সৌরভ ভট্টাচার্য
21 February 2019
১৫৮ বছরের পুরোনো একটা বটগাছ। পাখিটা গাছটার বয়স জানে না। এমনকি গাছটাকে খুব একটা সম্মানের চোখেও দেখে না। গাছটার ফল হয়, ফুল হয়। পাখিটা দেখে, কিন্তু কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না। পাখিটা থাকে বটগাছটা থেকে প্রায় ১৬৫ কিমি দূরের একটা শহরে। সে খায় শহরের ফল, পান করে শহরের জল। মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, হয়তো নিছক কৌতুহলে, কিম্বা কোন অজানা এক টানে।
সব ভালই চলছিল। হঠাৎ কি যে হলো। পাখিটার মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা করতে লাগল, গলাটা চিন চিন করে ব্যথা করতে লাগল। রাতে ঘুমের মধ্যে নানা দুঃস্বপ্নে চমকে চমকে উঠতে লাগল। তার গান গাইতে ইচ্ছে করে না, খেতে ইচ্ছে করে না। লোকে বলে পাখিটা বুঝি মরবে। পাখিটা জানে, ও মরবে না। চারদিকে কোথাও যেন খাঁচার শিকল গাঁথা হচ্ছে। সেই শিকল গাঁথার একটানা একটা ধাতব শব্দ তার বুকের মধ্যে, মাথার মধ্যে 'চিঁ....' করে বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে। সে যা গাইতে চাইছে, তা গান হয়ে উঠছে না। হচ্ছে খানিক অর্থহীন স্বর আর সুরের আবর্তন। ভিতর থেকে কে বলে উঠছে --- এ মিথ্যা.. মিথ্যা.. মিথ্যা...। তার উচ্চারিত শব্দগুলো তার অনুভবের গলা টিপে ধরছে। বুকের মধ্যে অনুভবগুলো নষ্ট ভ্রুণের মতো স্তুপাকারে জমছে। পাখিটা মাঝরাতে চমকে উঠে তার নীড়ের চারদিকে মরা শাবক খুঁজছে। ঠোঁট দিয়ে নিজের বুকে আঘাত করে নিজের হৃদয়কে ছুঁতে চাইছে।
পাখিটা একদিন শহর ছাড়ল। তার ক্লান্ত ডানা আকাশ ছুঁলো বিষণ্ণ উড়ালে। সে উড়ল। উড়তে উড়তে দেখল তার ছায়া কালো মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্রমে লালমাটির উপর ভেসে ভেসে চলছে। ওই তো বটগাছটা। আজ মনে হল সে যেন গাছ নয়, তার যুগান্তরের আশ্রয়। সে এত ক্লান্ত ছিল গাছটার নীচু একটা ডালে পড়ল ঘুমিয়ে। তখন সন্ধ্যা। কত কত পাখি সে গাছে তাদের নীড়ে ফিরছে, তাদের কলতানে সন্ধ্যার আকাশ মুখর হয়ে উঠছে সে জানতেও পারল না। তবে রাতে সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখল না।
যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন পুবের আকাশ ঈষৎ লাল। তার পায়ে আটকে এ কি! গাছের একটা ছেঁড়া পাতা, কি যেন লেখা তাতে ---
"যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে..."
পাখিটা একবার পড়ল, দশবার পড়ল, বারবার পড়ল। তার পালকগুলো ফুলে উঠল উত্তেজনায়। তার জীবনে যে ঝড় উঠেছিল, সে ঝড়ের বেগ সইতে পারে এমন শক্ত নীড় সে কিছুতেই বানাতে পারছিল না। এ শব্দগুলো তাকে যেন সেই নীড় বানাবার আশ্বাস দিল। সে মাথা উঁচু করে গাছটার দিকে একবার তাকাল। সহস্র সহস্র পাতা। কোন পাতায় আছে এ কবিতার বাকি পংক্তিগুলো? তাকে নীড় যে বানাতেই হবে। সে পাতাটা ঠোঁটে নিয়ে, লাফাতে লাফাতে গাছটার উপরের ডালগুলোয় চড়তে লাগল। এমন সময়, ঠিক এমন সময়েই এল ঘুর্ণি হাওয়া। সমস্ত গাছটা মর্মর ধ্বনিতে বেজে উঠল। সে ধ্বনির ভেতর থেকে ভেসে এল কার যেন কন্ঠস্বর, মৃদু অথচ দৃঢ় এবং স্পষ্ট। সে কন্ঠস্বর বলে উঠল, "কি খুঁজছ?"
