ভরসা করতে লোভ লাগে, না সাহস লাগে?
শীতলপাটিগুলো একদিকে করে বসার জায়গা করে দিতে দিতে রতন বলল, কি রে, উত্তর দিলি না যে?
সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে করতে মুখটা কালি পড়ে গেছে। সীতা ভিক্ষার পাত্রটা মাটিতে রেখে, রতনের পাশে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে গলায় ঢালল। বলল, আজ বড় বাজে দিন গো…. তেমন কিছু হল না।
একটা বড়ো গাছের তলায় বসে রতন। শীতলপাটি বিক্রি করে। সীতা ভিক্ষা করে। এক গ্রামেই বাড়ি দু'জনের। অনেক সময়েই এক ট্রেনেই আসে। ফেরে সীতা আগে। রতন রাত করে।
সীতা বসল। বলল, খিদে লাগছে না জানো….
রতন তার চোখের দিকে তাকিয়ে। মায়া লাগে মেয়েটাকে দেখে। এত অল্প বয়সে বিধবা হল। দুটো বাচ্চা। কাজ দেখছে শহরের এদিকে। গ্রামে কি কাজ দেখবে? তদ্দিন বলছে, দুটো মুখে তো দিতে হবে বাচ্চাগুলোর… তাই ভিক্ষা। অনেকেই বলে, কাজ দেখে নিতে পারো না….. বেশ তো পেটাই চেহারা…. কিন্তু কাজ বললেই বা দিচ্ছে কে… তবে পেয়ে যাবে কিছু একটা… ভরসা….
রতন বলল, দেখ সীতা, ভরসা করতে সাহস লাগে। ভয় থেকে ভরসা হয় না। না তো সংশয় থেকে হয়। সাহস না থাকলে আমি তুই এই রাস্তায় নামতে পারতাম? ভরসা করতে সাহস লাগে। জীবনটাকে জাপটে না ধরলে জীবন মরণের দিকে দৌড়ায়। জীবনটাকে জাপটে ধরতে হয়।
সীতা বলল, তোমার দাদা, খেতে বসে অমন হুট্ করে চলে গেল। আমি ভাবতেই পারলাম না সে এক্কেবারে চলে গেল জানো… সকাল থেকে সেদিন কি ঝগড়াই দু'জনে করেছি… ওই যেমন হয় আর কি… কাজ থেকে ফিরল… সেদিন পুঁটিমাছ করেছিলাম, আর পুঁইশাক…. খেতে ভালোবাসে বলেই… কিন্তু….
সীতার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। বলল, আজই জানো… আজই তেরোই বৈশাখ…. তিন বছর হয়ে গেল…. ভরসা করতে সাহস লাগে…. লাগে…. সাহস না থাকলে আছি কি করে বলো… গ্রামে তো শেয়াল-কুকুরের অভাব নেই।
======
সীতা গাছের নীচে ঘুমিয়ে। কি মায়া মুখটায়। যেন স্বামী এসেছে স্বপ্নে। ঠোঁটের কোণে হাসি।
রতন রাস্তার দিকে তাকিয়ে। চড়া রোদ। রোদ মানে লালসা। সব পুড়িয়ে দেয়। বুদ্ধির গোড়ায় বিষ ঢেলে দেয়। তখন বুদ্ধির বিষাক্ত ডালপালা। যা পায় আঁকড়ে রাখতে চায়। কেউ কিচ্ছু আঁকড়ে রাখতে পারে না। শুধু জীবনটাকে জাপটে ধরে রাখতে পারে। সেটা ভেসে গেলে সব গেল।
======
বিড়ি দাও দেখি রতনদা।
রিকশাটা দাঁড় করিয়ে ভীম এসে বসল। বিশাল শরীর। বস্তিতে থাকে। জেল খেটেছে চুরির দায়ে। কিন্তু ভালো মানুষ। আইন বোঝে না। মানুষ বোঝে। কিছু ভালোমন্দের বিচার আইন পারে না।
ভীম বলল, দুপুরে বাড়ি গেলাম না। সাড়ে তিনটেতে একটা ভাড়া আছে। স্টেশানে নিয়ে যেতে হবে। সীতার কি শরীর খারাপ?
রতন বলল, কাল মদ খেয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলে না একটু?
তুমি কোথায় ছিলে?
আমিও স্টেশানেই… দেখো তোমার তো টোটোওয়ালাদের সঙ্গে ঝগড়া করলে পেটের ভাত জুটবে না। মেনে তো নিতেই হবে যে ওরাও থাকবে, তুমিও থাকবে। তোমার রাগটা একটু কমাও…
ভীম কিছু বলল না। টোটোগুলো দেখলেই মাথাটা গরম হয়ে যায়। আজকাল কম যদিও কিছুটা। একদিন কিনে ফেলবে। সেদিন বুঝবে ভীমও পারে। কিন্তু টাকা?
ভীম বলল, পরের মাসে একটা শীতলপাটি দিও তো, রাতে ঘুম আসে না।
রতন বলল, নিয়ে যাও, পরের মাসে টাকা দিওখন….
