বইয়ের পাতাগুলো একটা বাঁধুনিতে বাঁধা থাকে। খেয়াল পড়ে না। পাতার পর পাতা উলটে যাই, অক্ষরের মর্মে অবগাহন করি, কিন্তু বাঁধুনির কথা মনে থাকে কি?
তেমনই অবস্থা শিক্ষাঙ্গনের। শিক্ষা বহমান, আর সে বহমান স্রোতের অববাহিকা শিক্ষাঙ্গন।
আমরা 'বিদ্যালয়' বলি না আজকাল। "মা আমি বিদ্যালয়ে যাচ্ছি" - কেউ বলে না আজকাল। আমরা বলি 'স্কুল'। 'স্কুল' শব্দের উৎপত্তি গ্রীক শব্দ 'skhole' থেকে, যার একটি অর্থ, অবকাশ। আরেকটি অর্থ, ভাষণ দেওয়ার স্থান। আমার প্রথম অর্থটি বেশি ভালো লাগে।
অন্যদিকে বিদ্যালয় বলতে, যে 'আলয়' শব্দটা চলে আসে, সে শব্দের অর্থ কি শুধু স্থান? 'দেবালয়' শব্দটা যখন বলা হয় তখন যে 'আলয়' শব্দটা আসে? 'আলয়' শব্দকে ভাঙলে একটা অর্থ আসে, যেখানে প্রবেশ করলে কেউ লীন হয়ে যায়। আমার এ অর্থটাও ভীষণ ভালো লাগে। বিদ্যায় আর ভক্তিতে লীন হওয়ার অবকাশ থাকে। তাই 'বিদ্যালয়' আর 'দেবালয়' শব্দের উৎপত্তি। বিদ্যা আর পরমাত্মা, দুই-ই অসীম। তবে 'আলয়' শব্দের অর্থ কি? সেখানে আমরা তাকে বিশেষভাবে পেতে চাই। তাই আলয়।
আমি 'স্কুল' শব্দতে আসি। স্কুলের গেট, স্কুলের মাঠ, স্কুলের বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড, স্কুলের টয়লেট, স্কুলের গন্ধ, স্কুলের মাঠের গাছ, স্কুলের ধুলো, স্কুলের সাইকেল স্ট্যাণ্ড, ল্যাব, টিচার্সরুম, হেডমাষ্টারের রুম, আমার ক্লাস, আমার নির্দিষ্ট বসার জায়গা, আমার বন্ধুদের হাসি, ফাজলামি, মজা, তাদের ঘামের গন্ধ, টিফিনের গন্ধ, ঘন্টার আওয়াজ, পাখার আওয়াজ, জানলার বাইরে উদাস রোদের পড়ে থাকা বুক চিতিয়ে, রেনি ডে, রোল কলে আমার সংখ্যা আসার আগে সতর্ক হয়ে থাকা, স্যার-ম্যামেদের হাঁটা, তাকানো, হাসি, রাগ, আমার হেরে যাওয়া, জিতে যাওয়া, অপ্রস্তুত হওয়া, দৌড়ানো, পড়ে যাওয়া, জ্বর আসা, পেটে মোচড়, আচমকা মায়ের জন্য মন খারাপ - এ সবের সাক্ষী কে? শিক্ষাঙ্গন। সে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখে। এত কিছুকে একা ধারণ করে রাখে। অনেকদিন পর যখন স্কুলে ঢুকি, সে-ই সবার আগে এসে নিঃশব্দে অভ্যর্থনা জানায়, বলে এতদিন আসোনি যে? আমি বলি, জ্বর হয়েছিল তো।
আজ শিক্ষা চলছে, কিন্তু শিক্ষাঙ্গন থেকে দূরে। শিক্ষাঙ্গন বাদ মানে যে কত কিছু বাদ, সেটা কেবল হিসেবীবুদ্ধিতে ভরা মাথাওয়ালা মানুষ বুঝবে না। সে বুঝতে গেলে দরদী হতে হবে। দরদ ছাড়া তথ্য দেওয়া যায়, শিক্ষা দেওয়া যায় না। শিক্ষাঙ্গন সেই প্রচ্ছন্ন দরদ। তাকে ঘিরে ঘিরে যা কিছু তৈরি হয়, সে তাকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়।
এবার ধীরে ধীরে শিক্ষাঙ্গনগুলো খুলে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে হয় তো। অন্তত বেশ কিছু চিকিৎসকের মত তো 'হাঁ' এর দিকে। ওদের পায়ে ধুলো লাগুক। বইয়ের পাতার বাইরে আসুক ছোটাছুটি, হাসাহাসি, মজার লড়াই, খেলাধুলা সব।
মানুষ নিজের বয়সকে নানাভাবে আবিষ্কার করে একমাত্র শিক্ষাঙ্গনে। বাদবাকি অন্য জায়গায় তো সে কোথাও স্নেহের পাত্র, কোথাও আদরের, কোথাও শাসনের। একমাত্র বন্ধুদের মধ্যে সে সে-ই। সেখানে সে কারণ বারণ শোনে না। কারোর কাছে কৈফিয়ত দেয় না। সেখানে সে তার ইচ্ছাকে নানাভাবে খুঁজে পায়। আর সেই ইচ্ছার ভাষায় নিজেকে আবিষ্কার করে। দীর্ঘদিন তাকে এর থেকে বঞ্চিত রাখা রীতিমতো অন্যায়। খুলুক খুলুক। আবার হইচই করে উঠুক শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষাঙ্গন বাঁচলেই সত্য অর্থে শিক্ষা আবার প্রাণ পাবে। শিক্ষাঙ্গন শুধু তো ভালো আর কৃতিদের স্মরণের জায়গা নয়, আমার মত বহু ব্যর্থ, অকৃতিদেরও সুখময় স্মৃতির স্থান। সে সুখটুকু কেন কেড়ে নেওয়া তবে?
(ছবিতে যিনি, মানে আরাধ্যা, তাঁর হয়েই কথাগুলো বলা। এরকম অনেক অনেক আরাধ্যার দাপাদাপির জন্য শিক্ষাঙ্গন মুখিয়ে যে!)