Skip to main content

 মানুষটার আত্মবিশ্বাস এমন ছিল না যে সে ঈশ্বরের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে৷
 মানুষটার হৃদয়টা এমন পরিণতও ছিল না যে সে মানুষের, গাছের, আকাশের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে৷
 মানুষটা একটা অন্ধকারের থলে বগলের তলায় নিয়ে চলে-ফিরে বেড়াত৷ যখন তখন থলের মধ্যে সেঁধিয়ে নিজেকে বলত -- টুকি!
       কিন্তু মানুষটা অকৃতজ্ঞ ছিল না৷ ভুলো ছিল৷ সব চাইতে বেশি ভুলত নিজেকে৷ নিজের হাত, পা, চোখ, কান, মেরুদণ্ডকে মাঝে মাঝেই ভুলে যেত৷ নিজেকে কখনও ভাবত ঘাস৷ কখনও ভাবত পোকা৷ কখনও বা শ্যাওলা জমা পাথর৷
       এই তো সেদিন, লোকটা এক দেশলাই বাক্স শুঁয়োপোকা নিয়ে মাঠে গেল৷ বাক্স খুলে সব শুঁয়োপোকাগুলো মাঠের নরম সবুজ ঘাসে ছেড়ে দিয়ে, বগল থেকে অন্ধকারের থলেটা পাশে নামিয়ে চিৎ হয়ে শুলো৷ তখন শহরের ঘড়িতে দশটা বেজে আঠাশ মিনিট, সকাল৷ মানুষটা আশেপাশে নজর করে দেখল ঈশ্বর দেখছে কিনা৷ না -- কেউ কোত্থাও নেই৷ শুকনো পাতা বাতাসে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে৷ বেড়াক -- না কুড়োতে গেলেই হল৷ তখনই ওরা ভয় পাবে৷ মৃত হবে৷
       শুঁয়োপোকাগুলো মাঠে গান গেয়ে বেড়াতে বেড়াতে মানুষটার সারা শরীর ছেয়ে ফেলল হঠাৎ৷ তখন দূর থেকে মনে হল একটা কম্বলচাপা মানুষ শুয়ে৷ মেঘ করে এল৷ বৃষ্টি এল টাপুর টুপুর নদে এল বান৷ সব শুঁয়োপোকাগুলো গেল ভেসে৷ মানুষটা তখন অঘোরে ঘুমিয়ে৷ শুকনো পাতাগুলো ভেসে যেতে যেতে সব শুঁয়োপোকাগুলোকে কোলে তুলে নিল৷ বৃষ্টি যখন থামল তখন বিকাল৷ এতক্ষণ পরে সূর্য আবার উঠেছে আকাশের পশ্চিম ঢালের দিকে৷ মানুষটা চোখ মেলে চাইল৷
       মানুষটার কিছু মনে নেই৷ শুঁয়োপোকার কথা, দেশলাই বাক্সের কথা, শুকনো পাতার কথা৷ চোখ খুলে তার প্রথম মনে হল -- খিদে পেয়েছে৷ খিদে পেলে তার লজ্জা লাগে৷ মনে হয়, এখনই যদি পুরো খিদেটাকে সামলাতে না পারে তবে গোটা পৃথিবী যদি সে গিলে ফেলে? তবে ঈশ্বর বাঁচবে কি নিয়ে? হাঁটবে কোথায়? যদিও সে জানে ঈশ্বর স্বর্গে থাকে, কিন্তু স্বর্গের কথা কি ছাই তার মনে আছে? স্বর্গের কথা ভাবতে যে আত্মবিশ্বাস লাগে সেও তার নেই, তাই ভাবতেও লজ্জা লাগে৷ নিজের ঠাকুমার কথা মনে পড়ে৷ তার ঠাকুমার একটা লতানে কুমড়ো গাছ ছিল৷ সে গাছ কিছুতেই মাচায় উঠতে চাইত না৷ মাচায় ওঠালেই সে কোনো না কোনো অছিলায় মাটিতে নেমে গড়াগড়ি খেত৷ ঠাকুমা বলত, নামলি কেন রে মুখপোড়া? সে বলত, স্বর্গের দিকে উঠতে আমার লজ্জা লাগে৷ ঠাকুমা বলত, মর, মর, মর, অভাগা৷
