Skip to main content

".. মৃত্যুর জন্য তো পথ" ~ রবীন্দ্রনাথ

 

     এমনকি বিছানার চাদরেও তোমার না থাকার গন্ধ লেগেছিল, তুমি কি মেখে এসেছিলে? 

     কোনো উত্তর এলো না। আজকাল মেঘেরা দূত হয় না। মেঘেরা শুধুই বিষণ্ণতা। বড় অনাত্মীয়। আধখানা চাঁদ ছেঁড়া কালো মেঘের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। জানলার পর্দাটা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। যাবে কোথায়, বাঁধা যে! 

     মানুষ নিজেকে বাঁধতে ভালোবাসে। ভালোবাসা মানে কি? এক অনভিজ্ঞ আবেগ। ক্রমে আবেগ অভিজ্ঞতার ঘেরে বন্দী হয়। ভালোবাসা মানে তখন যত্ন নেওয়া। আবেগ নয়। অভিজ্ঞতা বলে আবেগকে, শান্ত হও। সেবায় নিজেকে ঢেলে দাও। সেবা মানে কি সেই ভালোবাসা?

     প্যাঁচা ডেকে উঠল। জানলার লোহাগুলো কি নরম হয়ে যায় রাত হলে। যেন ছুঁলেই গলে যাবে। পুরো আকাশটা ঘরে ঢুকে পড়বে। তারাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে থাকবে। চাঁদ, তোমার বসার জায়গা কোথায়? 

     ভালোবাসা মানে ব্যথা। চাদরে যে গন্ধ। সে গন্ধ তুমি। কি সুগন্ধি মাখো? সে সুগন্ধির নাম তুমি। সুগন্ধি তুমি। তোমার গায়ের গন্ধে আমার শরীরের সমস্ত লোমকূপ উন্মুখ হয়। যেন তৃষ্ণার্ত মাটি মেঘের ছায়া মেখে অপেক্ষায়। বৃষ্টির। তুমি বৃষ্টি। তুমি সুগন্ধি বৃষ্টি। 

     উঠে আলো জ্বাললো। ঘরের বাইরে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চোখে দেখা যায় না। কিন্তু পেরোতে গেলেই বাধা লাগে পায়ে। চড়তে গেলে হাঁপ ধরে যায়। তুমি কি করে পাহাড় পেরিয়ে আসো? তোমার আসতে তো বাধা নেই, যত বাধা আমারই। কেন?

     একটা ঘর। বুকে জেগে থাকা তেলচিটে ভালোবাসা মেখে মানুষটা বাইরে এলো। বাড়িতে শৌচাগার নেই। বাইরে অন্ধকার। জঙ্গল। একটা সাপও নেই তাকে কাটবে। বিষ ঢালবে। ভালোবাসা রাতে গলে গলে বুকের বিন্দু বিন্দু পড়ে। জিজ্ঞাসা করে, সে কই? সে কই? 

     শরীরকে মন ছেড়ে দিলে শরীর মানে কি? যন্ত্র। মনের হাতে শরীর জাগলে শরীর তখন বাদ্য। সুখ। শরীরকে মন দীর্ঘদিন ছেড়ে দিলে শরীরে জন্মায় বিষাদ। বিষণ্ণ শরীরে জন্মায় রোগ। রোগ মানে কি ব্যথা? না দুর্ভোগ?

     ক্লান্ত শরীরকে ঘিরে মৃত্যু মাছির মত গুঞ্জন করে বেড়ায়। যখন তখন বসে পড়বে শরীর জুড়ে। তুমি কই? আমার সুগন্ধি, আমার বৃষ্টি, আমার যন্ত্রণা। তুমি এসো না। আর এসো না। আমার তেলচিটে ভালোবাসায় ধুলো জমুক। আমি ভুলে যাই, ধুলোয় ঢাকতে ঢাকতে ভুলে যাই, কোনো একদিন আমার মনের হাত ধরে শরীর জেগেছিল ঝরণার মত। ঝরণা? এখন শুধু পাথর। জলের দাগ অবধি নেই। সব মিলিয়ে গেছে। 

     জীবন মানে কি অভ্যাস? আমিও ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম কয়েকটা অভ্যাসকে পোষা কুকুরের মত সঙ্গী করে মৃত্যু অবধি পৌঁছে যাব। পেরিয়ে যাব তুমি জানার আগেই। হল না। ভালোবাসা মানে অবশেষে অনভিজ্ঞ আবেগ। তবে এতদিন কি ছায়ার সঙ্গে লড়লাম? দার্শনিক এসে বসল কালো মথ হয়ে। বলল, 

     কামনার স্মৃতি থাকে। ভালোবাসা চিরনতুন। ভালোবাসা প্রতি মুহুর্তে সদ্যজাত। অভিজ্ঞতাহীন। বিপন্ন উৎসুক। কামনা অভিজ্ঞতার ভারে বৃদ্ধ হয়। কুশলী হয়। ভালোবাসা অদম্য। দমনীয় যা, সে কাম। 

     কালো মথ উড়ে গেল। আলো নিভিয়ে সে শুলো। ঘরের মধ্যে আরশোলা ওড়ার শব্দ। এই ঘরই রান্নাঘর। শোয়ার ঘর। অপেক্ষার ঘর। মিলনের ঘর। আনন্দের ঘর। বিষাদের ঘর। 

     ঘুম আসছে। আমার বুকের মধ্যে বিষের গ্রন্থি। বিষাদ চুঁইয়ে নামছে। ছুটছে ভালোবাসা। বিষাদ তাকে ধরতে চাইছে। জানি না কে জিতবে। আমার দু চোখ জুড়ে নামছে ঘুম। যদি মারা যাই। যদি আবার জন্মাই। তুমি আসবে? সব বিষাদ গ্রন্থি উপড়ে ফেলতে পারে একটা চুম্বন। তোমায় আরেকবার চুমু খাওয়ার জন্যেই আমার আবার হবে পুনর্জন্ম। তুমি আসবে?

     মানুষটা ঘুমিয়ে। রাতের অন্ধকার তার বুক চিরে তার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকছে। তার না সম্পূর্ণ হওয়া ভালোবাসাকে গল্প বলবে বলে। সে গল্পে রাক্ষস, রাজকুমার, রাজকুমারী সবাই অপেক্ষা করে থাকে। প্রাণ ভোমরা উড়ে বেড়ায় একা একা। একটা জীবনে অনেক জীবনের পায়ের ছাপ পড়ে। সবার পায়ের ছাপে আলাদা আলাদা কবিতা জন্মায়। 
     একটা জীবনে অনেক জীবনের ছন্দ জাগায় ভালোবাসা। অন্ধকারে ভালোবাসা পায় ডানা। তবু ওড়ে না। তার আসলে তো কোথাও যাওয়ার নেই। সে সাড়াও দেয় না। অপেক্ষা করে সাড়া পাওয়ার।