ঢুকতেই বিপুদা বলল, বাইকটা এনেছিস?
আমি মোবাইলটা জিন্সের পকেট থেকে বার করে চার্জে বসাতে যাচ্ছিলাম। সেই সকালে বেরিয়েছি, কলেজ, তারপর দুটো পড়া, তারপর এই বিপুদার বাড়ি। মোবাইলে চার্জ টিমটিম করছে।
বিপুদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে। রিটায়ার করার পর থেকেই। কেন্দ্রীয় সরকারে কাজ করতেন। অকৃতদার। নেশা বলতে বেড়ানো আর বই। সঙ্গে আরেকটা অবশ্য আছে, রহস্যের কিনারা করা। খুন-ডাকাতি নয়। মানুষের চরিত্রের রহস্যের। যা হোক, বিপুদা ধুতি পরেই ছিলেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিয়ে বলল, আমার পাওয়ার ব্যাঙ্কটা নিয়ে নে, আমি চালাবো, তুই বসবি। আয়।
আমি চাবিটা ছুঁড়ে দিলাম। লুফে নিয়ে বিপুদা বলল, আমার রিফ্লেক্স টেস্ট করছিস?
আমি জুতোটা পায়ে গলাতে গলাতে বললাম, ছিঃ ছিঃ! তা কেন, এটা আমার ইনস্টিংক্ট…
=======
বাইক ছুটছে কল্যাণীর রাস্তা ধরে। কোথায় যাচ্ছি এ প্রশ্ন অবান্তর। বিপুদার সঙ্গে বেরোনো মানেই একটা অভিজ্ঞতা। সত্যি বলতে এই বয়সে এমন স্মার্ট, ইন্টেলিজেন্ট মানুষ আমি দেখিনি।
বাইক ছুটছে কাঁচরাপাড়ার দিকে। বাগমোড় দিয়ে ঢুকে, দশ মিনিট পর একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো। বিপুদা বাইকটাকে রাস্তার সাইডে স্ট্যাণ্ড করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, খেয়ে এসেছিস? নাকি কিছু খেয়ে নিবি? এখানে বিরিয়ানি খুব ভালো বানায়…
আমি বললাম, আরে না না, খেয়ে এসেছি, চলো।
=======
থার্ড ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। বেশ ছিমছাম ফ্ল্যাট। একজন চল্লিশের মাঝামাঝি পুরুষ মানুষ এসে দরজাটা খুলে দিলেন। বিপুদার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আই অ্যাম সো গ্ল্যাড দাদা আপনি এসেছেন…প্লিজ… আসুন আসুন…
বিপুদা ফরম্যালিটির ধার ধারে না। বসেই বলল, আমি মিসেসের সঙ্গে কথা বলব। আপনি যাবেন না। অনিকেত, আমার বন্ধু বলতে পারেন, সঙ্গে যাবে, ও সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছে। আপত্তি নেই তো?
সাধন রক্ষিত, নামটা পরে জেনেছিলাম, হেসে বললেন, আরে প্রতিমা তো কখন থেকে বসে আছে আপনার জন্য… আসুন আসুন…
পাশের ঘরের দিকে এগোলাম আমরা। রক্ষিত দরজায় টোকা দিয়ে বলল, এই আসব? ওনারা এসেছেন?
ভিতর দরজাটা খুলে গেল। একজন মহিলা এসে দরজাটা খুলে দাঁড়ালেন, হঠাৎ নীচের ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। বললেন, আমায় বাঁচান স্যার… আমি আপনার কথা পড়েছি কিছু কিছু সোশ্যাল মিডিয়ায়… প্লিজ… আমায় বাঁচান…
বলতে বলতে মহিলা কাঁপতে শুরু করলেন। রক্ষিত 'দুর্গা, দুর্গা...' বলে চীৎকার করতেই একজন মাঝবয়েসী মহিলা এসে মিসেস রক্ষিতকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। খাটে শুইয়ে দিলেন।
রক্ষিত বললেন, মাথাটা বালিশ দিয়ে উঁচু করে দাও… কথা বলবেন তো…
আমরা ততক্ষণে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে খাটের পাশে বসেছি। ঘরে এসিটা বেশ ঠাণ্ডা। একটু একটু কাঁপুনি লাগছে।
বিপুদা মাথাটা ঘুরিয়ে বলল, আপনারা প্লিজ বাইরে যান ।
=======
মিসেস রক্ষিত বলতে শুরু করলেন---
ঘটনাটা শুরু হল জানেন গত বছর। না, ঠিক তা না, আমরা এই ফ্ল্যাটে এলাম কোন সাল?… ধরুন দু'হাজার উনিশ হবে। করোনার আগে। আগে তো টাটায় থাকতাম জানেন হয় তো। একদিন আমি ওই সামনের ঝুল বারান্দায় বসে আছি, ও অফিস থেকে ফেরেনি, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে সেদিন, হঠাৎ আমার মনে হল আমার পিঠে কেউ হাত রাখল।
আমি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কেউ নেই। যা হোক। আমি আর মাথা ঘামাইনি। ও এলো অফিস থেকে। স্নান করে বসল। আমি চা আনলাম। দু'জনে বসে খাব। ও বলল, ভালো বিস্কিট এনেছি, দেখো টেবিলে রেখেছি… আমি উঠতে যাব, ও বলল, কি গো তোমার পিঠে ওরকম লাল হাতের ছাপ কিসের?