পাখি সে কন্ঠে মুগ্ধ হয়ে বললে, "এর বাকি পংক্তিগুলো।" বলে সে তার নখরে আটকে পাতাটা মেলে ধরল।
কন্ঠস্বর বলল, "তুমি এ ভাষা জান?"
পাখি বলল, "জানি তো। এ আমার মাতৃভাষা।"
কন্ঠস্বরে যেন মৃদু হাসির রোল উঠল। সে বলল, "আত্মভাষা কি?"
পাখি বলল, "মাতৃভাষা কি আত্মভাষা নয়?"
কন্ঠস্বর বলল, "জন্মলব্ধ অক্ষরমালা যদি হৃদয়ের ভাষাই অনুবাদ করতে না পারলো তবে সে নিষ্ফল মাতৃভাষা। মৃত সন্তান প্রসবে মা এবং সন্তান যেমন দু'জনে দু'জনকে না পেয়ে ব্যর্থ হয় সে মাতৃভাষাও তেমন, তোমার মৃত শাবকগুলোর মতো।"
পাখি চমকে উঠল। একবার ভাবল জিজ্ঞাসা করে, মৃত শাবকের কথা তুমি জানলে কি করে? জিজ্ঞাসা করল না। কারণ তার বোধে এখন এ বৃক্ষ যেন তার জন্মান্তরের আত্মীয়।
পাখি বলল, "আমার যে এক ভীষণ অসুখ, তবে কি আমি পাগল হব?"
বৃক্ষ বলল, "নিজেকে নিয়ে যে পাগল হয় সংসারে তাকে নিয়ে যাতনার শেষ নেই, তাকে লোহার শিকলের মধ্যে রেখে সমাজ হয় শান্ত। আর যে নিজেকে হারিয়ে পাগল হয়, তাকে ছুটি দিলে সমাজ পায় মুক্তি।"
পাখি বলল, "তবে আমার পথ্য কি?"
বৃক্ষ বলল, "ভয়ে, সংকোচে বা লোভে আত্মভাষাকে হারিও না। তোমার চারদিকে যে শিকল গড়ার কারখানা, যে শেখানো বুলির আগাছা, তাকে নষ্ট করো। গর্জে ওঠো। আর ভয় নয়। ভয়ে ভাব মরে, ভাষা জন্মায় না। বুলি জন্মায়। মিথ্যা স্তুতি জন্মায়। বাঁধা বুলি আর নয়, আর নয়, আর নয়। আত্মভাষা যদি মাতৃভাষা না হয়ে ওঠে, তবে সে মাতৃভাষা শুধুমাত্র ভৌগলিক বেড়াজাল আবদ্ধ বর্ণমালা বই আর কিছু নয়, তাতে কিছু গৌরব নেই, সে ব্যর্থ। মাতৃভাষার মধ্যে তাই আত্মভাষাকে জাগিয়ে তোলো। নিজের বুকের রক্ত দিয়ে প্রাণ সঞ্চার কর। হৃৎপিন্ড, তাতে আবদ্ধ রক্ত যদি ধমনীর মধ্যে দিয়ে সারা দেহে প্রবাহিত হয়ে দেহকে সতেজ সচল না রাখে তবে তা নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনে। তা হতে দিও না। নিজেকে মুক্ত কর, মুক্ত কর, মুক্ত কর..."
ধীরে ধীরে কন্ঠস্বর গেল মিলিয়ে। বাতাস হল শান্ত। পাখি তাকিয়ে দেখল তার চোখের সামনে পাতার পর পাতায় সাজানো তার ছিন্নপত্রের বাকি পংক্তিগুলো...
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়--
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা--
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।