেখেন, বেঁটেখাটো ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবী পরা বিকট দেখতে একটা লোক। বয়েস তারই মত পঞ্চান্ন'র আশেপাশে হবে।
- কি বলছেন? বিরক্ত হয়েই বললেন নরহরিবাবু। আকাশের দিকে তাকালেন। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ফিরতে হবে। রাত হচ্ছে। তার বাড়ি গঙ্গার ওপারে, কোন্ননগর।
- বলছিলাম, আমি কেসটা জানি। আপনি মায়ের বীমা করাবেন তো?
চমকে উঠলেন নরহরিবাবু। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
- আজ্ঞে আপনি আর পুরোহিত মশায় যখন কথা বলছিলেন আমি শুনেছিলাম।
- বটে? তা কি করা হয় আপনার?
- তা দাদা মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলব না। এই একটু হাতযশ-টশ আছে। তাতেই চলে যায়।
        নরহরিবাবুর চক্ষু কপালে ওঠার যোগাড়। তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন ওয়ালেটটা আছে কি না।

        হাত কচলে, খুব নম্র হয়ে লজ্জিত গলায় বেঁটেমানুষটা বলল, না স্যার ওটা ঠিক জায়গাতেই আছে। পটলা মারতে চেয়েছিল। আমি বারণ করলুম। সেম ব্যবসায় এসব চলে না স্যার!
- মানে? নরহরিবাবু মানেটা বুঝেও না বোঝার ভাণ করলেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেজায় চটেছেন। শালা, চোর বজ্জাতের দল! যাক গে ভুলভাল বলে লাভ নেই। রাত হচ্ছে। এদের আবার গুণের অন্ত নেই কিনা!
- তা কি চান? যতটা সম্ভব গলাটা ভারি করে বললেন নরহরিবাবু।
- নমিনি হতে স্যার। আমি আর পটলা। আপনি মায়ের নামে বীমা করুন। আমরা নমিনি হব।
        আর রাগ চেপে রাখতে পারলেন না নরহরিবাবু। প্রচণ্ড ক্ষেপে মুখ থেকে একটা 'ব'কারান্ত শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছিল আর কি। লোকটার চোখের নীচে ভোজালি কোপানো দাগটা দেখে সামলে গেলেন। ও দাগ তার চেনা। তার পিসের ছিল। ছেনো মস্তানের ডান হাত ছিলেন তার পিসে।
- সে হতে পারে না, নরহরিবাবু বিরক্তির সুরে বললেন।
- কেন হতে পারে না? তবে কে হবে শুনি?
- যমরাজ।
        নরহরিবাবুর উত্তরটা আগেই ভাবা ছিল। সব দেব-দেবী হারিয়ে গেলেও যমরাজ তো থেকেই যাবে না?
        বেঁটে লোকটা হো হো করে হেসে উঠল। পাশে পটলাও। বলল, বিকলুকে হাসালেন কত্তা! তা যমরাজকে চেনেন? দেখেছেন কখনও?
        নরহরিবাবুর মটকা পুরো গরম। শালা চোরের বাচ্চা তাচ্ছিল্য করে হাসে? তিনি ব্যঙ্গ করে বললেন, তা তুমি যেন তার বাড়ির পাশে থাকো?
        বিকলু গম্ভীর হয়ে বলল, থাকতে দিলে তো? শালা সেই কবে খাল্লাস হয়েছি আমি আর পটলা পুলিশের এনকাউন্টারে। কিন্তু রায় বেরোচ্ছেই না। আগে মন্ত্রী, উচ্চপদাধিকারী ক্রিমিনালদের কেস সাল্টানো হয় তারপর আমাদের মত।
        এবার নরহরিবাবু ঘামতে শুরু করেছেন। তার মানে তোমরা...?

        বৃষ্টি অনেকক্ষণ শুরু হয়েছে। নরহরিবাবু মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজছেন। মন্দিরের লোকজন তার দিকে তকিয়ে। একজন এসে বলল, কি দাদা হেব্বি মাল চড়িয়েছেন নাকি? এই বৃষ্টিতে কার সাথে একা একা কপচাচ্ছো চাঁদু? বয়েস তো কম হল না!


        নরহরিবাবু বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু নতুন উৎপাত শুরু হল। বিকলু আর পটলা যখন তখন হানা দেয়। পায়খানায়, ঠাকুরঘরে, অফিসের মিটিং, ট্রেনে বাসে। খালি বায়না - নমিনি করো, নমিনি করো।
        অবশেষে তিনি আর তার শালা সুড়ঙ্গবাবু বৈষ্ণোদেবীতে গেলেন। ওখানে আধারকার্ড ছাড়া ভূতেরাও অ্যালাওড না। তা খোঁজ নিয়ে জানা গেল বিকলু আর পটলার ইন্তেকালের সময় আধারকার্ডের ব্যবস্থা হয়নি।
        সেই পূজো দিয়ে ইস্তক নরহরিবাবু শান্তিতে আছেন। আর ভুলেও মায়ের বীমার কথা স্বপ্নেও আনেন না।