ভদ্রমহিলা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে একবার তাকালেন, তারপর বিপুদার দিকে। বিপুদা চোখ বন্ধ করে একটা পায়ের উপর একটা পা তুলে বসে।
হঠাৎ দরজায় টোকা।
রক্ষিত মাথাটা ভিতরে গলিয়ে দিয়ে বললেন, চা-টা এখানেই দিয়ে যেতে বলি?
বিপুদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমিও। রিফ্লেক্সে। আসলে আমি ঘটনাটায় ডুবে।
পরের ঘটনা। এর মাস দুই পর। আমি বাজার করে ফিরেছি। বসে বসে বাজারের লিস্ট মেলাচ্ছি। একটা একটা করে জিনিস নামাচ্ছি, হঠাৎ দুর্গা চীৎকার করে উঠল রান্নাঘর থেকে। চিনির কৌটোতে একটা কাটা মুরগীর মাথা!
আমি তো থ, বুঝলেন। ও অফিস থেকে ফেরার পর বললাম সবটা। আমরা দু'জনেই ঠিক করলাম ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেব। কিছু নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ফ্ল্যাট কিনব বললেই তো আর হয় না। দেখতে দেখতে লকডাউন শুরু হয়ে গেল।
বিপুদা বললেন, তারপর?
এরপরের ঘটনা অনেক পর। আমি ঠাকুরঘরে বসে আছি। হঠাৎ ব্যালকনি থেকে খুব জোরে আওয়াজ। গিয়ে দেখি আমার বাড়ির সমস্ত চাল ছড়িয়ে দিয়ে রেখেছে কে। তারপর শুরু হল একের পর এক উৎপাত। সিলিণ্ডার বাথরুমে রেখে দেয় কে সকালে। ওর অফিসের ফাইলে ল্যাটিন ভাষায়, জার্মান ভাষায় কে ওর আর আমার নাম লিখে রেখে দেয়। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড বদলে দেয়। এই তো গতকাল, আমি আলমারি খুলে আমার বেণারসীটা বার করছি একটা বিয়েবাড়ি আছে বলে, দেখি ওটার সঙ্গে ওর কুর্তাটা কে সেলাই করে রেখেছে!
