Skip to main content

আবেগী মন আর বিচারী মন। কোন মনের কথা শুনবে? আবেগী মন জেগে উঠলে বিচারী মন কোথায়? মানুষের এ দ্বন্দ্বের সমাধান কিসে? কোথায়?

    দেশলাই এক প্যাকেট, বাতাসা দুশো, চা পাতা একশো, সিগারেট দুটো, মশা মারার ধূপ একটা…. এই তো?

    সন্তু গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, অন্যমনস্ক। বিশুদা মানুষ ভালো, ঠকায় না। আর তার মত মানুষকে ঠকিয়েই বা পাবে কি? সন্তু দাড়িতে হাত বুলিয়ে, টাকাটা দিয়ে স্টেশানে এসে দাঁড়ালো।

    খন্তে মিস্ত্রী স্টেশানে বসে গান শুনছে মোবাইলে। বউটা মাল খেয়ে লাট হয়ে পড়ে স্টেশানে। বাগবাজার স্টেশান। সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা। সাতটার কাছাকাছি রাণাঘাট লোকাল আসে। খন্তে এই সময় আসে না, কিন্তু কার্তিক মাস আসতে চলল, বেলা ছোটো। কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি ছুটি।

    খন্তে বলল, দাদা স্নানে যাবা?

    সন্তু বলল, তাই যাই… রত্না এত দেরি করে রুটি বানাতে শুরু করে… অতক্ষণ দোকানে কে বসে থাকবে ওর? তার চাইতে গঙ্গা নেয়েই আসি… বউটাকে দেখ.. কি অবস্থা….

    খন্তের মোবাইলে বাজছে 'কোথা কোথা খুঁজেছি ত্তোমায়… ত্তুমি জানো না…"

    খন্তে শুনেও শুনল না। উবু হয়ে বসে বিড়িতে টান দিল। বিড়ির সামনের আগুনটায় চোখ আটকালো সন্তুর। সন্তু কিছু না বলে বাগবাজার ঘাটের দিকে এগোলো।

    সন্তু সন্ন্যাসী হল আটচল্লিশ বছর বয়সে। চার বছর কাশীতে ছিল। হাত দেখা শিখে এলো। পসার খারাপ নয়। তবে সন্তুর হাতে পয়সা থাকে কই?

    সন্তু ভালোবেসেছিল ছায়াকে। ছায়াকে যখন ভালোবেসেছিল তখন ছায়ার কপালে সিঁদুর। হাতে শাঁখা। সে সবের সঙ্গে ছায়ার হৃদয়ের যোগ না থাকুক, সমাজের যোগ তো ছিল। খোকনের মন শরীর ছায়াতে ভরেনি। কেন ভরেনি সে খোকন স্পষ্ট করে কোনোদিন বলেনি। ছায়াকে সে যে সহ্য করতে পারত না সেটা বোঝানোই যেন তার একমাত্র কাজ হয়ে গিয়েছিল। ছায়া পুড়ত। সে আঁচে খুশী হত খোকন, ভাবত যদি অন্তত গঙ্গায় ডুবেও মরে। আর সে আঁচে পুড়ত সন্তুর প্রাণ। ছায়ার চোখের উপর বিষণ্ণতা সন্তুকে উদাস করে দিত। তার তখন একটা মোবাইল সারানোর, রিচার্জের দোকান। ছায়া আসত রিচার্জ করাতে। সন্তু ইচ্ছা করে দেরি করাত। ছায়াও ইচ্ছা করেই সে দেরিতে সাড়া দিত। কিন্তু ওই অবধিই। ছায়ার সঙ্গে কোনোদিন সরাসরি মন খুলে মনের কথা হয়নি। যা হয়েছে কাজের কথা। এমন অনেকবার হয়েছে ইচ্ছা করেই ছায়া বসে থেকেছে বৃষ্টি না থামার বাহানায়, পায়ে হঠাৎ মোচের বাহানায়, একটা কল আসার বাহানায়…আরো অনেক অনেক। দু’জনেই পুড়েছে। ছাইয়ের স্তূপ সরিয়ে মণি খুঁজেছে। যে মণির দ্যুতির একটা ঝলক পাবে বলে মানুষ পাগল। পেয়েছে দু’জনেই। কিন্তু সে মণিকে আবার ছাইগাদায় রেখে গেছে। এমনিই।

    একদিন সত্যিই গলায় দড়ি দিল ছায়া। নীল শাড়িটা পরে। যে নীলশাড়িটায় তাকে সব চাইতে সুন্দর দেখাতো। সন্তুর চোখে সে ভাষা পড়েছিল তো ছায়া! জানত তো!

