Skip to main content

লোকটা হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা হবে। এই গ্রামের দিকটায় এই সময়টা শীতকালে বড় একটা বাইরে কাউকে দেখা যায় না। চারদিকের বাড়িগুলোর জানলা বন্ধ। লোকটা একা একাই হেঁটে চলেছে। মাথাটা মাফলার আর কান ঢাকা টুপিতে মোড়া। শুধু চোখদুটো বেরিয়ে আছে।
  লোকটা অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। অন্যমনস্ক হলে মানুষ জোরে জোরে হাত দোলায়। একটা হাতের সাথে আরেকটা হাতের সামঞ্জস্যতা থাকে না। ঘাড় একদিকে একটু কাত হয়ে আছে। লোকটা ভীষণ অন্যমনস্ক।
   আচমকা লোকটা থমকে গিয়ে থেমে গেল। একটা কিছু শুনতে পেয়েছে। হ্যাঁ ঠিক। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। লোকটার ভয় কম। ঝোঁপের মধ্যে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, স্ট্রিট লাইটের আলোটা জোরালো না। আরে বিলু জ্যাঠা না! লোকটা তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে বুড়ো মানুষটাকে ধরল। সে বুড়োটা কাঁপছে। লোকটার বেশ পেশীবহুল চেহারা হতেও ধরে রাখতে পারছে না।
লোকটা থরথর করে কাঁপছে। আচমকা বুড়ো মানুষটা লোকটার হাত পিছলে মাটিতে পড়ে গেল। লোকটা বুড়োটার মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমায় চিনতে পারছেন? আমি মিত্তিরদের বাড়ির ছোটছেলে নকুল। আমার বিয়েতে গিয়েছিলেন গত বছর মনে আছে মাষ্টারমশাই?
   আসলে নকুল নার্ভাস হয় গেছে, তার মনে হচ্ছে ওনার হয়তো হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, ওনার বরাবরই হার্টের অসুখ। নকুল জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি বুকে ব্যাথা হচ্ছে?
  কোনো উত্তর নেই। নকুলের মনে পড়ল আরে এখানেই তো ওনার বাড়ি ছিল না? সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে সামনের বাঁক ঘুরেই তৃতীয় বাড়িটার কলিং বেল বাজালো। অপেক্ষা করল। প্রতি সেকেণ্ড মনে হচ্ছে এক এক ঘন্টা। কেউ সাড়া দিল না। নকুল আবার বেল চিপল। ওর ঘাড়টা নাড়াচ্ছে। মানুষ উদ্বিগ্ন হলে একটা না একটা মুদ্রাদোষের লক্ষণ বেরিয়ে আসে। নকুল ঘাড় দোলায়। আরেকবার চিপবে? চিপল না। ডাকল...এই লকা...লকা...(লকা বিলু মাষ্টারের ছেলে। মিলে কাজ করে)। কোনো সাড়া নেই। আবার বেল চিপতে যাবে এমন সময় পাশের বাড়ির জানলটা খুলে গেল। নকুল দেখল দেওয়ালে আটাকানো একটা টিভিতে কোনো বাংলা সিরিয়াল চলছে। এতক্ষণ টিভির আওয়াজটা ধীরে ধীরে আসছিল, জানলা খুলতেই আওয়াজটা লাফিয়ে পড়ল বাইরে। সাথে এলো ঘরের টিউবের আলো। একটা বউ মুখ বাড়িয়ে বলল, আপনি ওদের কে হন? আগে তো দেখিনি। বিলুদার বডি তো এখনও ছাড়েনি হাসপাতাল থেকে। লকা আর বৌদি সেই কখন গেছে। আরে টিভির সাউণ্ডটা কমা নারে কুলু...(ঘরের ভিতর তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল)...তা আপনি ভিতরে আসুন...একটু চা-টা খান...
   নকুল খেয়াল করল একটা বাচ্চা মেয়ে গিয়ে টিভির রিমোটটা নিল,...ধীরে ধীরে সাউন্ড কমিয়ে কার হাতে একটা রিমোটটা দিল...হাত বাড়িয়ে রিমোটটা নিল বিলুজ্যাঠা, তার দিকে তাকিয়ে হাসল।
    নকুল কি একটা বলতে যাবে হঠাৎ দেখল তার সামনে পুরো অন্ধকার। পাশের বাড়ির জানলা বন্ধ। ভালো করে বিলুজ্যাঠার দরজার কাছে গিয়ে দেখল দরজায় তালা দেওয়া। সে দরদর করে ঘামছে এবার। পাশের বাড়ির থেকে বিজ্ঞাপনের আওয়াজ আসছে টিভি থেকে।  আচমকা মনে হল কে যেন বলল, ভিতরে আসুন...চা হয়ে গেছে...
   সে বাড়ির ভিতরে এলো কখন!...মনে করতে পারছে না...তার ডান দিকে বিলুজ্যাঠা বসে...তাকে কি একটা বলার চেষ্টা করছে...লকাটাকে যদি একটা ভালো কাজে ঢুকিয়ে দাও নকুল..
      .সে দরজা ঠেলে ছুটতে শুরু করল বাইরে...কিছুটা যেতেই আবার গোঁ গোঁ শব্দ...বিলুজ্যাঠা শুয়ে গোঙাচ্ছে...
    কিছু বুঝতে না পেরে সে বিলুজ্যাঠার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে...হঠাৎ পিঠে একটা হাত লাগল...লকা...সে হেসে বলল, নকুলদা আপনি রিমোটটা নিয়ে চলে এসেছেন...
    নকুল ছুটছে...রাস্তার আলোগুলো মনে হচ্ছে এক একটা বিজ্ঞাপনের মত তার দিকে তাকিয়ে আছে...তারাও ছুটছে তার সাথে সাথেই...
   নকুলের ঘোর কাটল মোবাইলের রিঙে। চমকে উঠে দেখল ট্রেন কাঁচরাপাড়া ছাড়ছে...যাক...সে নামবে পায়রাডাঙা...ফোনটা কানে দিল...
  হ্যাঁ গো শুনছো...কখন থেকে রিং করছি...বিলুজ্যাঠা সকালে এসেছিল...বলে গেছে স্টেশানের পাশে ভুতোর দোকান থেকে রিমোটটা নিয়ে আসতে...ওদের রিমোটটা খারাপ...এবেলা এনে দেবে বলেছে ভুতো...
    নকুল ফোনটা না কেটেই পকেটে ভরে ফেলল। বাঁ হাতে মুখের লালটা মুছে নিল। তারপর কি মনে হল, ধীরে ধীরে হাতটা নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধটা শুঁকল। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। ঠাণ্ডাটা ভালোই পড়ে গেছে।  
    আবার ফোন...
    অ্যাই শোনো... বিলু জ্যাঠা...