Skip to main content

সেদিন গ্রামের সবাই চুপ করেছিল সকাল থেকে। কারণ শেষ রাতে গ্রামের সবাই স্বপ্ন দেখেছিল, আজ কথা বলতে গেলেই সবাই সত্যি কথা বলে ফেলবে। না চাইলেও বলে ফেলবে।
      সারাদিন গ্রামে বাচ্চাদের চীৎকার, মুরগী-গোরু-মোষের ডাক ছাড়া কোনো কোলাহল ছিল না। রাজার বাড়ীর ময়নাটা যে নাকি সকাল থেকেই সারা গ্রাম চীৎকার করে বলত,"ঈশ্বরের জন্য সব কিছু ত্যাগ করেছে আমাদের রাজা আর পুরোহিত"; সেই ময়নাটার বিকট চীৎকারে গ্রামের সদ্যোজাত শিশুগুলো কেঁদে উঠেছে চমকে কয়েকবার। পাখিটার গলা ফেটে ঠোঁট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে খাঁচায় রাখা ছোলার বাটি ভিজিয়ে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে রাজা পাখিটার খাঁচা খুলে দিয়েছে। যে ক'টা পালক পাখিটা কিসের আক্রোশে যেন নিজের গা থেকে ছিঁড়ে ফেলেছে, সেগুলো গিলে ফেলেছে রাজা, রাণী আর মন্ত্রী, আতঙ্কে।
      বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ছিল, কিন্তু কোনো শিক্ষক যায়নি। আদালত বন্ধ ছিল। মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। কারণ সারি সারি পিঁপড়ে মাটির গর্ত থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরের মুখের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল।
      গ্রামে এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিল, বলা হয় তারা কোনোদিন কাঁদতে পারে কেউ নাকি ভাবেনি, এতই নাকি ধনসম্পদ তাদের। বারবার ঘড়ি দেখছিল সবাই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। বাজার বসেনি। জ্যোতিষী, শাস্ত্রজ্ঞরা সারাদিন শৌচালয়ে নিজেদের আটকে রেখেছিল। নদীর ধারে বিকালে কোনো যুগলকে বসে থাকতে দেখা যায়নি। শোনা যায় গ্রামের খারাপ পাড়ার দিকে কাউকে কাউকে যেতে দেখা গেছে। ওদের ব্যবসা নাকি বন্ধ হয়নি।
      সারাদিন মুহূর্মুহু ঘড়ি দেখছে সবাই। রাত বারোটা হতে আর কত বাকি!
      অবশেষে বারোটা বাজল। রাস্তার সব বাতি জ্বেলে দেওয়া হল। বাচ্চাগুলো আজন্ম এত দৌরাত্ম্য করেনি, এত কথা বলেনি, এত খেলেনি। তারা ক্লান্ত হয়ে মাঠে, বাড়ির রকে, মন্দিরের বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়রা হইহই করে রাস্তায় নেমেছে। সবাই কথা বলছে, কেউ কারোর কথা শুনছে না। মন্দিরে আরতির ঘন্টা বাজছে। রাজা দর্শন দিচ্ছে, আশ্বাস দিচ্ছে, শিক্ষকেরা নামডাকার খাতা দেখে ভুরু কুঁচকাচ্ছে, এত হাজিরা!
      ঈশ্বরের মুখ থেকে পিঁপড়ের সারি মাটির মধ্যে ঢুকে গেছে। উজ্জ্বল মুখে এখন শৃঙ্গার চলছে। কুমকুম চন্দনে। ভক্তরা গান গাইছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে। শাস্ত্রজ্ঞ বিচার করছে। জ্যোতিষী হাত দেখছে।
      পরেরদিন সকালে ক্লান্ত সবাই সারারাতের এত হুল্লোড়ে। এখন থেকে নিয়ম হল, রাজার নতুন ময়না শেষ রাতেই সবাইকে ঘুম থেকে তুলে দেবে, মন্দিরের ঘন্টা একশো আটবার বাজবে রাত তিনটে হলেই যাতে কেউ ভোরের স্বপ্ন না দেখে। যে উঠবে না তাকে এ দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হবে। তবে ভোরের স্বপ্নই শুধু সত্যি হয় যখন তখন অন্য সময়ের ঘুম বা স্বপ্ন নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। নতুন ময়নাকে নতুন বুলি শেখানো হল, "সব ভালো, সবাই ভালো, সব ঠিক আছে"।