=======
বিপুদা আর আমি বাড়ি ফিরলাম রাত এগারোটা নাগাদ। বিপুদা খাওয়ার পর ছাদে চলে গেল। আজ আমার বাড়ি যাওয়া হবে না। বাড়িতে ফোন করে দিয়ে পড়তে বসলাম। মিসেস রক্ষিতের চোখদুটো মনে পড়ছে খালি। ল্যাটিন আর জার্মান ভাষায় লেখা নামগুলো দেখিয়েছিলেন মিস্টার রক্ষিত। হাতের লেখাটা নাকি হুবহু ওনার বাবার মত। বাবা কবি ছিলেন। অনেক ভাষা জানতেন। শেষের দিকে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। লাইনে গলা দিয়ে মারা যান। তবে কি উনিই? এই কথাটা রক্ষিত জিজ্ঞাসা করছিলেন যখন তখন ওনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখেছি।
বিপুদা নামল যখন প্রায় দুটো। আমি বললাম, এ তো মনে হচ্ছে কবি রক্ষিতের আত্মা দাদা…
বিপুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার সামনে বসে বললেন, কবিদের নিয়ে ঠাট্টা কোরো না ভায়া… চলো ঘুমাও… মাথা থেকে মিসেস রক্ষিতকে বার করো বুঝলে… শুধু রোমাঞ্চ না, ফ্রয়েডের সেক্সুয়ালিটির উপর থিওরিগুলোও বড় গভীর…
আমি বললাম, এটা কোনো কথা হল…
বিপুদা হাসল।
=======
এরপর বিপুদাকে দু'দিন পর পর পেলাম না। হোয়াটস অ্যাপেও অন্ নেই। ফোনও ধরছে না। গেল কোথায়? অবশ্য এ নতুন কিছু না।
এখন বিপুদাকে খোঁজা বেকার। যবে নিজে থেকে ডাক পাঠাবে তখন কিছু একটা হয়েছে বোঝা যাবে।
দু'দিন পর রাত আটটায় বাইকটা নিয়ে যাওয়ার আদেশ হল। গেলাম। গিয়ে দেখলাম বিপুদা রেডি হয়েই বসে। শুনলাম আজ রাতে আমরা ওই ফ্ল্যাটেই থাকব। কবি ভূতের উৎপাত নাকি ভীষণ বেড়ে গেছে। মিসেস রক্ষিতকে নিয়ে তার স্বামী দু'দিনের জন্য টাটায় গেছেন।
দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। পৌঁছালাম খাবার নিয়ে। বিরিয়ানি। দশটার মধ্যে দু'জনে খেয়ে কিছুক্ষণ মোবাইল ঘাঁটলাম। বিপুদা সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে কি যেন খুঁজে গেল। ঘরের আলো সব নিভিয়ে শুতে গেলাম এগারোটাতেই। ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি। মিসেস রক্ষিতের ঘরেই। এসিটা বাইশে দেওয়া। ঘরের মধ্যে হালকা নীল আলো জ্বলছে একটা। আমার চোখ দুটো খোলা। বুকটা ধড়ফড় করছে। বিপুদার চোখ বন্ধ। মানুষটা চোখ বন্ধ করেই দেখে বেশি।
=======
আমার পেটে একটা খোঁচা। বিপুদার আঙুল। বেড়ালের আওয়াজ। আমি আর বিপুদা উঠলাম। ডাইনিং রুমে এসে আলো জ্বালতেই চমকে উঠে দেখি একটা মোটা কালো বেড়াল সোফার উপর বসে। বেড়াল ঢুকল কোথা থেকে? একটা মাছিও তো ঢোকার জায়গা নেই। সব ঘরে এসি। বাড়ির সব ঘুলঘুলি বন্ধ। মেঝেতে মাংসের হাড় ছড়ানো। বিপুদা বলল, বিফ্।
বাথরুমের দিকে এগিয়ে বিপুদা বলল, এদিকে আয়।
একটা কাটা ছাগলের মাথা! সারাটা মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
সারারাত ঘুম হল না আর। বাথরুম পরিষ্কার করে, বেড়ালটাকে বার করে দিয়ে, অপেক্ষা করলাম কখন সকাল হয়। তারপর মাথাটা, হাড়গুলো একটা বড় ব্যাগে ভরে আমি আর বিপুদা ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে এলাম। বাড়ি এলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, আজ আবার যাবে? বিপুদা হেসে বলল, কেন রে? ভয় খেলি? না না। আর দরকার নেই।
=======
দু'দিন পর। আমি আর বিপুদা কল্যাণী স্টেশানে বসে আছি। কলকাতা যাব। বিপুদার কি কাজ আছে একটা। ব্যাঙ্কে।
ব্যাঙ্কে আমাকে বাইরে বসিয়ে রেখে বিপুদা ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে গেল। কাঁচের ঘর। মহিলার খুব বেশি বয়েস নয়। বিপুদার কথা শুনতে শুনতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে দেখলাম। বেশ অস্থির হচ্ছেন। বিপুদা ঢোকার সময়ে যে কম্পোজ ভাবটা ছিল সেটা নেই। কয়েকবার ঘাম মুছলেন। জল খেলেন। দু'একবার হাসার চেষ্টা করলেন। কষ্ট হল হাসতে।
বিপুদা বেরিয়ে এসে বলল, চল দিলখুশায়, অনেকদিন ফিস কবিরাজী খাওয়া হয়নি।
=======
দু'দিন হয়ে গেল। বিপুদা কেসটা নিয়ে কিছুই বলেন না। আমিও ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারছি না। তবে কি সত্যিই ভূতের ব্যাপার?
