মানে একটা মানুষ একটু শান্তিতে তর্পণও করতে পারবে না? ভুল্টু জোয়ারের জলে পা ডুবিয়ে হাতে কুশ, গঙ্গার জল আর তিল নিয়ে সবে পুরুত মশায়ের নকল করে প্রথম শব্দটা উচ্চারণ করেছে কি করেনি, অমনি মাথায় গাঁট্টা... বলে, এই ব্যাটা আমাদের গোত্র ভুল বলছিস কেন?
উফ্..., মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভুল্টু বলল, অ্যাঁ মানে, আমাদের গোত্র কি তবে? আলিম্মন না?
এবার কানমলা। কানটা টাটিয়ে উঠল। কানের কাছে আবার ফিসফিস, আরে উদো আমরা তো শাণ্ডিল্য, ও তো তোর শ্বশুরের গোত্র... ছোটোলোক... বামুনের ছেলে হয়ে কি যে একটা প্রেম করলি…
ভুল্টু আবার কানমলা বা গাঁট্টা আশা করেছিল। না এলো না। একটা দীর্ঘশ্বাসের হাওয়ায় কানের পাশের চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে গেল। জর্দার গন্ধ। মানে ঠাকুর্দা।
পুরুত বললেন, ও মশায়, আরে মন্তোর পড়ুন, অনেক লাইন আছে যে…
ভুল্টু আবার পড়তে যাচ্ছিল... হঠাৎ দেখে ও মা…! এতো সব পূর্বপুরুষেরা, পূর্বমহিলারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। ঠাকুমার মা না উনি? আরে হ্যাঁ তো... ওই তো একটা চোখ ট্যারা... ছবিতে দেখেছে... কিন্তু একি জ্বালা, তিনি এদিকে আসেন কেন?
তিনি এগিয়ে এসে ভুল্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তা বাছা, গান্ধীজি কোন জেলে আছেন বলতে পারো?
তার অনেক পিছন থেকে আরেক বুড়ো এগিয়ে এসে বললেন, মানুষের কি অধঃপতন গো... আরে মহাপ্রভু এই সবে জগন্নাথ মন্দিরে গুণ্ডিচা মার্জন করে এসে বসেছেন, এখন ওসব কি গান্ধীটান্ধী কথা? কে সে? জেলেই বা যায় কেন? আর তুমিই বা বাড়ি বউ হয়ে ওসব পরপুরুষের কথা সবার সামনে জিগাও বা কেন?
আরো পিছন থেকে একজন এগিয়ে এসে বললেন, তা ঠিক কথা বাপু, আমি এই কুমারিলের টোল থেকে আসছি, পূর্ব মীমাংসা ছাপাতে দিয়েছে, বুদ্ধের ঘেঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে, তা এই মহাপ্রভু ছেলেটি কে? ইনিও পণ্ডিত?
আগের বুড়ো বললেন, পণ্ডিত বটে তবে ইনি অবতার মানুষ... মানুষকে ওই নাম দিতে এয়েচেন…
অমনি হঠাৎ করে একজন বেরিয়ে এসে বলল, আরে ধুর মশায়, শাক্ত পথে না গেলে জীবের ত্রাণ নেই... ওসব নামে কিস্যু জোর নেই…
আরেকজন এগিয়ে এসে বললেন, আরে ধুর, আত্মজ্ঞান না হলে, আত্মা ও ব্রহ্মকে এক না জানলে…
ওদিকে পুরুত বলছে, ও মশায় আপনার কি সমাধি হল নাকি?