       সেই কুমড়োগুলোর স্বাদ হত পানসে৷ সবাই বলত স্বর্গের জল না পেলে কি আর স্বাদ হয় কুমড়োর? ঠাকুমার কান দুটো লাল হয়ে যেত লজ্জায়৷ কুমড়োগুলো ফিসফিস করে বলত, আমাদের তোমার ঐ আঁচলের আড়ালে ঢেকে ফেল -- ছি ছি! কি লজ্জা! ঠাকুমা ওদের আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে রাতে ভাতের সাথে সেদ্ধ করে নিজেই সব খেয়ে ফেলত৷ আর মাঝে মাঝে তাকে দিত কয়েক দলা৷ সেই থেকেই যেন তার মধ্যে কুমড়োর সত্তা৷
       মানুষটা দাঁড়াল৷ চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখল৷ কাদের কথা যেন মনে পড়তে পড়তেও পড়ল না৷ বগলের নিচে অন্ধকার থলেটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল৷ হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার হল৷ সে 'হাঁ' করে হাঁটতে শুরু করল৷ 'হাঁ' করে হাঁটলে অনেকটা অন্ধকার খেয়ে নিতে পারে৷ অন্ধকার খেতে তার লজ্জা লাগে না৷ অন্ধকার এত বেশি, এতই বেশি, যে তা সে লক্ষ বছর ধরে খেলেও অন্ধকার ফুরাবে না৷
       অনেকটা অন্ধকার খেয়ে একটা বড় আর তিনটে ছোট ঢেকুর তুলে মানুষটা একটা বড় বৃদ্ধ বটগাছের তলায় এসে শুলো৷ পাশে তার অন্ধকারের থলে৷ ঘুম আসছে না৷ মানুষটা এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবতে থাকল কেন ঘুম আসছে না৷ আসলে সে তো ভুলেই গেছে যে সে সারাটাদিন ধরে ঘুমিয়েছে৷ এমনকি তার কাপড়-জামা যে ভিজে সেটাও সে খেয়াল করে নি৷ কোনো কিছু নিজের সম্বন্ধে খেয়াল করতে তার লজ্জা লাগে৷ মনে হয় নিজেকে অনেক বেশি খেয়াল করতে করতে যদি নিজে লম্বা হতে হতে পুরো পৃথিবীটা সে নিজে হয়ে যায়? তবে ঈশ্বর ঘুমাবে কোথায়?

       মানুষটা তারা গুনছিল৷ এমন সময় 'খুট্' করে আওয়াজ৷ একটা কাঠবিড়ালি তার চুলের মধ্যে ঢুকল, বেরিয়ে এল৷ বগলের মধ্যে ঢুকল, বেরিয়ে এল৷ তার অন্ধকারের থলের মধ্যে ঢুকল, বেরিয়ে এল৷ সে মানুষটার কানের কাছে এসে বলল, ঘুমাওনি এখনও? মানুষটা হঠাৎ করে ঘাবড়ে গেল, ঘুম! কাকে বলে ঘুম? ঘুমাতে তো চোখ লাগে, তার চোখ কই?
       কাঠবিড়ালি বলল, ঘুমাও, ঘুমাও, নইলে ঈশ্বর বকবে যে!
       মানুষটা ধড়মড় করে উঠে বসল৷ বলল, কই ঈশ্বর?