সাতদিন বাদে বিপুদা বলল, চল, দেখা করে আসি।
আমি বললাম, কার সঙ্গে?
বিপুদা বলল, চল না।
রক্ষিতদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। উঠে দেখি সব প্যাকিং হয়ে গেছে। মিস্টার রক্ষিতের মুখে আগের দিনের মত বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবটা নেই। ব্যবহারটাও রূঢ় কিছুটা। আমাদের দেখেই বললেন, সরি তোমাদের তো আপ্যায়ন করার মত অবস্থায় নেই আমি।
বিপুদা এগিয়ে গিয়ে বলল, মিসের রক্ষিত?
উনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাসলেন একগাল। আজ খুব ফ্রেশ লাগছে। হাতজোড় করে বললেন, আমি থাকব না ওর সঙ্গে, দ্যাটস্ ফাইনাল। নইলে আমি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাব। ও সিক।
বলতে বলতে মিসের রক্ষিতের চোয়াল দুটো শক্ত হল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার নরমাল হয়ে বললেন, আসুন না একদিন টাটায়… লেট মি সেটল মাইসেলফ ফার্স্ট… বাট আই সিনসিয়ারলি উইশ দ্যাট উ শুড কাম… প্লিজ…
বিপুদা চারদিকে তাকিয়ে বলল, দুর্গাকে দেখছি না?
মিসেস রক্ষিত একটু সঙ্কোচ করে বললেন, আপনি আসছেন শুনে লজ্জায় আসেনি… বাই দ্য ওয়ে ওকে নিয়ে যাচ্ছি জানেন… বড় ভালো মেয়েটা… কেউ নেই এমনিতেও ওর… আর ক'দিন পরে আমারও ঝাড়া হাত-পা…
বলতে বলতে একবার একটা কঠোর দৃষ্টিতে মিস্টার রক্ষিতের দিকে তাকালেন।
বিপুদা বললেন, আর বড় সাহসীও… মানে দুর্গার কথা বলছি…
সে আর বলতে…
মিসেস রক্ষিত হেসে ফেললেন। বিপুদার সঙ্গে চোখে চোখে কি কথা হল। বুঝলাম না।
=======
বিপুদা সব পরিষ্কার করল সেইদিন রাতে।
সাধন রক্ষিতের বাবার ছাত্রী ছিল প্রতিমা। বিশ্বম্ভর রক্ষিত ছিলেন নামকরা বাংলার শিক্ষক। এবং কবি। প্রতিমাকে বেশ পছন্দ হয় বিশ্বম্ভরবাবুর। আর প্রতিমাও ছিল শিক্ষক অন্ত প্রাণ। তার দুটো কারণ, এক, প্রতিমা ছোটোবয়সে বাবাকে হারায়। পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত, মামাদের গঞ্জনায় বড় হয়। আর দুই, কবিতা প্রীতি।
সাধন রক্ষিতের স্বভাবে স্কুলে পড়া থেকেই নানা বদগুণ জন্মাতে শুরু করে, যা বাবার চোখ এড়ায়নি। ছেলেকে সামাল দেবেন বলে প্রতিমার হাতে ছেলেকে তুলে দেন। কিন্তু কোথাও বুঝতে পারেন প্রতিমাকে তিনি ব্যবহার করছেন, প্রতিমার অবস্থার সুযোগ নিয়ে। আর দুই, প্রতিমার তার প্রতি অন্ধবিশ্বাস শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে।
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বম্ভরবাবু বুঝতে পারেন যা চেয়েছিলেন হল তো না, বরং আরো খারাপ দিকে গেল। প্রতিমার জন্য মনে মনে অনুশোচনা এত বাড়তে থাকে যে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। মাঝে মাঝেই প্রতিমার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে যেতেন। প্রতিমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বারবার। ছেলেকে শাসন করতে গিয়ে মারও খেয়েছেন ছেলের হাতে। শেষের দিকে আর সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন লাইনে গলা দিয়ে, ততদিনে অবশ্য মাথাটাও অনেকটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
