Skip to main content
ভরা বাদর


---

-এই রোল খাবে?, সেঁজুতির না তাকিয়েই দীপ বলল। দীপ তাকিয়ে আছে রাস্তার ওই ফুটে রোল সেন্টারের দিকে।
 
-না না, যা মেঘ করেছে এখনি না ঢুকলে ভিজে চাপ চাপ হয়ে যেতে হবে, সেঁজুতি দীপের দিকে তাকিয়ে বলল বটে, তবে ওর মুখ দেখে বুঝল রোল না খেয়ে দীপ এক পাও এগোবে না আর।
 
অগাস্টের মাঝামাঝি। সন্ধ্যে হব হব প্রায়। দীপ বলল, তুমি এইখানটাতেই দাঁড়াও, আমি একদৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসছি। দীপ রাস্তা পার হল সাবধানে। বাগুইহাটির এইখানটাতে রাস্তাটা বেশ চওড়া। সেঁজুতি একবার আকাশের দিকে তাকালো। ঘন কালো মেঘ করে এসেছে। 
সেঁজুতি চলন্ত গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে দীপকে দেখতে পাচ্ছে। তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। রোল সেন্টারটাতে বেশ ভিড়। 
 
হঠাৎ করে দমকা হাওয়া শুরু হল। তার সাথে মুষলধারায় বৃষ্টি। সেঁজুতি তাড়াতাড়ি বাসস্ট্যান্ডের শেডের তলায় এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, দীপকে দেখা যাচ্ছে। সে পাশের একটা দোকানের সামনে শেডের নীচে দাঁড়িয়ে। তাকে ইশারা করে কিছু বলছে। সেঁজুতি ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে দেখল, দীপ মেসেজ করেছে। 
 
'লক্ষী হয়ে দাঁড়াও সোনা। আমি অর্ডার দিয়েছি। ওর দিতে দিতেই বৃষ্টি ধরে যাবে দেখো।'
সেঁজুতি বুঝল, দীপ এখন পুরো ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। কোনো যুক্তি শুনবে না। সে একটা স্মাইলি পাঠিয়ে মোবাইলটা ব্যাগে ভরল।
 
গুনগুন করে 'ভরা বাদর মাহ ভাদর' গানটা গাইতে লাগল। 'ভানুসিংহের পদালবী' ক্যাসেটে গাওয়া মোহরদির গানটা মনে পড়ে গেল। উফ্ কি গলা!
 
বৃষ্টির ছাঁটে তার শাড়ীর কিছুটা ভিজছে। তার রাগ হচ্ছে না। দীপকে দেখছে। নীল-সাদা টি-শার্টে ভাল লাগছে ওকে। তেত্রিশ হবে সেপ্টেম্বরে ও। সেঁজুতির থেকে তিন মাসের বড়। দীপ কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে। 
 
এত লোকের মধ্যে সে দীপকে আলাদা করে দেখছে। তার ভাল লাগছে। সেঁজুতি খেয়াল করেছে, অনেকের মধ্যে মিশে থাকলে দীপকে তার বেশি সুন্দর লাগে। ওর দাঁড়ানোর, হাত নাড়ার, কথা বলার ভঙ্গী দেখতে বেশ লাগে সেঁজুতির। একটু গর্বও অনুভব হয়। সে যেন সবার থেকে আলাদা।
মনে হয়, এত মানুষের মধ্যে সে কি করে বাছল তার নিজের মানুষটাকে! কি করে চিনল! ভাবতে বিস্ময় লাগে মাঝে মাঝে সেঁজুতির। দীপ যখন ঘুমিয়ে থাকে, রাস্তার আলো এসে পড়ে দীপের ঘুমন্ত মুখে, সেদিকে তাকিয়ে থাকাটা এখন প্রায় অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। ওর নাক-চোখ-মুখ-ঠোঁট যেন তার কত জন্মের চেনা। আলতো করে সে দীপের কপালে বা মাথায় চুমু খায়। তার চোখে জল আসে, অকারণে। একটা মিষ্টি ব্যাথাও করে বুকের কোণায়। 

হঠাৎ ফোনটা বাজতে চমকে গেল। কোম্পানীর ফোন। ফোন রেখে আবার খেয়াল করল দীপকে। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে মনে হয়। বড্ড ভালোবাসে সে মানুষটাকে। বড্ড। তার চোখ একটু একটু নরম হতেই সে জোর করে দৃষ্টি ফেরাল অন্যদিকে। পারল না। আবার তাকাল। রোজই তাকায়। নতুন করে। রোজই চেনে একটু একটু করে। রোজই মনে হয় একে ছাড়া বাঁচতাম কি করে!