    ছায়া চলে যাওয়ার পর, ছায়া সন্তুকে গ্রাস করল সম্পূর্ণভাবে। সে যতদিন বাইরে ছিল, ততদিন সমাজ ছিল। ছায়াকে শরীর সরিয়ে ছুঁতে পাওয়ায় বাধা ছিল। আজ তো সব পাল্টে গেল। ছায়া রাতদিন সবটুকু জগত জুড়ে বসে। ভালোবাসা এমন ভাষাহীন। হিংসার মত। ঘেন্নার মত। আবেগী মন। বিচারী মনের ভাষার ঘের গলে বেরিয়ে আসে। কেউ দেখেও দেখে না। কেউ উতলা হয়। কেউ মাটি চাপা দেওয়ার মাটি খোঁজে।

    সন্তু সন্ন্যাসী। ঈশ্বরের জন্য সংসার ছাড়েনি সন্তু, ছায়ার জন্য ছেড়েছে। ঈশ্বরকে নিয়ে আসলে কোনোদিন ভাবেইনি সন্তু। যে মন্দিরের বাইরে পা দেয় না তাকে নিয়ে মাথা খারাপ করে কি হবে? মানুষের মনকে নিয়ে ভাবে। মানুষ মানে তো মন। মনই দ্বিরাচারী আবার মনই এক নিষ্ঠায়। আবেগী মনকে বশে না রাখলে আর বিচারী মনকে বল্গা পরিয়ে না রাখলে মানুষ দাঁড়ায় কোথায়?

    সন্তু আবেগ আর বিচার দুটোকেই ছুটি দিল একদিন। ছায়া তার সমস্ত জুড়ে। ছায়া আবেগ বিচার দুইয়ের ঊর্ধ্বে। আবেগ আর বিচারের মধ্যখানে জেগে রত্নবিন্দু। ভোরের সূর্যের মত তার রঙ। শান্তি। ছায়ার কপালের টিপ যেন।

    সন্তু স্নান করে যখন স্টেশানে এলো তখন স্টেশান মোটামুটি ফাঁকা। খন্তা ওর বউকে নিশ্চয় আবার ভ্যানে শুইয়ে বাড়ি নিয়ে গেছে।

    দুটো রুটি কিনে নিয়ে বাড়ি এলো সন্তু।

    আচ্ছা, তবু কেন সে ফিরল এখানে? কাশীতেও কি ছায়া ছিল না? শরীরেরই তো দেশ, রাজ্য। ছায়া তো এখন শরীরের বাইরে, তবে?

    ছায়ার জন্য ফেরেনি আসলে। ফিরেছে খোকনের জন্য। কি করে, কি করে খবর পেয়েছিল খোকনের লিভারে পচন রোগ ধরেছে। ছায়া বলল, যাও। সে মানুষটাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। তাকে দেখার কেউ নেই। সন্তু তুমি যাও।

    তাই সন্তু ফিরেছিল। দেড় বছরের বেশি বাঁচেনি খোকন। পেটে জল জমতে শুরু করল। সে জলে পোকা হয়ে কি ভোগাই না ভুগল। রক্তবমি হত শুরু করল। প্রাণ দিয়ে সেবা করল সন্তু। হাস্পাতালে মারা গেল সন্তুর কোলে মাথা রেখেই। ছায়া বলল, দাহ করে এসো। ফিরে যাবে কাশী?

    সন্তু গেল না। আবেগী মন বলল চ। বিচারী মন বলল এখানে বসলে পসার। সব জায়গাই তো সমান। এই গঙ্গাই সে-ই গঙ্গা।

    সন্তু থেকে গেল। আবেগেও না, বিচারেও না। ছায়ার জন্যেই। মেয়েটাকে কাশী নিয়ে যেতে ইচ্ছা করল না। সে মরলেও এখানেই মরবে। ছায়া আর সে এক হবে। আর জন্মাবে না। ছায়াকে বলবে, মনকে বুঝলে আর পুনর্জন্ম হয় না রে। মনকে পুড়িয়ে ফেল ছায়া। ভালোবাসা জাগবে ধূপের গন্ধের মত। বিচারের পায়ে বেড়ি দে, আর আবেগের পায়ে শিকল। দুটোকেই বাড়তে দিস না ছায়া। ভোরের সূর্যের দিকে তাকা। ভোরের মত শীতল হ।