Skip to main content

ক্যান্সার খুব স্বাভাবিক ঘটনা। রাস্তায় চলতে গিয়ে কেউ গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে, এও খুব শোনা ঘটনা। এরকম আরো অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই খুব স্বাভাবিক, গা-সওয়া ঘটনা। কতক্ষণ? যতক্ষণ না নিজের পরিচিতের গণ্ডীর মধ্যে ঘটে। 
        আজ ঘটল। তাই অস্থির হচ্ছি। বমি পাচ্ছে। কি ঘটল শুনে আপনারাও আমার মত ভাববেন এ তো হামেশাই হচ্ছে। এ নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন বাপু? কি ঘটল?
একজন পরিচিত অল্প বয়েসী গরীব মেয়েকে তার পিতৃতুল্য, জন্মলগ্ন থেকে পরিচিত একজন ব্যক্তি চাকরীর বিনিময়ে সেক্স করতে বলেছে। কারণটাও বুঝিয়েছেন, তোমার দরকার চাকরী, আমার সেক্স, আমার স্ত্রীর বয়েস হয়েছে তো...
        তবে? যে পৃথিবীতে একটা বোমের আঘাতে লক্ষ লক্ষ প্রাণের হত্যা হচ্ছে, বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা একটা পেনের আঁচড়ে লক্ষ মানুষকে বঞ্চিত করে ফেলছে... সেখানে এ তো তুচ্ছ অপরাধ। নিজেদের মধ্যে ঘটে গেলে কাকপক্ষীতেও টের পেত না। কিন্তু মেয়েটা বাগড়া দিল। খালি পেট মানবে সে, কিন্তু আত্মসম্মান খোয়াবে না। কি অসম্ভব বিলাসিতা না? আরে ভাই-বোন-বাপ ভর পেট খেতে পেত রে... এরকম কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে না? তোর ওই অক্ষত যোনির কি মূল্য বল? সেদিন শুনলাম ব্রিটেনে কত শতাংশ মেয়ে নাকি পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য হরদম এই সব কাজ করে। 
        আমাদের আবার কত শাস্ত্র, কত নীতি কথা, কত প্রতিষ্ঠান না? আচ্ছা মানুষের প্রবৃত্তি কি সত্যিই কিছু বদলিয়েছে আসলে? নাকি সম্মিলিত আত্ম-প্রবঞ্চনায় বেঁচে আছি আমরা? একজনের চোখের ঠুলি খুলে পড়ে গেলে আরেকজন এগিয়ে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তুলে পরিয়ে দিয়ে আসছি? তবে কি এই সম্মিলিত, গোষ্ঠীবদ্ধ, যুগান্তব্যাপী আত্ম-প্রবঞ্চনা রপ্ত করার প্রচেষ্টাই সভ্যতা? বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতি কি তবে এই ঠগের মেলায় নতুন নতুন নাগরদোলা আসার মত? ফি বছর নতুন আবিষ্কার... নতুন আমোদ... নতুন সম্ভাবনা... কিন্তু কার? 
        আসলে সৎ মানুষ বলে কিছু হয় কি? যে জানে বিষ খেলে মরবে সে বিষ খায় না, সে কি সৎ তবে? যে জানে গাড়ি এত স্পিডের উপর চালালে ভারসাম্য রাখা দায় হবে, সে আর অত জোরে চালায় না, তা বলে কি সৎ হবে বলে চালায় না? এও তেমন, যে জানে প্রতিটা কাজের মাশুল দিয়ে যেতে হবে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃত সব অপরাধের সাজা এখানেই বুঝে নিতে হয়, সে আর ঠিক না হয়ে পারে না। সেকি শখের সৎ মানুষ? না না। সততা শৌখিনতা না তো, বাধ্যতা। বাইরের তাগিদের না তো, ভিতরের লড়াইয়ের। 
        সেরকম মানুষ সব সমাজেই হাতে গোনা। মুশকিল হচ্ছে, পাশের বাড়ির সামনে ময়লা জমলে সে নোংরাতে আমিও যে অসুস্থ হতে পারি, এ সামাজিক বোধটা আমাদের সমাজের বড্ড কম। ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে ধরণের নীতিমালা আমাদের। তাই শিক্ষিত সমাজে মানুষ আইনের দ্বারস্থ হয়, আর আমাদের আইন তেনাদের দ্বারস্থ হয়। 
        তার উপর মেয়ে মানুষ, অর্থাৎ তার সবটুকু শুদ্ধতা তার জননতন্ত্র নির্ভর। তুমি দশ ইঞ্চি, ছ, ইঞ্চি নিয়ে যা খুশী করতে পারো যদি পুরুষ হও... সোনার আংটি আবার বাঁকা?... ও যে মেয়ে, ও সব লেকচার ফেসবুকে লেখো, বই ছাপো... কিন্তু বিয়ের সময় ওসব চলবে না... সমাজ বলে একটা বস্তু আছে না? হুঁ! 