শুরু হয় প্রতিমার জীবনে এক দুঃসহ অন্ধকার পর্ব। সাধন ব্যবসাটা ভালো বুঝত। ইলেক্ট্রিক পার্টসের ব্যবসা জমে উঠল দেখতে দেখতে। যত উপার্জন বাড়ল তত বাড়ল বদ স্বভাবগুলো। নানা বদস্বভাবের মধ্যে একটা ছিল একটু প্রতিষ্ঠিত বিবাহিত মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাদের নানাভাবে ব্যবহার করা। তারপর তাদের ব্ল্যাকমেল করা।
বিপুদাকে যখন আমি ফোনে পাচ্ছিলাম না তখন বিপুদা টাটায় ছিলেন। সেখানেই এত কিছুর খোঁজ পান, আর সঞ্চিতা বক্সী বলে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের খোঁজও পান।
এদিকে প্রতিমার মানসিক অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। যা চেয়েছিল আর যা হল তার মধ্যে এতবড় পার্থক্য তৈরি হতে শুরু করল যে প্রতিমা দিন দিন বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করা প্রায় ছেড়ে দিল। রাতদিন অন্ধকার ঘরে নিজেকে আটকে রাখত। প্রায়ই শ্বশুরমশাইকে দেখতে পেত। এমনকি নিজেকে মাঝে মাঝে শ্বশুরমশাই হিসাবে কল্পনাও করত। ওনার মত হাতের লেখা প্র্যাক্টিস করত। ওনার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ওনার মত করে হাঁটাচলা করত। শ্বশুরের অস্তিত্বকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে একটা আশ্রয় খুঁজতে চাইত প্রতিমা।
এর মধ্যে সঞ্চিতাকে ব্ল্যাকমেল করবে বলে কাজের নানা ছুতো দেখিয়ে সাধন কাঁচরাপাড়ায় এসে ওঠে। প্রতিমা কিছু একটা আন্দাজ করলেও স্পষ্ট করে ভাবার মত অবস্থা তার ছিল না। কাঁচরাপাড়ায় এসে সাধনের দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। প্রতিমার মধ্যে জাগা শ্বশুরের অস্তিত্বকে প্রতিমা নিজের কিছুটা অজান্তেই একদিন ঠিক করে সাধনকে ভয় দেখাতে ব্যবহার করবে।
এই কাজে তার ডানহাত হয় দুর্গা। প্রতিমার পিঠে লালছাপ দেওয়া, আমরা যখন ছিলাম রাতে তখন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে বেড়াল ছেড়ে যাওয়া, ছাগলের কাটা মাথা রেখে যাওয়া, এসব দুর্গার কীর্তি। বুদ্ধি জুগিয়েছিল প্রতিমা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার সন্দেহ হয় কখন প্রথম?
বিপুদা বলল, দুর্গা আর প্রতিমাকে একসঙ্গে দেখে। ওদের নিজেদের মধ্যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে। নিজেদের মধ্যে কিছু গোপন সঙ্কেত ওরা ব্যবহার করছিল। আমার সন্দেহ তাতেই বাড়ে। পরে আরো জানলাম যখন সাধন ভেজিটেরিয়ান আর রক্ত দেখলে ভয় পায়, তখন সন্দেহ আরো বাড়ল।
এখান থেকে চলে যেতে চাইছিল কেন মিসেস রক্ষিত?
কারণ, টাটা প্রতিমার বড় হওয়ার জায়গা। সেখানে সে অনেক সেফ। এখানে সবাই অপরিচিত। তাই।
তুমি মিসেস রক্ষিতকে এসব কবে বললে?
মানে আমি কবে তোকে ছেড়ে একা একা ওই সুন্দরী মহিলার ফ্ল্যাটে গেছি… এই তো? ওরে তোর বিপুদা অত ক্যারেক্টারলেস নয় ভাই…
আরে ধুর্... আমি তাই বললাম? মুখে এটা বললাম, যদিও মনে মনে হিংসা যে একটুও হয়নি তা নয়।
বিপুদা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল, হয় হয়, এই বয়সে হয়… আমি মিসেস রক্ষিতকে নিয়ে একদিন সঞ্চিতার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম… বারাসাতে।
আমি চুপ। মানুষটার মাথায় কি যে চলে।
বিপুদা আমার দিকে চোখ টিপে বলল, কিরে পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি যে রে… এক নয় এবারে দু'জন মহিলা…
আমি বললাম, উফ্..., তুমি যা তা একবারে…