দরজা খোলা ছিল। দমকা বাতাস ভিতরে এসে পড়ল। কড়ি-বরগা, দেওয়াল, মেঝে রে রে করে উঠল। গেল গেল গেল সব গেল। কে খুলে রেখেছিল দরজা? - হুঙ্কার দিল ছাদ।
খাটের তলার জমে থাকা অন্ধকার গুটিগুটি পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, আমি। তার মুখে নম্রতা আছে, কিন্তু লজ্জা নেই। শ্রদ্ধা আছে, অথচ অনুতাপের গ্লানি নেই। সক্কলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, বেটির ক্ষমতা আছে। মুখে বলল, তবে রে!
ছাদ তার গায়ের কিছুটা ধুলো হাওয়ার সাথে খসে পড়তে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল। হোক ধুলো। এতদিনের অভ্যেস তার সাথে থাকা। অভ্যাসের চেয়ে আপন আর কে আছে? ভালোমন্দ বিচার করতে যায় কোন শালা! ও নিয়ে কোনো পণ্ডিত আজ অবধি সহমত হতে পেরেছে অন্য পণ্ডিতের সাথে? সে সেই কালেই কি, আর এই কালেই কি। অভ্যাস কাড়তে যেও না বাছা। অভ্যাস বদলানোর ভাষণ দাও, শুনব... অভ্যাস বদলালে কি কি সুবিধা সেই বিষয়ে চারটে গবেষণামূলক বই ছাপাও, পড়ব। কারণ এ সবগুলোই আমার অভ্যাস বহুদিনের। কিন্তু খবরদার! অভ্যাস সত্যিকারের বদলাবে না। ক্ষমতা থাকলেও না।
ছাদ মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেল। কিন্তু হাজার হলেও সে ছাদ। অর্থাৎ কিনা সমাজের মাথা। তাই ইতর সাধারণের মত রাগ দেখালেই তার চলবে কেন? ইতর সাধারণের স্বার্থে আঘাত লাগলে, কি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আঘাত লাগলে চীৎকার করে আকাশ পাতাল এক করতে পারে। কিন্তু ছাদ কি করে পারবে?সেই জন্যে তার চাই যুক্তি। তাও আবার যে সে যুক্তি না, এক্কেবারে দশের কথা ভাবা, পরার্থপরতামূলক যুক্তি। সাথে চোখের জল, সহানুভূতিসূচক উৎকণ্ঠা, দেশ বিদেশের, বর্তমান, অতীতের জ্ঞানী লোকেদের তত্ত্বের ধারালো সব অস্ত্রসমূহ। সে সব ছাদ মনে মনে ভেবে বলল, এই যে তুমি হঠাৎ কাউকে না বলে দরজাটা খুলে বসলে, তাতে কতরকম ক্ষতি হল জানো?
খাটের তলার অন্ধকার চুপ করে তাকিয়ে রইল ছাদের মুখের দিকে। সব্বাই মনে মনে বলল, স্পর্ধা কি রে! এত সাহস পায় কোথায়? বাইরে মুখ বেঁকিয়ে বলল, হুঁ! অমন কত এলো গেলো চাঁদু! অ্যাটি দেখাস না!
ছাদ বলতে শুরু করল, প্রথম কথা এই এতো ধুলো নিয়ে আমরা এখন কি করব? আরে পৃথিবীতে সবাই যদি পরিষ্কার জায়গায় থাকতে চাইবে, তবে এই ধুলোগুলো কোথায় যাবে? তাদের আশ্রয় কে দেবে? আর এই ধুলো আমাদের দেওয়ালের গায়ে কতটা পুরু আস্তরণ করেছিলো এতকাল সে তথ্য জানা আছে? (ছাদ ইঙ্গিত করতেই পর্দার কাপড় উড়ে এসে খাটের নীচের অন্ধকারকে একটা কাগজের তাড়া ধরিয়ে দিয়ে গেল।) ওটা পোড়ো সময় করে, বুঝলে। এই ধুলোর ভারে পর্দাগুলো উড়ত না, বিছানার চাদর নড়ত না, মেঝেতে কারোর পায়ের আঁচড় বসত না, নিঃশব্দে গোপনে সব কাজ সারা হয়ে যেত। এখন কি হবে বুঝতে পারছো? পর্দা উড়বে, ফলে অকারণে দিনের আলো আসবে ঘরে, বিছানার চাদর ওরা কাচতে নিয়ে যাবে, বিছানার চাদরের তলাতে কত গোপন নথিপত্র রাখা থাকে সে আন্দাজ আছে? আর মেঝের কি হবে ভাবো? যেই হাঁটবে তার পায়ের দাগ থেকে যাবে ওর বুকে। ধরিত্রীর কানে সে কথা যাবে। আমাদের মান-সম্মান থাকবে? আরে মেঝেতে কতরকম মানুষের হাঁটাহাঁটি জানো?
এতটা বলে ছাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মনে কোথাও যেন একটা সন্দেহ জাগছে। সবার মুখগুলো হাওয়া আসার পর কেমন একটু বেশি উজ্জ্বল লাগছে না? দমকা হাওয়া তো কারোর কথাই শুনছে না। সে তো নিজের মনে কাজ করেই চলেছে, এতো অহংকার! টিকবে? (ছাদের মনে আতঙ্ক, এভাবে চললে ভবিষ্যতে লোকে মানবে তাকে?)
ইতিমধ্যে কিন্তু ঘরেতে একটা বড়সড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। কেউ নিয়েছে হাওয়া আর খাটের তলার অন্ধকারের পক্ষ, আর কেউ নিয়েছে ছাদের পক্ষ (দ্বিতীয় দলের সংখ্যা কম, কিন্তু আস্ফালন বেশি। ভয়, পাছে প্রভাব হারায়)।
দেওয়ালের কোণ বলল, আমি আন্দোলনে নামব। নামল। অনেকেই বলল, ঠিক ঠিক ঠিক। কিন্তু কেউ এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো না। এদিকে তার গা থেকে ধুলো সরে সরে যেতে লাগল, তাকে আরো দৈন্যদশায় দেখাতে লাগল। অনেকে বলল,এই ভালো, ধুলোর স্বাস্থ্যের চেয়ে, অমলিন ক্ষীন তনু ভালো।
তারপর কি হল? যা হয় চিরটাকাল। ঘরের মধ্যে হাওয়া ঢুকলে যা হয় তাই হল। পাল্টে গেল অনেক কিছু। কিছু কাজের জিনিসও উড়ে গেল দমকা হাওয়া লেগে। কিছু কিছু পোকা, টিকটিকি, মাকড়সা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ছাদ চীৎকার করে উঠে বলল, দেখলে?
খাটের তলার অন্ধকার বলল, মাননীয় ছাদ, এ মৃত্যু, এ ক্ষতি বড়ই তাৎক্ষণিক আর স্পষ্ট বলে আপনার চোখে পড়ছে; আর এত যুগ ধরে এত এত প্রাণী যে ক্রমশঃ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল ধুলোর চাপে, সে আপনার চোখে পড়েনি, কেন না সেগুলো অনাটকীয় আপনার বিচারে। দমকা হাওয়া আমি ডাকিনি, এতদিনের দীর্ঘশ্বাস এই দমকা হাওয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অকালমৃত লক্ষ লক্ষ প্রাণ এই ঝোড়ো হাওয়াকে সাথে করে এনেছে। ঝড় তো শুধু নতুন করে গোছায় না, আগোছালো করে নতুনকে আসার পথ করে দেয়। ও তাই দেবে। এই কালের নিয়ম।