Skip to main content
বিলাসী

 

---
কিছুটা হলেও টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল বিলাসী। বয়স চল্লিশের আশেপাশে। বাড়ি মুকুন্দপুর। হরিনাভীতে স্বামীর ভিটে। মেয়েটাও তার সাথে কাজে বেরোতো। গীতা। উনিশে পড়েছিল এই মাঘের শেষে। বিলাসী চারটে বাড়ির ঠিকে ঝি-র কাজ করত। তার স্বামী মদন ভাগের চাষ করত। ছেলেটার বিয়ে দিয়েছে গত শ্রাবণে। নেতাই আর তার বৌ কামিনী। নেতাই চব্বিশে পড়েছে। আর কামিনীর বয়স ওই গীতার মতই হবে।
      সেদিন বাড়ি ফিরেই গীতা বলল ভীষণ মাথা ধরেছে। শুয়ে পড়ল। পরেরদিন সকালে সব ঠিক আবার। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই মাথাব্যাথা। একবার তো দিদিমণিদের বাড়িতে ঘর মুছতে মুছতে অজ্ঞান হয়ে গেল। সে কি কান্ড! হাসপাতালে দেখানো হল। তারা বলল, ব্রেন টিউমার। অপারেশান করতে হবে। অনেক টাকা! বিলাসী গয়না বেচল, গ্রামের কয়েক ছটাক জমি ছিল, সেটা বেচল। বউমা তার গয়নাও দিতে চাইছিল। সে নেয়নি। এক্কেবারে হাত ফাঁকা করে দিও না বউমা, বলেছিল সে। তবু সে তার কানেরটা নাকেরটা দিয়েছিল। গীতার সাথে তার খুব ভাব। গীতা ওরকম নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে বলে খুব কাঁদে বিলাসী আর কামিনী।
      অবশেষে গীতা মারা গেল। টাকা যথেষ্ট জোগাড় করা গেল না। বিলাসী কেমন যেন পাল্টে গেল। মেয়েটাকে দাহ করে শ্মশান থেকে সোজা কাজে চলে গেল বিকালে। তারা বললে, তোমার এখন অশৌচ বিলাসী, তুমি বেরিও না। সে 'হাঁ' করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কথাগুলোর মানে বুঝল না। শুধু বুঝল তাকে বাড়ি ফিরতে হবে।


---
বিলাসী সেদিন বাড়িতে সেই যে ফিরল, এক মাস বেরোলো না। কারোর সাথে কথা বলত না। খেত, না খাওয়ারই মত। চেহারা কঙ্কালসার হল। তবু সে বেঁচে রইল। আবার কাজে যেতে লাগল।
কিন্তু এবার তার একটু গোলমাল হতে লাগল। বাড়ি ফিরত যখন সন্ধ্যেবেলা প্রায়ই সে গীতাকে দেখত তার সাথে হাঁটতে। কখনো মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত তার জন্য। কখনো পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। বিলাসী কত আদর করত তাকে। সে কথা বলত না। চুপ করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখত। ওর মাথার পিছন দিকে একটা মস্ত ফোঁড়া। তারপর গীতা ধীরে ধীরে এগোতে থাকত। বিলাসী তার পিছনে পিছনে। আবার হঠাৎ করে উধাও হয়ে যেত গীতা।
      এভাবেই চলতে লাগল। কামিনী মেনে নিয়েছে তার শাশুড়ি আর আগের মত নেই। ইতিমধ্যে তার একটা ছেলে হয়েছে - পলাশ। বিলাসী কয়েকদিন একটু নাতি কোলে করে ঘুরল। তারপর আবার যেই কে সেই।
       আবার সেই চুপচাপ থাকা। বাড়ি দেরি করে ফেরা। 'কেন দেরি হল' জিজ্ঞাসা করলে কোনো উত্তর নেই। বিলাসী যেন সে বিলাসী নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিলাসীর স্বামী মদন।


