সৌরভ ভট্টাচার্য
16 January 2020
সাইকেলটা রাস্তার একদিকে স্ট্যাণ্ড করা। সাইকেলে দুটো বড় বড় ব্যাগ। চানাচুর, বিস্কুট। আজকের মত কাজ শেষ। সাড়ে সাতটা বাজে। রেলগেটটা বন্ধ। মেয়েটা ওড়নাটা পিঠের দিকে নিয়ে গিঁট বেঁধে দাঁড়ালো। কিছুটা উদ্বেগে সাইকেলের নীচের দিকে তাকালো। চেন পড়ে আছে। অন্যদিন হলে নীচু হয়ে বসে চেনটা তুলে দিত। আজ বসা যাবে না ওভাবে। মাসের দু একটা দিন অসুবিধা তো হয়ই। আর পাশের চায়ের দোকানে ভিড়ও হয় এই সময়টায় খুব।
একটা মালগাড়ি গেল। ছেলেটা আজও দেখছে। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে দেখছে। আড় চোখে। রোজ দেখে। সে চা খেতে এলেই তাকিয়ে দেখে। দৃষ্টি তো কত পড়ে সারাদিন, কিন্তু শরীর ভেদ করে কই? শরীরের কয়েকটা জায়গা ঘুরে সে দৃষ্টি মিলিয়ে যায় নিভে যাওয়া ফুলঝুরির মত। কিন্তু এই তাকানোটা অন্যরকম। সরাসরি ভিতরে এসে বেঁধে। সামনের ওই ওষুধের দোকানে কাজ করে। চেনগেটটা পেরিয়ে মোড় ঘুরে দশ পনেরো মিনিট সাইকেল চালালে মেয়েটার বাড়ি। ওষুধের দোকান এই তল্লাটে একটাই। তবে কি ও জানে? গত পরশু কিনে নিয়ে গেছে মাসি। পাড়ার মাসি, তাদের পাশের বাড়ি থাকে। মনে থাকবে ছেলেটার? কত মানুষই তো কেনে। তাকেই মনে রেখে দেবে?
ছেলেটা নেই। দোকানে চলে গেছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীত শীতও করছে। মেয়েটা ব্যাগ থেকে সোয়েটার বার করে গায়ে দিল। ছেলেটাকে খুঁজেই যাচ্ছে অন্যমনস্কভাবে। সাইকেলের চেনটা না তুললে এত ভারী ব্যাগদুটো নিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় অদ্দূর? বসে যে চেনটা লাগাবে তাও তো... একবার মনে হচ্ছে বসে যাই... লাগিয়ে ফেলি... কিন্তু একটা অস্বস্তি... ভয়... চায়ের দোকান ভর্তি পুরুষ.... রেলগেটটা আবার বন্ধ হল।
এক ভাঁড় চা নিয়ে এসে সাইকেলটা ঘেঁষে দাঁড়ালো। সাইকেলটাকে ছুঁয়ে থাকলে নিরাপদ লাগে, সাইকেল কি পুরুষ? মা ছোটোবেলায় অন্য মানুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। বাবা মদ খেয়ে চুর থাকত সারাদিন, বাবারই এই ব্যবসা ছিল। একটা বোন বাড়িতে, পড়ছে। পড়ুক। যদ্দিন পারে পড়ুক, অন্তত মাধ্যমিক অবধি।
ছেলেটাকে ডাকবে? থাক। বৃষ্টিটা বাড়ল। একটা বন্ধ দোকানের শেডের তলায় এসে দাঁড়াল।? মেয়েটার নাম বৃষ্টি। সে যখন জন্মেছিল তখন নাকি ভীষণ বর্ষা, কয়েক সপ্তাহ ধরে চলেছিল। বাবার মুখে শোনা। মায়ের মুখই মনে পড়ে না, তো কথা। মনে পড়ে না? না মনে করতে চায় না? জানে না বৃষ্টি। মায়ের উপর অভিযোগ নেই, রাগ আছে। চাপা রাগ। যখন তখন বেরিয়ে আসে। মুক্তাকে অকারণে মারে, খায় না, বাবার খাবারে নুন দিয়ে দেয়, মাতাল তো, বোঝেও না। মুক্তা কিছু বলে না। আজকাল কাঁদেও না। তার হাত ছাড়িয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। বৃষ্টির কান্না আসে না, গোঙানি আসে, তার সাথে গরমের একটানা দুপুরের মত বিরক্তি, ক্লান্তি। মা বেঁচে গেছে, শুনেছে দিল্লীতে থাকে।
চায়ের ফাঁকা ভাঁড়টা হাতে ধরেই দাঁড়িয়ে বৃষ্টি। দোকানে ষাঁড়ের মত চিল্লাচ্ছে লোকগুলো, রাজনীতি নিয়ে তর্জা। ছেলেরা ভীষণ অকাজের বকবকানি নিয়ে থাকে। কিন্তু ও কোথায়? দেরি হচ্ছে, আজ ডাকতেই হবে, চেন তুলতেই হবে।
বৃষ্টি হাঁটতে শুরু করল, বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। বিরক্তি লাগছে। মাসি দুদিন আগেই ওর দোকান থেকে নিয়ে গেছে, ছেলেটা জানে সে এখন অসুবিধার মধ্যে, হয় তো ছেলেটা নিজের হাতেই খবরের কাগজে মুড়ে দিয়েছে... নোংরা চিন্তা করেছে তাকে নিয়ে, যতই সরল চোখে তাকাক... ওসব মুখোশ.... ভণ্ডামি... বাগে পেলেই শিকারী শিকারী খেলা.... সব পুরুষ অব্ধকার খোঁজে… আড়াল খোঁজে... মেয়েমানুষ পেলেই...
ওষুধের দোকানটা বন্ধ। কিন্তু আজ তো মঙ্গলবার, আজ বন্ধ কেন? হঠাৎ দিশাহারা লাগল বৃষ্টির। ভীষণ অসহায়। পাশের মুদির দোকানে জিজ্ঞাসা করল, এ দোকানটা বন্ধ কেন?
- ও তো চারদিন হল বন্ধ... দুই মালিকে গোলমাল হয়েছে...
- ও... আর যে ছেলেটা কাজ করে?
- হ্যাঁ, কে?
- না কিছু না..
- আরে আমি আগেই জানতাম হবে....
তবে মাসি কোন দোকান থেকে কিনতে গিয়েছিল? মানে ও জানতই না?... তবে কি আমার জন্যেই দাঁড়িয়েছিল? আমাকে দেখতেই... প্রচণ্ড কান্না... সজল কান্না... গোঙানি নয়.... একরাশ মিথ্যা কালো চিন্তা মাথা থেকে গলে গলে পড়ছে... বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে.... বুকের মধ্যে ভিজে প্রজাপতি একটা শুকনো রুক্ষ পাঁজরের দেওয়াল বেয়ে উঠছে....
চায়ের দোকানে ভর্তি পুরুষমানুষের ভিড়... বৃষ্টির স্থির বিশ্বাস সে ওই ভিড়েই মিশে দাঁড়িয়ে.. তাকে অসহায় দেখে সে এভাবে রাস্তায় রেখে চলে যেতে পারে না... প্রজাপতিটার ডানা শুকাচ্ছে... বিশ্বাসের ওমে শুকাচ্ছে.... বাঁচবে তো?... নিশ্চয় বাঁচবে....