 


---
 
এইভাবে হঠাৎ বৃষ্টিটা চলে আসবে দীপ বুঝতে পারেনি। রোলের দোকানের পাশের শাড়ীর দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেঁজুতিকে দেখছিল সে। এই লাল রঙের শাড়িটা গতবারের পূজোর না?

এই সময়টা বাড়িতে থাকলে নির্ঘাত মোহরদির একটা গান চালিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াত। গুনগুন করে গাইতও সাথে। ওর সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। 

দীপ দেখছিল সেঁজুতিকে। বাসস্ট্যান্ডের নীচে দাঁড়িয়ে ব্যাগটাকে বুকের কাছে ধরে তারই দিকে তাকিয়ে আছে না? মনে হচ্ছে। দীপ একটা সিগারেট ধরালো অফিসের একটা ফোন অ্যাটেন্ড করার পর। সে একটা ট্রাভেল এজেন্সী চালায়। কলকাতায় বেশ নামডাকও হয়েছে। 

সেঁজুতিকে দেখে তার বার বার মনে হয়, যদি সে না আসত তার জীবনে? কি হত? এত মানুষের ভিড়ে কি করে চিনল সে সেঁজুতিকে? সেই তার প্রথম প্রেম। হাইস্কুলে পড়তে প্রোপোজ করেছিল। কি হত ও যদি না বলে দিত? এখনও এই কথাটা ভাবলে দীপের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। বড্ড ভালোবাসে সে মেয়েটাকে। যেদিন ও এসেছিল তার জীবনে সত্যিই কি ছিল সেদিন? কিচ্ছু না! সেঁজুতি তার চেয়ে পড়াশোনায় অনেক ভাল ছিল। অনেক ভাল ছেলের সাথে বিয়ে হতে পারত ওর। ও করেনি। শুধু ওকে ভালবেসে করেনি। এতবড় পৃথিবীতে একজন মানুষ সম্পূর্ণ তাকে ভালোবেসে বাঁচছে, শুধু তাকেই সে ভালোবাসে, এটা ভাবতে খুব বিস্ময় লাগে দীপের। কি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা তার দিকে। সত্যি বলতে মেয়েটা পাশে থাকলেই দীপের নিজেকেই আরো ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা তাকে সব দিয়েছে, সব। তার নাকের কাছটা টনটন করে উঠল। গলার কাছটা ধরে আসল।

-আপনার রোলদুটো রেডি দাদা---, চমকে তাকালো। রোলদুটো নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে আসল। 
 
-এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে কেন?, সেঁজুতি কিছুটা কপট উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলল।
-তুমি ডাকছিলে না?, দীপ খুব গম্ভীরভাবে বলল।
 
সেঁজুতি দীপের চোখের দিকে তাকালো। সে চেনে এই দৃষ্টিটা। একটুও পুরোনো হয় নি। বলল, চলো।
 
-আরে দাঁড়াও, বৃষ্টিটা ধরুক!, দীপ বলল কপট অনিচ্ছায়।
 
-তুমি বৃষ্টিতে ভেজার কথা বললে না একটু আগে?, সেঁজুতি কপট বিস্ময় গলায় মিশিয়ে বলল। 
দীপ এই গলার গলার আওয়াজটা চেনে। হেসে সেঁজুতির হাত ধরে বলল, চলো।

বাসস্ট্যান্ডের এক কোণায় দাঁড়ানো ষাটোর্দ্ধ বিমলবাবুর চোখ জলে ভরে এল। মিত্রা এই রকমই ছিল। চার বছর হল লিভার ক্যান্সারে মারা গেছে। বিমলবাবু অন্ধকার বর্ষণমুখর কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর ক'টা দিন দাঁড়াও মিতা,(উনি ওই নামেই ডাকতেন) আমিও ওই পারে আসছি। গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, 
ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর....

একটা দমকা বাদলা বাতাস হঠাৎ তাঁকে আপাদ মস্তক ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল। তিনি অস্ফুটে বললেন, মিতা!


(ছবিঃ সুমন দাস)