সে সদ্য স্কুলে যাচ্ছে। তার নাম অজন্তা সরকার। তার বাবার লটারির দোকান। লক্ষ লক্ষ টাকা পাওয়া যেতে পারে টিকিটের নাম্বার মিলে গেলে। তার বাবা ইচ্ছা করে কাটে না। অত টাকা নিয়ে কি হবে? তার চাইতে অন্যরা পাক। সবাই বাবার দোকান থেকে লটারির টিকিট কাটে, সবাই টাকা পায়। গাড়ি কেনে। জামা কেনে অনেক। লজেন্স কেনে প্রচুর। জুতো কেনে লাল, নীল, কমলা, সবুজ --- অনেক অনেক। বাবা খুশী থাকে। মা খুশী থাকে। সে-ও খুশী থাকে।
এই তো, আজ মা পুজোর বাজার করতে যাবে। অত অত জিনিস কিনবে না, অল্প অল্প জিনিস কিনবে। কেন বলো তো? কারণ তাদের বাড়িটা তো ছোটো। অত জিনিস কিনলে রাখবে কোথায়? আর সব জিনিস যদি তার মা'ই কিনে ফেলে, তবে অন্য বাচ্চারা কি কিনবে? এবারে তা-ও তো তার দুটো জামা হয়েছে। আরেকটাও হতে পারে মা বলেছে। মা যে আণ্টির বাড়ি টিপ বানাতে যায় সে দেবে বলেছে।
মা বাজারে গেছে। তাকে কোথায় রেখে যাবে? একা তো রেখে যাওয়া যায় না। তাকে এত্ত সুন্দর দেখতে যে আকাশ থেকে পরীরা এসে তাকে নাকি যখন তখন নিয়ে যেতে পারে। তাই মা বলেছে অজানা, অচেনা লোক ডাকলে, না যেতে। কিছু খেতে দিলে, না খেতে। পরীরা ওরকম সেজে আসে তো!
কথাটা তো সত্যিই। তাকে খুব সুন্দর দেখতে। আয়নায় দেখেছে তো সে নিজেকে। মা তাই বাবার দোকানে তাকে রেখে গেছে। বাবা চিপ্স কিনে দিয়েছে। একটা ক্যাডবেরি কিনে দিয়েছে। এখন সে তাই চেয়ারের উপর একটা কাগজে নিজের নাম লিখতে চাইছে। কিন্তু বানানটা বাবা না বলে দিলে কি করে লিখবে? বাবা গল্প করছে আঙ্কেলদের সঙ্গে, টিকিট বিক্রি করছে আর মাঝে মাঝে তাকে বানান বলছে, এ….. জে…. এ…. এন….. টি…. এ…. অজন্তা।
এমন সময় মা এলো। মায়ের মুখটা কেমন। ভয় পেয়েছে যেন খুব। মায়ের টাকার ব্যাগটা ভিড়ে তুলে নিয়েছে কেউ। বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, তুলে কেন নেবে… নিশ্চয়ই পড়ে গেছে রাস্তায়….
তাই তো! কেউ কেন টাকার ব্যাগ তুলে নেবে? তাদের তো অত টাকা নেই। আর দরকার হলে বাবার কাছে চাইলেই তো বাবা একটা লটারির টিকিট দিয়ে দিত। লক্ষ টাকা পেয়ে যেত। বোকার মত কেউ ব্যাগ তোলে?
কিন্তু আজ তার জন্যে একটা জুতো কেনার ছিল। তার মনটা একটু খারাপ হল। রাস্তার ওদিকে একটা বড় জুতোর দোকান আছে। দোকানে সব সময় এসি চলে। সব জুতোগুলো ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। তার তো ও জুতো পরলেই ঠাণ্ডা লেগে হাঁচি শুরু হয়ে যাবে। তাই বাবা নিয়ে যায় না। সেও যেতে চায় না।
মা বলল, আমরা ক'দিন পর জুতো কিনি সোনা?
সে বলেছে নাকি কিনতে? এখন বড়দের মত কথা বলতে হবে। সে গম্ভীর করে গলাটা, বাবার মত করে, বলল, তোমরা কি নতুন জুতো পরবে? আর তাছাড়া বাবা তো একটু ভিড় হলেই আমায় কোলে নিয়ে নেয়। নতুন জুতো কিনেই বা কি হবে? তার চাইতে পুজোর পর, রাস্তা ফাঁকা হলে না হয় নতুন জুতো কিনব।
তার বাবা তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নিল। বলল, বাব্বা এতো এতবড় একটা বাচ্চা দেখি… তবে তো চা খেতেই হবে….
বাবা এটা সব সময় করে। সে বড়দের মত কথা বললেই তাকে চা দেয়। তারা একসঙ্গে চা খায়। একবার দিদুনের শরীর খারাপ যখন, তার জন্য নতুন ক্লাসে নতুন ব্যাগ কেনা হল না… কি করে হবে… ডাক্তার আঙ্কেলকে টাকা না দিলে ডাক্তার আঙ্কেল কোত্থেকে ইঞ্জেকশন কিনবে?… সে এই কথাটা বলেছিল বলে সেদিন মা তাকে নিজে নিজে মাছ বেছে খেতে দিয়েছিল, এক্কেবারে বড়দের মত। তারপর তো দিদা ঠাকুরের কাছে চলে গেল। ঠাকুরের নাকি অনেক বড়ি দেওয়ার দরকার। দিদা কি সুন্দর শাড়ির উপর বড়ি দিত! ঠাকুর আকাশে লম্বা শাড়ি পেতে দেয়, দিদা টুক্ টুক্ করে বড়ি দিয়ে যায়। দিদার বড়ি দেওয়া হয়ে গেলে আবার ফিরে আসবে তো….
সে এখন চা খাচ্ছে। কিন্তু বাবা কোল থেকে নামাচ্ছেই না। কোলে করে কেউ চা খায়? বাবাটা বাচ্চা… বোঝেই না কিছু!