       কাঠবিড়ালি বলল, গাছের মগডালে বসে, তারা বানাচ্ছেন আর আকাশে টাঙিয়ে টাঙিয়ে রাখছেন৷
       মানুষটা আর কিছু শুনল না৷ রুদ্ধশ্বাসে দৌড় লাগালো৷ এমন দৌড় সে কোনোদিন দৌড়ায় নি৷ তার সবক'টা হাড়, হাড়ের সন্ধি, পেশি, নখ, চিৎকার করতে শুরু করল৷ সেই চিৎকারে ঘুমন্ত পাখি, গরু, মোষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি --- তুমুল শোরগোল তুলল৷ লোকটা ভয়ে ভয়ে ভাবল তার বগলে রাখা অন্ধকার থলেটার মধ্যে ঢুকে পড়ে৷ কিন্তু কোথায় থলে? সে তো সেই বৃদ্ধ বটগাছের তলায়৷ ফিরবে? কিন্তু গাছের মাথায় ঈশ্বর বসে না! তবে? সে দৌড়াতে দৌড়াতে শহরে এসে পৌঁছাল৷ শহরের ঘড়িটা প্রথম দেখল -- পৌনে চারটে বেজেছে৷ কাঁটার উপর ঘুমন্ত পাখির সার৷ বুলবুল পাখিই মনে হল৷ পাছাগুলো লাল৷
       শহরের মাঝে একটা ঝিল৷ সেই ঝিলে গতকাল একটা বড় উৎসব হয়েছে৷ সেই উৎসবের আনন্দে, উল্লাসে অনেক পাখি আর মাছ মরে ভেসে আছে জলে৷ কি আনন্দের দাগ তাদের ডানায়, পাখনায়, ঠোঁটে৷ মানুষটা ঝিলের ধারে এসে দাঁড়ালো৷ এত মৃত শরীরের সৌরভে তার মন বিকল হল৷ সে তন্ময় হয়ে রইলো খানিক৷ তারপর নিজের মনে মনে বলল -- হাড়িম হাড়িম, দ্রিম দ্রিম দ্রিম৷ যদিও মনে মনে বলল, কিন্তু তার জিভের পেশিগুলো শুনে নিল৷ তারা সবাই মিলে জিভকে ঠেলে জাগিয়ে বলল, বলো -- হাড়িম হাড়িম, দ্রিম দ্রিম দ্রিম৷ জিভ বলে উঠলো৷ সাথে সাথে সব মৃত পাখি আর মাছ একসাথে বেঁচে উঠে ভোরের আলোয় গেল মিলিয়ে৷ মানুষটা এই প্রথম ভোর হওয়া দেখল৷ তার মনে হল ভোরের হাওয়ায় তার বগলের দীর্ঘদিনের ঘা শুকিয়ে যাচ্ছে, যে ঘা-টা অন্ধকারের থলের জন্য হয়েছে৷ সে দু'হাত তুলে কার জন্য যেন বলে উঠলো, ভালো থেকো৷ তার চোখে জল এল৷ চোখের পলকের উপর ফুটল জুঁই-এর মত সাদা সাদা সুগন্ধী ফুল৷

       এমন সময় এক বৃদ্ধ তার সামনে এসে দাঁড়াল৷ সারা গায়ে ছেড়া কালো চাদর জড়ানো৷ মুখে দাড়ি। চোখদুটোর কোণে পিচুটি৷ চোখদুটো ভীষণ গভীর৷ তার দিকে তাকিয়ে বলল, দুটো পয়সা দেবে?
       মানুষটা বলল, আমি ভিখারি, কই পয়সা আমার?
       বৃদ্ধ বলল, তোমার পলকে ফোটা দুটো ফুল দাও৷
       মানুষটা জানতই না ফুলের কথা৷ সে হাত বাড়িয়ে নিল৷ অবাক হয়ে বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বলল, তুমি কে?
       বৃদ্ধ বলল, ঈশ্বর৷
       মানুষটা ভাবল, সে বুঝি ভয় পাবে৷ পেল না৷ অবাক হল৷ তার হৃদয়ে ভোরের শিশিরের মতো করুণা৷ সে বলল, তুমি.....
       বাক্যটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার কিছু বলার নেই৷ তার এখন ঈশ্বরের সামনে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস আছে৷ তার চোখে, মুখে, হৃদয়ে সাড়া জেগেছে৷
       বৃদ্ধ হেঁটে কোথায় চলে গেল। মানুষটা দীঘির জলে বসল পা ডুবিয়ে। এতক্ষণ পরে আবার খিদে পাচ্ছে। হাঁ করে খানিক বাতাস খেল। পেট ভরল না। জল খেল, মাটি খেল, তাও পেট ভরল না। খাবার খুঁজতে হবে, পেট ভরানো খাবার, মনে তৃপ্তি আনা খাবার। এই ভেবে যেই সে দীঘির জল থেকে পা দুটো তুলে মাটিতে দাঁড়াতে গেছে, কি ঠেকল তার পায়ে। ভিক্ষাপাত্র। বৃদ্ধ ঈশ্বর রেখে গেছে। তার জন্য? যেই সে হাতে তুলে নিল সে পাত্র, তার মনের মধ্যে ঘেমেনেয়ে তেতেপুড়ে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার সুখ হল।
       সে মনে মনে বলল, এ পাত্রটুকু আমার, ভিক্ষা আসুক তোমার হাত ছুঁয়ে, আমি তৃপ্ত হই, ভিক্ষালব্ধ বস্তুতে না, ভিক্ষা আনা হাতের স্পর্শে।