অমলেশ বলেছিল, যেখানে সকালে পাখির ডাক শোনা যায় না, সেখানে সে কোনোদিন থাকবে না। থাকেওনি অমলেশ। বৈঁচি থেকে আরো ভিতরে একটা গ্রামে অমলেশ সারাটা জীবন কাটিয়ে দিল।
অমলেশের কোমরের নীচ থেকে শরীর অচল
ছিল। পিতৃপুরুষের যেটুকু সঞ্চয়, আর নিজের কিছু টুকটাক কাজে চলেই যেত অমলেশের। একটা
হুইলচেয়ারে বসে শীতের রোদ মাখত, জানলার পাশে বসে বর্ষা দেখত, গ্রীষ্মের দুপুরে আমগাছের
তলায় শুয়ে থাকত, রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কত রাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত।
অমলেশ কারোর সঙ্গে কথা বলত না। গ্রামে
তাকে বলত সবাই মৌনিবাবা। অমলেশ বাঁশি বাজাত। সুর গ্রামের লোক চিনত। ক্রমে মৌনিবাবা
থেকে হল বাঁশিসাধু।
অমলেশ নাস্তিক না আস্তিক? জিজ্ঞাসা
করলে বলত, মাছ সমুদ্রের খবর পায় না। রাখেও না।
এ কথার মানে কেউ কেউ বুঝত। কেউ বুঝত
না। কেউ তাকে বলত আস্তিক, কেউ বলত নাস্তিক। অমলেশ চুপ করে থাকত।
অমলেশ একদিন মারা গেল। নিঃশব্দে। কোলের
উপর বাঁশিটা রেখে। একটা নীল লুঙ্গি আর সাদা জামা গায়ে তার হুইলচেয়ারে বসে, যেন ঘুমাচ্ছে।
তার চারদিকে তাকে ঘিরে কত পাখি! গ্রামে এত পাখি আছে! সবাই অবাক হল।
দিন গেল। গ্রামের লোকের কেমন একটা
অস্বস্তি হতে শুরু করল, গ্রামে যেন কি একটা নেই। কেউ কেউ বলল, আরে বাঁশির সুর নেই যে!
নামী এক বাঁশিওয়ায়াকে শহর থেকে আনা
হল। তার জন্য নহবতের মত একটা চালা বেঁধে দেওয়া হল। বলা হল, তুমি সকাল থেকে সন্ধ্যে,
রাত থেকে ভোর বাঁশি বাজাবে বসে এখানে।
শহুরে বাঁশিওয়ালা বাঁশি তো বাজায়।
কিন্তু কারোর মন ভরে না। তারা ফিরে ফিরে রাগ বদলাতে বলে, গান বদলাতে বলে। কিন্তু কিছুতেই
কিছু হয় না। তারপর সবাই একদিন তাকে তার পাওনা মিটিয়ে শহরের ট্রেনে তুলে দিয়ে এলো।
কিন্তু গ্রামে কারোর মনে কোনো সুখ
নেই। কারোর রাতদিন মাথাধরে থাকে। কারোর হজম হয় না। কারোর কিছুতেই মন বসে না। সন্ধ্যের
শাঁখের আওয়াজে সুর লাগে না। ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে উচ্ছ্বাস নেই।
সবাই বুঝল একদিন, আসলে গ্রামে কেউ
আর নিঃশব্দে বসে থাকে না। সবাই বড় কথা বলে। সবাই বড় হল্লা করে। অকারণ, অনাবশ্যক আওয়াজে
কেউ পাখির গান শোনে না। কেউ রোদ মাখে না। কেউ তারা দেখে না। কেউ বর্ষা দেখে না। সবাই
খালি খালি রাতদিন কাজ করে আর একজন নামী, বড়মানুষ হতে চায়। আর সবার মনে মনে লোভ হয় এ
শালপাখা গ্রামটা যদি বড় একটা শহর হয়ে যায়, কি মজাই না হবে!
সবাই বুঝল তো বটে। কিন্তু চুপ করে
বসে থাকার লোক আর পাওয়া যায় না। দু একবার চেষ্টা করা হল একে তাকে দিয়ে। তারা দু ঘন্টার
মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠে বলল, ওরে বাবারে, পাগল হয়ে যাব যে! এ রোদ, পাখি, আকাশ এতক্ষণ ধরে
দেখার কি আছে? দু একজন যদি বা সারাটা দিন কাটালো, তাদের মুখচোখ সারাদিনের নানা অসংলগ্ন
হাবিজাবি চিন্তার ভারে শুকিয়ে গেল। রাতে ঘুম হল না। শেষে তারা কবিরাজ ডেকে মাথায় ঠাণ্ডা
তেল মেখে দু রাত নাকে তেল দিয়ে ঘুমালো।
শেষে সবাই যা করে এসেছে এতদিন ধরে
তাই করল গ্রামের লোক। মন্দির তৈরি হল। অমলেশের মূর্তি বসল। সবাই বলল, কৃপা ছাড়া কিছু
কি হয় রে?
পাখির ডাক বলল, নিজেকে কৃপা না করলে
কি কিছু হয় রে?
কিন্তু পাখির ভাষা কে বোঝে? কেউ কিচ্ছু
বুঝল না। সবাই ভাবল পাখিরাও তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। তা জানাবে না? এমন একটা সৎ কাজ!
তাদের মন্দিরে ছাওনি পড়ল। আকাশ বলল,
নিজেকে ছাওনি মুক্ত না করলে কি রোদ এসে আলো দেয় রে?
তারা তাও বুঝল না।
শেষে যখন মূর্তির কপালে চন্দন লেপা
হচ্ছে, তখন আচমকা বৃষ্টি নেমে হুলুস্থুল বেধে গেল। বৃষ্টির জল বলল, নিজেকে ভাসিয়ে না
দিয়ে, এমন পাথুরে করে রাখলে কি সে দরজায় কেউ পৌঁছায় রে?
কেউ কিচ্ছু শুনল না, বুঝল না। শুধু
নিজেরা নিজেদের ঢক্কা-নিনাদে এমন মত্ত হয়ে গেল যে ভুলেই গেল একদিন এই গ্রামে কেউ নীরব
হয়েছিল।