Skip to main content
 
 
       এই কেকটা গিলতে দু ঢোক জল লাগেই। তারপর আরেক ঢোক জল সাদা সর পড়া গোলাপি বোতলটা থেকে গলায় ঢেলে চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিল। এক ভাঁড় দুধ চা। চিনি ছাড়া পাঁচ টাকা এখন। কেক ছটাকা।
       লাল রঙটা মরে গেছে শাড়ির। কয়েকটা জায়গা সুতো উঠে ছেঁড়া ছেঁড়াও। রোগা কালো শরীরটা বয়েসের অনেক আগে আগে ছুটছে। আজ বুটুয়ার বাবার জন্মদিন। বুটুয়ার বয়েস এখন তেরো। বুটুয়ার বয়েস তখন চার যখন ওর বাবা লাইনে কাটা পড়ল। রেলের সুইপার ছিল। চাকরিটা রাণীই পেত, কিন্তু রাণী তো তার বিয়ে করা বউ না। বিয়ে করা বউ তো ভাগলপুরে, মরেওছে বুটুয়ার বাবার অনেক আগে। রাণী পালিয়ে এসেছিল বুটুয়ার বাবা লছমনের সাথে। বিয়ে হল না, বুটুয়া হল। না বিয়ে হয়েছিল, শিব মন্দিরে, কিন্তু সেকি সরকারি বাবুরা মানবে? সত্যযুগ হলে শিবজী নিজে এসে সাক্ষী দিত, কিন্তু এই কলিযুগে...
 
       রাণী চায়ের ভাঁড়টা ডাস্টবিনে ফেলে হাঁটতে শুরু করল। আজ বুটুয়ার বাবার জন্মদিন। রাণী এখন কাঁচরাপাড়ায় রেলের কারখানায় দুপুরে খাওয়ার নিয়ে যায়। সন্ধ্যেতেও টিফিন নিয়ে যায়। এখন সে কারখানা থেকেই ফিরছে। আজ বুটুয়ার বাবার জন্মদিন। ফুল কিনত আগে। এখন কেনে না। যা দাম মালার! ওতে চা হয়ে যায়। চা'টা সে ছাড়তে পারে না। মাথা ধরে যায়। গা গুলায় সারাদিন। 
       কিন্তু আজ মনটা খারাপ। বুটুয়ার বাবার জন্য ফুল নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে রেলকলোনী পেরিয়ে অনেকটা এসে গেছে। রেলকলোনীর জমিতেই একটা বেড়ার ঘরে সে আর বুটুয়া থাকে। রাণীর মনটা ছটফট করছে, ফুল ছাড়াই ঢুকবে? কিন্তু শেষ তিন বছর তো তাই করেছে। রাণীর চোখ গেল রাস্তার একধারে। অনেকগুলো ভাঁটফুল ফুটেছে সার দিয়ে। কি মিষ্টি গন্ধ। রাণী শাড়িটা একটু উঁচু করে রাস্তার ধারের ঝোপে ঢুকে পড়ল। কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে ব্যাগের মধ্যে ভরে নিল। এই ফুল শিবপূজোয় লাগে। এসে শুনল বুটুয়া নেই, রমেশদের বাড়ি গেছে, চাবি পাশের বাড়ি রেখে গেছে। রমেশ ওর বন্ধু, ওর বাবা রেলে কাজ করে, রমেশেরো জন্মদিন আজকে। রাণী ঘর খুলে ঢুকে শাড়ি ছাড়তে ছাড়তে মনে করার চেষ্টা করল, গত বছর বুটুয়া গিয়েছিল কি? ফোনটা বার করে দেখল সুইচ অফ। চার্জে বসিয়ে চৌকিতে শুলো। ঘরের ভিতরটা অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল, একটা গুমোট গন্ধ, তার সাথে ভাঁটফুলের গন্ধ মিলে রাণীর মনটা উদাস হয়ে গেল। উঠে গিয়ে ফুলগুলো বুটুয়ার বাবার ছবির সামনে রাখল। আবার চৌকিতে শুলো। ঘুমিয়ে পড়ল।
 
       ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে। বুটুয়া কাল ফিরবে। রাণী আবার এসে শুলো। খানিক চোখ বন্ধ করে তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করল। বুটুয়ার বাবার রাতে মদ খেয়ে ফেরা, তাকে মার, ঘর থেকে অজস্রবার বার করে দেওয়া, আবার নেশা ছুটলে আদর, ভালোবাসার কথা, কান্না..
       রাণীর পিঠে এখনও মারের দাগ। জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মেরেছিল, অকারণেই, পুড়ে গিয়ে কল্যাণী হাস্পাতালে ভর্তি ছিল কদ্দিন। রাণী শুয়ে শুয়ে চৌকির কাঠে সেই পোড়া খাঁজটা চেপে অনুভব করার চেষ্টা করল। বুঝল না। অভ্যাস হয়ে গেছে। খিদে পাচ্ছে। চোখটা খুলে দেখল ফাটা টালির ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো তার বুকে এসে পড়েছে। খুব কান্না পেল। লছমনকে সে ভালোবাসে, প্রচণ্ড ভালোবাসে, বুটুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সে অনেকের বিছানায় গেলেও লছমন ছাড়া কেউ তার গভীরে আসে নি… কেউ না… কেউ না...
       রাণী ব্লাউজ, অন্তর্বাস খুলে মেঝেতে ফেলে দিল। চাঁদের আলো তার রুক্ষ অপুষ্ট বুকের উপর কি কোমল স্নেহে হাত দিয়ে দাঁড়াল। ঘরে যেন রাজপুত্র এল। রাণীর চোখের কোল থেকে জলের ধারা তখন বর্ষার নদী। রাণী পাশে রাখা ব্যাগ হাতড়ে কয়েকটা ভাঁটফুল পেল। নাভির উপর রাখল। তার মাথার উপরে যেন আরো কটা ফাটা টালি। জ্যোৎস্নার আলো তীরের মত ঢুকছে ঘরে। তারা সারা শরীরে বিঁধছে বটুয়ার বাবার আঙুলের মত, চুমুর মত। 
       কিছু একটা তার শরীর বেয়ে উঠে আসছে। ঘরে আলো নেই। রাণী হাত দিল নাভির একটু উপরে, একটা পোকা, ফুলগুলোর মধ্যেই ছিল। তার পেটের উপর কামড়েছে। ভীষণ জ্বালা করছে। রাণী উঠে সব কটা ফুল ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল। রাগে তার কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। মুড়ির টিন থেকে এক খাবলা মুড়ি মুখে পুরে চৌকির উপরে এসে বসল। টালিগুলো পাল্টাতে হবে তাড়াতাড়ি, বর্ষা আসার আগেই।