হাট বসেছে। চায়ের দোকান চালায় স্বামী, স্ত্রী। দুজনেরই বয়েস ষাটের উপর। যে বয়েসকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাণপ্রস্থের জন্য বেছেছিলেন আরকি। স্ত্রী বসে বসে চা বানান। স্বামী ঘুরে ঘুরে চা দেন। স্ত্রী লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে। ঠোঁট পানে লাল। হাসিতে এতটা রাস্তা পেরিয়ে আসার আত্মবিশ্বাসী সুখ। স্ত্রীর ছানি অপারেশন হয়েছে। স্বামী পরের বছর করবে। “একসঙ্গে করলে দোকানে কে বসবে?”
দোকানে ভিড় আছে। একজন বয়স্ক মানুষ এল, অল্প বয়েসী এক ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটার বয়েস আট কি নয় হবে। যে বয়সের বাচ্চাদের সাধারণত চায়ের দোকানে দেখতে অভ্যস্ত নই।
“দুটো বিস্কুট দেবেন।”
একটু পর বুঝলাম ঠাকুর্দা আর নাতি। ঠাকুর্দা চা নিল। নাতি বিস্কুট। দুটো। একটা হাতে ধরা, আরেকটায় কামড় দিল। দুটো ছোট্টো পাতলা ঠোঁটের মধ্যে মিলিয়ে গেল বিস্কুটের একটা টুকরো। চোখদুটোতে বড় উদাসীনতা। এই বয়সে কেন?
দোকানের বয়স্কা মহিলা চা ছাঁকতে ছাঁকতে জিজ্ঞাসা করল, অপারেশন হয়ে গেছে?
বাচ্চাটা ঠাকুর্দার মুখের দিকে তাকালো। ঠাকুর্দা বলল, হ্যাঁ। ডাক্তার বলছে ভালোই হয়েছে। দেখা যাক। বাড়িতে মুখ ভার করে বসেছিল। ওর বাবাকে তো এখন হাস্পাতালেই থাকতে হবে কদিন। আমি বললাম, চ… ঘুরে আসি।
চা টা ঠাকুর্দার হাতে দিয়ে দোকানের বয়স্ক মানুষটা বলল, মা ঠিক হয়ে যাবে রে.. ভাবিস না..
বাচ্চাটা ছলছল চোখে রাস্তার দিকে তাকালো।
এ কষ্টটা আমি জানি। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে কি ফোরে পড়ি। মায়ের গ্যাস্ট্রিক আলসার হল। দাদু ডাক্তার, এসে নিয়ে গেলেন। আমরা তখন হাওড়া সালকিয়ায় থাকি। যেদিন মা মামাবাড়ি গেলেন তারপরের দিনে সব কাজে তাল কাটল। একটা ব্যথা যে এত দীর্ঘস্থায়ী হয় আগে জানতাম না। বাবা রবিবার বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যান। ঠাকুমা, জেঠিমা সবটুকু দিয়ে খেয়াল রাখেন। কিন্তু একটা ব্যথা এত যে বুক কামড়ে পড়ে থাকে কে জানত। আমার সে স্মৃতি আজও স্পষ্ট। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হল বলি, আমি জানি তোর কি হচ্ছে। মা ছাড়া গোটা বাড়ি, গোটা জীবন অর্থহীন, তালছাড়া লাগে। খাবার গলা দিয়ে নাবার আগে কান্নার দলা গিলে নিতে হয়। তারপর খাবার যায়। সব জানি আমি। এমন হয়।
ঠাকুর্দার কোল ঘেঁষে বসে। বিস্কুট ফুরিয়ে গেছে। ঠাকুর্দা গল্প করছে দোকানে একজনের সঙ্গে। ছেলেটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে। চা বানাতে বানাতে বয়স্কা মহিলা দু একবার তাকালো বাচ্চাটার দিকে। কিছু বলল না। পুরু চশমার কাঁচের পিছন দিয়ে যতটা স্নেহ, প্রার্থনা পৌঁছানো যায় সবটা পাঠালো। বোঝা যায় যে। ভালোবাসার একটা ওম আছে।
ঠাকুর্দার সঙ্গে উঠে গেল। বাজারে মিলিয়ে গেল বাঁক পেরিয়েই। আমারও ফিরতে হবে। বাজারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। আমাদের বাঙালিদের বাজারের মধ্যেও মন্দির থাকে। সাধারণত কালীমন্দির। এখানেও আছে। পায়ে দুটো জবা। মুখে একগাল হাসি। মা দাঁড়িয়ে। শীতের চাদর গায়ে জড়িয়ে। দেবতার ঠাণ্ডা লাগে না। মায়ের লাগে। মা এখানে স্বর্গ থেকে নামেননি, হৃদয়ের শূন্যতা থেকে জন্মেছেন। পূর্ণ করবেন বলে। বিশ্বাস করলে সুখ। একটা মানুষের সঙ্গে আরেকটা মানুষের যত ভাবেই সম্পর্ক হোক না কেন, যত নামই দেওয়া যাক না কেন, সবেরই প্রথম কথা বিশ্বাস। আর সব বিশ্বাস জন্মানোর আগে যে শব্দটা জন্মায়, সেটা মা। আমি জন্মারও আগে যে সম্পর্কটা আমার জন্য কোল পেতে বসেছিল। শীতের বাতাসে আমার চোখের জলকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এতবড় আকাশ, পৃথিবী, এত এত মানুষ সব আমার আছে। আজ শুধু মা নেই। তবু আছে। কান্না হয়ে আছে। থাকবেও। যতদিন আমি আছি।
বাচ্চাটার জন্য প্রার্থনা জানালাম। কি হয়েছে তার মায়ের জানি না। সব ঠিক হয়ে যাবে। যেতেই হবে। এত অল্প বয়সে এতবড় আঘাত পেতে নেই!