ভুল্টু আমতা আমতা করে বলল, ডিমের চপ…
পুরুত কানে আঙুল দিয়ে বললেন, কি ম্লেচ্ছ কথা মাইরি...! আপনি এই তর্পণ করতে এসে ডিমের চপ খাবেন…
আসলে ভুল্টুর কানের কাছে এসে এক বুড়ি বারবার বলেই যাচ্ছে, বাবা ওসব গুমুত মাখা জল আর দিস না, পেটে ছ্যাদলা পড়ে গেল, দেখ না, সুতানুটিতে ডিমের চপ ভাজত একজন, নামটা যেন কি? আরে ওই যে গঙ্গাধর তর্কালঙ্কারের মেয়েটা গো, কি এক মোচোলমানকে ভালোবেসে পোয়াতি হল, তারপর গঙ্গার ধারে ছেলে বিইয়ে মারা গেল গো... সেই ছেলেই তো ভাজত... বাড়িতে নেয় নাকি ও ছেলে আর? দেখ না বাবা ডিমের চপ…
হঠাৎ একজন সুটবুট পরা পূর্বপুরুষ এসে কানের কাছে বলল, এই ওরিয়েন্টাল হিপোক্রেসিতে মাথা দিও না বাবা, আসল কথা হল অক্সিডেণ্টাল সভ্যতা... এই দেখো, আমি নেটিভদের কবে ছেড়েছি... তুমি একটা হাইজিনের ব্যবস্থা করো তো, আমি তো ভীষণ আপডেটেড থাকি, তা আমি দেখেছি তোমাদের এখন পিউরিফায়েড ওয়াটার পাওয়া যায়, তবে এই গ্যাঞ্জেসের পলিউটেড ওয়াটার কেন দেবে বলো…
অমনি এক ডাকাবুকো ষণ্ডামার্কা পূর্বপুরুষ এসে বললেন, ফের তুই আমাদের নিন্দামন্দ করছিস? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা... এই বলে ধুমাধুম চটাচট মারামারি লেগে গেল... কেউ কেউ ‘বন্দে মাতরম’ বলে চীৎকার করে হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিল…
ওদিকে পুরুত আর ভুল্টু চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে... পুরুত এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ও দাদা আপনি কি দেখছেন এত... আমি কি চলে যাব?
ভুল্টু এদিকে তাকিয়ে দেখে শুধু তার পূর্বপুরুষ বা মহিলারা না, সবার গুচ্ছের গুচ্ছের পূর্বপুরুষ মহিলারা ঘাটে থিক থিক করছে... কেউ জল নিচ্ছে না... সবাই খালি কি সব কথা বলতে চাইছে... কিন্তু সবাই এত এত ব্যস্ত কেউ শুনতে চাইছে না... সবাই জল ছুঁড়ে আর মন্ত্র পড়ে পালাতে চাইছে…
ভুল্টু বলল, আমি বাড়ি যাই…
পুরুত বলল, শরীর খারাপ লাগছে?…
ভুল্টু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, কিছুই না বলে পুরুতের পাওনা মিটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল তার সব পূর্বপুরুষ আর মহিলারা শান্ত হয়ে ভুল্টুর চলে যাওয়া দেখছে... সবার পা গঙ্গাজলে ডোবা... তারা টাটা করছে…
ভুল্টুর হুস্ করে বেমক্কা ছোটোবেলার মত কান্না পেয়ে গেল... চোখের থেকে টস টস করে জল গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল... আবার পিছন ফিরে তাকালো, কেউ নেই সব ঝাপসা... তবু বুকের ভিতর যেন সবাইকে খুব কাছের মনে হল... সবাই যেন তার চোখের জলে বুকের মধ্যে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে…এই জলের জন্যেই যেন অপেক্ষা ছিল তাদের…
কে যেন বলল, এই ঠাঠা রোদে হাঁটিসনি ভুল্টু... টোটো পাঠালাম, উঠে যা…
সত্যিই টোটোটা পাশে এসে দাঁড়ালো... গলাটা কার? আরে যতীনের তো... তার খুব কাছের বন্ধু... করোনায় গেল বছরে মারা গেল... আসলে তবে কেউ যায় না... কেউ হারায় না... যদি না আমরা হারাতে চাই... ভুল্টুর ভক করে আবার কান্না পেয়ে গেল...