---
মদন মারা গেল মহালয়ার দিন। দু'দিনের জ্বরে। পলাশ এখন চার বছরের। বিলাসী এখনো ঠিকে ঝি-র কাজ করে। তবে এখন সে শুধু দেরি করে ফেরে তাই নয়, মাঝে মাঝেই ফেরে না। নিতাই যায় খুঁজে আনতে।
      ইদানীং বিলাসী মদনকেও দেখছে গীতার সাথে। সে শুধু চেয়ে থাকে তার দিকে। তার চোখ লাল। খুব অভিমানী হয়ে গিয়েছিল মদন মারা যাওয়ার আগে। রাত্তিরে বিলাসীকে মদন ছুঁলে, বিলাসীর লজ্জা করত। তা করবে না, গীতা যে ঘরের কোণায় বসে! ছি ছি! সে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ত।
     এখন সে মদনকে দেখে গীতার সাথে। আবার আলাদাও। বিশেষ করে যখন সে নাইতে ঢোকে।
     কামিনী বোঝে না কি হচ্ছে। ইদানীং তার শাশুড়ি খুব সাজছে। স্নান সেরে এসেই স্নো-পাউডার মাখে। তার বেণারসীটাও পরেছিল পূজো করার সময়। সারাদিন কার সাথে যেন ইশারায় কথা বলে। কামিনীর খুব ভয় করে। সে যত ভয় পায়, তত কাঁদে। এখন সেও কয়েকটা বাড়ি কাজ ধরেছে। বাড়িতে একা থাকলে তার পাগল পাগল লাগে।


---
সেদিনও নিতাই কাজ থেকে ফিরে শোনে, মা ফেরেনি। সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। এর আগে মাসে প্রায় তিনবার একই ঘটনা ঘটেছিল। বিলাসী হঠাৎ উধাও। ইদানীং ঘটনাটা বেড়ে গিয়েছিল। গত দু'বার নিতাই বিলাসীকে একবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আর একবার পিজি হাসপাতালের সামনে থেকে পেয়েছিল। তাও প্রায় দু'সপ্তাহ খোঁজাখুঁজির পর।
      সারারাত নিতাই আর তার বন্ধুরা খুঁজল। পরের কয়েকদিন কলকাতার সব হাসপাতাল চষে বেড়ালো। কোত্থাও পেলো না।


---
বিলাসী কোথায় যাচ্ছে জানে না। শুধু দেখছে প্রচুর লোক চারিদিকে। মাইকে কি সব বলছে। গীতা চলেছে তার সামনে সামনে। তার হাত ধরে মদন। এটাই কি হাওড়া স্টেশান? বিলাসী ভেলোর যাবে। গীতাকে নিয়ে। যে বাড়িতে সে কাজ করে তাদের বাড়ির বৌটাকে ভেলোরে নিয়ে গিয়েছিল। সে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। সেও তাই যাবে ভেলোরে।

      আজ বারো বছর হল। পন্ডিত বিধান দিয়েছেন, বারো বছর কেউ নিরুদ্দেশ থাকলে তার শ্রাদ্ধ করতে হয়। কামিনী আজ আর কাজে যায়নি কোনো বাড়ি। পলাশ এখন অনেক বড়। বাবার সাথে জোগাড়ে কাজ করে। ইতিমধ্যে একটা মেয়েও হয়েছে ওদের, বৈশাখী।
     পুরুত মন্ত্র পড়ছে। নিতাই আসনে বসে। নেড়া মাথা। কামিনীর চোখ মাঝে মাঝেই ঝাপসা হয়ে আসছে। শাশুড়ির মুখটা, গীতার মুখটা মনে পড়ছে। সে বার বার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, যদি বিলাসী এসে পড়ে। কেউ সাদা শাড়ি পড়ে এদিকে এলেই তার মনে হচ্ছে, মা!
     নিতাই আসনে বসে পুরুত যা বলছেন করে যাচ্ছে। পলাশ পাশে বসে। পলাশ হঠাৎ বলল, বাবা যতই ছাদ্দ করো, আমি কাল ঠাকুমারে খুঁজতি গেরামের দিকে আবার যাবোই..., পলাশ উঠে গেল। নিতাই-এর চোখদুটো চিকচিক করে এলো। সে অস্ফুটে বলল, যাস।

(ছবি - সুমন দাস)