Skip to main content

নীল ফ্রক। পায়ে একটা নীল জুতো। চুলে একটা নীল ফিতে বাঁধা। পার্কে বেঞ্চে বসে। বয়েস নয় বছর, চার মাস, তিনদিন। ফ্রকের গা ছুঁয়ে কাঠের বেঞ্চে শোয়ানো একটা নীল ছাতা।

      একজন বয়স্ক মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মলু একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার সামনের বড় ফ্ল্যাটটার ঝুলবারান্দায় ঝোলানো নীল শাড়িটার দিকে তাকালো। শাড়িটা মনে হচ্ছে উড়ে যাবে। যদি উড়ে আকাশের দিকে যায়, কোনোভাবে আকাশের গায়ে আটকে যায়, কেউ তো বুঝতেই পারবে না কোনটা আকাশ আর কোনটা শাড়ি?

      বুড়ো মানুষটা তার পাশে বসল। মলু তার হাতের দিকে আড়চোখে তাকালো। সাদা হাত, মাঝে মাঝে কালো ছোপ ছোপ, রোগা বলে হাড়গুলো বোঝা যাচ্ছে। একটা গোলাপী জামা আর কালো প্যান্ট পরে বসে। বুড়ো হয়ে গেছে লোকটা। মলু দেখল সে সামনের দিকে তাকিয়ে, তাকে কিছু বলছে না।

      হঠাৎ বুড়োটা বলল, আপনি কে?

      মলু বলল, আমি অনিন্দিতা ঘোষ।

      কোন স্কুলে পড়ো? কোন ক্লাস?

      বুড়ো মানুষটা তার দিকে না তাকিয়েই কথা বলে যাচ্ছে...

      মলু বলল, স্কুল পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে আমি পছন্দ করি না।

      বুড়ো মানুষটা বলল, ওহ্, আচ্ছা, আমি দুঃখিত। আমার নাম সমরেশ হালদার। কলেজে পড়াতাম, বাংলা। এখন আমি অন্ধ।

      অন্ধ কথাটা শুনেই মলু লাফিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে বুড়ো মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি আমায় একটুও দেখতে পাচ্ছ না?

      না দিদিভাই...

      দিদিভাই বলবে না... ওই নামে আমার দাদু ডাকত... এখন মারা গেছে। বলো তো আমি কি রঙের জামা পরে আছি...?

      বুড়ো মানুষটা জিভ কেটে বলল, ইস্..., আমি আবার একটা ভুল করে ফেললাম..., এই বলে সে মলুর দিকে হাত বাড়ালো। মলু নিজেকে একটু এগিয়ে দিল। বুড়ো মানুষটা তার বাঁ কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তুমি তো বেশ লম্বা!

      মলু আবার বেঞ্চে এসে বসল। শীতের দুপুর, কিন্তু রোদের তাপও নেই, ঠাণ্ডাও তেমন নেই। অল্প হাওয়া দিচ্ছে।

      একজন সাইকেল চালিয়ে হুড়দুড় করে এসে বলল, মলু বাড়ি যাও, মা ডাকছেন...

      মলু বলল, না। তার রাগ কি পড়েছে এখনও? পড়েনি তো। মা মোবাইলটা আর কিছুক্ষণ তাকে দিলে মোবাইলটা কি খারাপ হয়ে যেত? যত্তসব!

      তোমার মোবাইল আছে?

      আছে।

      ওতে গেম আছে? দেখি...

      বুড়ো মানুষটা একটা বোতাম টেপা মোবাইল মলুর হাতে দিয়ে বলল, এই আছে...

      মলু বলল, এ বাবা, এতে তো গেম হয় না...

      বুড়ো মানুষটা বলল, আমি অন্ধমানুষ, আমি কি গেম খেলতে পারি?

      তা বটে..., মলুর রাগটা হুস্ করে কেন জানি অনেকটা কমে গেল। খিদে পাচ্ছে অল্প অল্প... সে বুড়ো মানুষটাকে বলল, তুমি কার্টুন, সিনেমা কিচ্ছু দেখতে পাও না?

      বুড়ো মানুষটা বলল, আগে পেতাম... এখন শুধু গান শুনি।

      মলু বলল, ও...

      মলু দেখল একটা কালো পিঁপড়ে বেঞ্চের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মলু পিঁপড়েটাকে ধরে বুড়ো মানুষটার জামায় ছেড়ে দিল। এরকম দুষ্টুমি সে হামেশাই করে। দেখি কি হয়...

      পিঁপড়েটা জামার হাতা বেয়ে বুড়ো মানুষটার রোগা হাতের চামড়ার উপর দিয়ে হাঁটছে। মলু বুড়ো মানুষটার মুখের দিকে তাকালো... ওর সুড়সুড়ি লাগছে না? ও বাবা! সুড়সুড়ি লাগবে কি? ও তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে...

      পার্কের মাঠ থেকে কয়েকটা ঘাস তুলে নিয়ে বুড়ো মানুষটার জামার পকেটে আস্তে করে ভরে দিল। কিচ্ছু দেখতে পায় না? কি আশ্চর্য লাগছে মলুর। সে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকল। সব অন্ধকার না, পাতার চামড়ার উপরে যে আলো পড়ছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে।

      মলু কি করবে বুঝতে পারছে না। বুড়ো মানুষটার ফোন তার হাতে। কল লগ খুলল। শুধু ‘মামণি’ বলে কাকে একটা ফোন করে দাদুটা। সে ফোনটা করে কানে দিল... ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো...