        অভ্যাস বড় বালাই, জানেন। একজন সীতারামদাস ওঁঙ্কারনাথ ঠাকুরের শিষ্য আমায় বললেন, যিনি আমাদের সমাজের সু-উচ্চ পদমর্যাদায় কাজ করে এসেছেন, মানে সে এত উচ্চ যে তাকাতে গেলে আমার স্পন্ডাইলোসিস নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে হবে মাটিতে, তা তিনি কি বললেন জানেন, এখানে আসলে মনে রাখবেন, আমরা মঠে ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণকে এক সাথে বসে খেতে দিই না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মঠে ফোন করে সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে জানলাম, হ্যাঁ তাই। তারা খুব গর্বের সাথে বললেন শুধু না, আক্ষেপও করলেন যে সে নিয়ম রাখা দায় হয়ে পড়ছে মানুষ এত 'অনাচারী' হয়ে উঠেছে। 
        আচ্ছা এরাই যদি কোনো শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বলেন, মেয়ে মাত্রই ভোগ্য... কে প্রতিবাদ করবে? যতই আমাদের গার্গী মৈত্রেয়ী থাকুক না কেন... সতীদাহও তো খুব পুরোনো ঘটনা না, কি বলেন? সেও তো নাকি বিধি সম্মত ব্যবস্থা ছিল। অভ্যাস বুঝলেন কিনা, অভ্যাস। যতই কিনা আওড়াও বড় বড় নীতি কথা, মস্তিষ্কের কোষের থেকে বুকে নামবে আর আচরণে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে? বা রে, তবে তো দল খুলতে হবে? সভা সমিতি গড়তে হবে... নিদেন পক্ষে গ্রুপ বানাতে হবে। আমরা ওরার ভেদ টানতে হবে। সেই হল কথা, তার চেয়ে কার্পেটের তলায় ভরি সব। 
        সমস্যাটা তো থাকেই। সব ইতিহাসেই থাকে। সব দেশেই থাকে। কিন্তু তাকে সগৌরবে মেনে চলার মত দায় বোধহয় আমাদের মত দক্ষিণ এশিয়া আর মধ্য এশিয়া ছাড়া কমই আছে। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অর্ধনগ্ন হয়ে হেঁটে, কটা বিদেশি দ্রব্য ব্যবহার কৌশল রপ্ত করে, আরো খানিক এদিক ওদিক নকল করে যদি প্রথম বিশ্ব হওয়া যেত তবেই হয়েছিল। না তো সারাটা দেশে বিবেকানন্দ একটা নিবেদিতা পেলেন না? শ্রী অরবিন্দ একটা মাদার পেলেন না? রেসিস্ট শোনাচ্ছে না? মাঝে মাঝে মনে হয় রবি ঠাকুর অমন কাউকে পেলে বোধহয় ওর জীবনটা আরেকটু সহজ হত। 
        যাক কোথাকার কথা কোথায় বইল। এখনও গলাটা কানে বাজছে, “ভুল করলাম কি দাদা”? এ হতভাগা দেশে এই প্রশ্নটাও মনে জাগে... হা ঈশ্বর! এ হতভাগা দেশে খালি পেট মানে এখনও তবে তবে ধর্ষণের অধিকার তো বটেই। না?