Skip to main content
 
 
 
       জামাটা বদলাতে ঘরে ঢুকেছিল নিত্য। কাকে পায়খানা করে দিয়েছে। আজ মিলে বিশ্বকর্মা পুজো। নিত্য পৌরহিত্য করবে। এমন অশুচি হয়ে যেতে ইচ্ছা করল না। 
       দোতলায় দুটো ঘর নিয়ে ভাড়াবাড়িতে নিত্য আর বন্যার সংসার, দুই ছোটো ছেলে। নিত্য ঢুকে দেখল বন্যা ঘরে নেই। যদিও এখনি বেরোতে হবে, তাড়া আছে, তবু বন্যাকে একবার না দেখে বেরোতে অস্বস্তি লাগছিল নিত্যের। ইচ্ছা করে দেরি করল, ইতিমধ্যে যদি চলে আসে। ছেলেদুটো সামনের বাড়ি পড়তে গেছে। আজ স্কুল ছুটি। কিন্তু বন্যা কোথায়? নিজের থেকে রান্নাঘরের দিকে যেতেও লজ্জা লাগছে। নিত্য বাইরে একটা গাম্ভীর্য রেখে চলে। বন্যার কাছেও। সহসা আড় ভেঙে ভালোবাসার কথা বলা, বা ফষ্টিনষ্টি করা তার আসে না। ছ্যাবলামো মনে হয়। 
       কিন্তু আর তো দেরি করা যায় না। একটু ইতস্তত করেই সে রান্নাঘরের দিকে গেল। নেই। বঁটিটা উপুড় করে রাখা। শাকসব্জীগুলো ধুয়ে পাশে রাখা। মাছটা ঝুড়ি চাপা দেওয়া। পিঁড়িটাও পাতা। গেল কই? এই তো তাকে এগিয়ে দিল। দশ মিনিটের মধ্যেই উধাও? নীচের ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞাসা করবে ভাবল। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে না সেরকম একটা নিত্য। আর বন্যা তো খুব দরকার না হলে যায়ও না খুব একটা। দোতলার বারান্দার কাছে এসে ঝুঁকে বন্যার গলার আওয়াজ শোনার চেষ্টা করল। নাহ, মনে তো হচ্ছে না গেছে।
       ছাদে যায়নি তো? ছাদ নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। এই ছাদে কার্ণিশ নেই। একবার এক মহিলা কি করে পড়ে মারা গিয়েছিল তাদের আসার আগে। এই ঘরেই ভাড়া থাকত তাদের আগে। সেই থেকে বাড়িওয়ালার নির্দেশে ছাদে যাওয়া বন্ধ। যদিও চাবিটা নিত্যদের কাছেই রাখা থাকে। ছাদে নেই তো? নিত্যের বুকটা এক মুহূর্তে অকারণ কিছুর আশঙ্কায় শুকিয়ে গেল। কিছুটা কাঁপা কাঁপা পায়েই ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। এই মুহূর্তে কি স্পষ্ট করে তার মনে হল বন্যা ছাড়া তার পক্ষে যেন এক মুহূর্ত শ্বাস নেওয়াও অসম্ভব। কত বড় বাড়ির মেয়ে, কিন্তু কি সহজে তার অল্প মাইনে, তার জেদ, তার অবুঝপানা মেনে তাকে ভালোবেসেছে মেয়েটা। একটা অজানা কৃতজ্ঞতায় বুকটা ভারি হয়ে এল। স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়েই জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছা করল। কামনায় না, অসীম কৃতজ্ঞতায়।
       ছাদের দরজাটা খোলা। সদ্য আসা শরতের আকাশে নীলরঙ বিন্দু বিন্দু জমছে। সাদা সাদা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মেঘ। ঘুড়ি উড়ছে প্রচুর। ও আজ বিশ্বকর্মা পুজো তো! ঘুড়ি ওড়ানোর দিন। শেষ সিঁড়ির ধাপে পৌঁছিয়েই নিত্যর চোখে পড়ল বন্যা দাঁড়িয়ে, তার দিকে পিছন ঘোরা, মাথাটা উঁচু করে ঘুড়ি ওড়ানো দেখছে। তার সদ্য স্নান করা ভিজে চুল প্রায় হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে এসেছে ঝালরের মত। আকাশী-নীল রঙের একটা শাড়িতে মনে হচ্ছে সদ্য আকাশ ছুঁয়ে এলো যেন। সে রঙমাখা তার শাড়ি। হলুদ ব্লাউজের কাঁধের কাছটা ছেঁড়া। তার ফর্সা গায়ের রঙ সেই ফাটা অংশ দিয়ে এমন ঠিকরে বেরোচ্ছে যেন শ্রাবণের ছেঁড়া মেঘ চিরে পূর্ণিমার চাঁদের ঝলক। এত রূপ বন্যার? এই জলজ্যান্ত মানুষটা সম্পূর্ণ তার? এত ভালোবাসা, এত মাধুর্য নিজের মধ্যে দেখে নিজেকেই যেন প্রথম দেখল, এমন বোধ হল নিত্যের। বন্যাকে ডাকল, এই শুনছ?
       বন্যা চমকে ফিরে তাকাতেই, একটা ছেঁড়া ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া সুতো ওর চোখের উপর তেরছা হয়ে পড়ল, ও "উফ" আওয়াজ করে হাতটা মুখের উপর দিয়ে সুতোটা সরাতে গিয়ে টাল সামলাতে পারল না। নিত্য চোখের সামনে দেখল বন্যা ছাদের থেকে মিলিয়ে গেল। তার চোখের সামনে শূন্য শরতের আকাশ। কারা চীৎকার করছে ভোক্কাটা... ভোক্কাটা...