      হ্যাঁ বাবা...

      আমি মলু বলছি...

      কে মলু?...

      আমি বিদ্যাবিনোদ স্কুলে পড়ি, তুমি কে?

      তুমি কি আমাদের বাড়ি এসেছ? কি মিষ্টি গলা তোমার...

      আমি কেন তোমাদের বাড়ি যাব... আমি পার্কে...

      মানে... বাবা পার্কে...! সর্বনাশ...!!! শোনো মলু, আমার বাবা সব ভুলে যান... উনি ভুল করে পার্কে চলে এসেছেন।

      তুমি বকছ কেন? ভুল করে কেউ পার্কে আসে বোকা? ইচ্ছা করে আসে... রাগ হলে।

      শোনো লক্ষ্মীটি... তোমার বাবার নাম কি?

      প্রদীপ মিস্ত্রী...

      আমি চিনি না। শোনো না... তুমি একটু বাবাকে পৌঁছে দেবে?

      তোমার বাবাকে নীলডাউন করে রাখব?

      কেন?

      কেন, আমার মিসেরা পড়া ভুলে গেলে নীলডাউন করায় তো...

      মলু ফোনটা কেটে দিল। তারপর সুইচ অফ্ করে দিল। বুড়ো মানুষটাকে ধাক্কা মেরে বলল, এই তুমি বাড়ি ভুলে গেছ?

      বুড়ো মানুষটা চোখ খুলে বলল, আমি কোথায়? আমি টয়লেটে যাব...

      মলু জানে পার্কে টয়লেট কোথায়। সে হাতটা ধরে বলল, এসো...

      মলু বলল, দোলনায় চড়বে?

      বুড়ো মানুষটা বলল, কই... কই..

      মলু হাত ধরে বুড়ো মানুষটাকে দোলনার কাছে এনে, দোলনার কাঠটায় দাদুটার হাতটা ছুঁইয়ে বলল, বসো।

      বুড়ো মানুষটা বসল। দু'পাশে লোহার শিকল আঁকড়ে বসল।

      মলু দাদুটার পিছনে গিয়ে ধীরে ধীরে দোলনাটা দোলাতে দোলাতে বলল, তুমি বাড়ি ভুলে গেছ?

      বুড়ো মানুষটা কিচ্ছু বলল না। মলু আবার সামনে এসে দেখল দাদুটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। নাহ্‌, একে তো বাড়ি দিয়েই আসতে হবে...

      মলু আবার ফোনটা অন্ করতেই বুড়ো মানুষটার মেয়ের ফোন এল...

      তুমি ফোনটা বন্ধ করেছিলে মলু...

      তুমি বাড়িটা কোথায় বলো।

      তোমার আশেপাশে কেউ নেই? বড় কেউ নেই?

      মলু চারদিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ কেউ আছে।

      মলু বলল, না

      মলু এক হাতে কানে ফোন নিয়ে, আরেক হাতে দাদুকে ধরে হাঁটতে লাগল, দাদুর বাড়ি তাদের গলির দিকেই...

      দাদুটা মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে কেন?

      ওটা একটা অসুখ মলু... সব ভুলে যায়, ঘুমিয়ে পড়ে।

      আমার বাবার আছে...

      কি আছে মলু?

      মা বলে, আমার বাবা আমাদের ভুলে গেছে... মা তাই আমায় নিয়ে একাই থাকে। কি করে আমায় বড়ো করবে বুঝতেই পারে না। রাতদিন বলে...

      হুম... তুমি খুব ভালো মলু...

      জনাই আসছে। তাকে রাস্তায় দেখতে পেয়েই সাইকেল থেকে নেমে পড়ে কিছু বলতে গেল... মলু ইশারায় তাকে থামতে বলে পাশে হাঁটতে বলল। জনাই তার পাশের বাড়ি থাকে, তাকে পড়ায়, নিজে কলেজে পড়ে।

      জনাই তার কানে কানে বলল, তুমি পোস্টমাষ্টার দাদুকে কোথায় পেলে?

      মলু বলল, পোস্টমাষ্টার না, কলেজে পড়ায়...

      কার সঙ্গে কথা বলছ মলু?

      এই যে এই নাও জনাই দাদা...

      আর বাড়ি চিনতে অসুবিধা হল না।

 

      এরপর থেকে মলুর একটা পরিবর্তন হল। সে রাগ হলে আর পার্কে যায় না, ভুলো দাদুর বাড়ি যায়। শুধু রাগ হলে না, এমনি এমনিও যায়, মা-ও যায়। এই তো জন্মদিনে মা নেমন্তন্ন করে খাওয়ালো ভুলো দাদুকে। ভুলো দাদু মলুকে চিনতে পারে, আবার পারে না... মলু'র খালি খালি নতুন নাম দেয় --- চটাই... ভল্লু... মানসী... অতসী...

      সব নাম মলু খাতায় টুকে রেখে দিয়েছে। এত নাম কেউ কাউকে দেয় নাকি রোজ রোজ! ভুলে যাবে না! শেষে কি সেও হবে ভুলো মলু?