ভীম হাসল। বলল, সে নিতেই পারি। কিন্তু নেব না। কেন জানো? এই যে এসে একটু শান্তিতে জুড়াই তোমার কাছে, এটা বন্ধ হয়ে যাবে। বসলেই মনে হবে তোমার টাকা পাওনা আছে…. আমার যাওয়ার তো জায়গা বড় বেশি নেই…. জেলখাটা আসামী… তায় মেজাজ সপ্তমে… কে ঠাঁই দেবে বলো…. তুমিই ভরসা করে……
======
ভীম চলে গেল। সীতাও গেল। রতন চা নিয়ে বসল। আকাশ কালো করে এসেছে। ঝড় উঠবে এখনি। রতন চা নিয়ে বাসস্ট্যাণ্ডে বসে। বাসের জন্য না। ছাওনির জন্য। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে শুরু করল চারদিক। রতন চায়ের ভাঁড়টা ফেলে মোবাইলটা পকেট থেকে বার করল। রিং করে কানে ফোন লাগালো।
আজ মনে হচ্ছে ট্রেনের গোলমাল হবে জানো…. তুমি খেয়ে নিও। আমার মোবাইলে চার্জ বেশিক্ষণ থাকে না জানো…. আর কথা হবে না হবে…. রাত হলে শুয়ে পোড়োখন… বাবু ফিরেছে কারখানা থেকে?
বাবু ফিরেছে। সোদপুর থেকে তাহেরপুর অনেকটা রাস্তা। তার ছিঁড়বেই আজ। যা হাওয়া চালাচ্ছে। সীতা ফিরে গেছে নিশ্চয়ই এতক্ষণে। ভীম কি রাস্তায়?
রতন বিড়ি ধরালো। ভুরুটা কুঁচকিয়ে। চিন্তায়। সীতাকে ভয় করে। বড় আবেগ হড়কা মেয়ে। কি করে বসে কখন! আবার ফোন করল। সীতা ফিরেছে কিনা জানিও তো।
======
দারুণ ঝড় হল। রতন স্টেশানে এসে দেখে থিকথিক করছে ভিড়। যা ভেবেছিল তাই। তার ছিঁড়েছে। রতনের হাসি পেল। আকাশে মাঝে মাঝে এখনও বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যেন মজা দেখছে। দেখ মজা! ওকি, সীতা না?
সীতা বসে আছে। চোখটা বন্ধ। রতন গিয়ে ডাকল, এই সীতা… এই….
সীতা চোখ খুলে তাকিয়ে প্রথমে বুঝতে সময় নিল খানিক, কোথায় সে… তারপর বলল, আসলে মিনতিদি বলল, বেলঘরিয়ায় একটা হোটেলে কাজ দেবে, কথা বলতে আসবে…. কিন্তু যা ঝড় শুরু হল… আমারও আর বাড়ি যাওয়া….
রতন বলল, ক'টা বাজে জানিস? সাড়ে আটটা…. বাড়িতে জানিয়েছিস?.... অবশ্য জানাবিই বা কি করে… আমারও ফোনের চার্জ শেষ…. খেয়েছিস কিছু?
সীতা বলল, চা-বিস্কুট খেয়েছি দাদা।
রতন বলল, ভাত খাবি চ… আজ মনে হচ্ছে না পৌঁছাব…. চ….
সীতা সঙ্কোচ আর খিদের তাগিদে বিহ্বল হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
======
আমরা শেষ কবে এরকম একসঙ্গে খেয়েছি বল তো….
সীতার ভীষণ সঙ্কোচ হচ্ছে। এরকম হোটেলে সে আসে না। একটু পর উত্তর দিল, পঞ্চুর মায়ের শ্রাদ্ধে। মৎসমুখীর দিন।
রতন হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ… তোর বউদি দই খাওয়ার পর গরমের চোটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল মনে আছে? আর পাড়ার ছেলেরা বলল, মাসিমা দই এত কম করে দিচ্ছিল বলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল….
সীতা বলল, যাহ্, তুমি না কি… বৌদির ওরকম শরীর খারাপ হলে….
আরে তোর বৌদি আর আমি দু'জনেই এই নিয়ে কম হাসাহাসি করি নাকি!!
খাবার আসতেই চমকে উঠল সীতা….দাদা একি… আমি তো মাংস-মাছ ছেড়ে দিয়েছি গো….
রতন বলল, ছাড়িসনি সীতা…. ছাড়ানো হয়েছে…. শোন কুয়োর মধ্যে শ্যাওলার গন্ধে থাকতে থাকতে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে ওভাবে থাকা…. তুই যখন কুয়ো থেকে বেরিয়েইছিস… তবে মনের মধ্যে কুয়োটাকে নিয়ে বেড়াস না সীতা….
সীতার তর্ক করার না বিবেকের সায় আছে, না খিদেতে তার অনুমতি আছে। কিছু না বলেই খেতে শুরু করল। পেট অর্ধেক ভর্তি হতে না হতেই চোখ উপচে জল এলো। নিজের উপর দরদ জন্মালো। বলল, এক রাতেই ভিখারি হয়ে গিয়েছিলাম দাদা। ও থাকতে তো কোনো অভাব ছিল না বলো… তুমিই তো দেখেছ….
======
কথাটা মিথ্যা নয়। সীতার বাড়ি অনেকবার সপরিবারে খেয়ে এসেছে রতন। মানুষের কখন যে কি অবস্থা হয়। ভাগ্যের থেকে শক্তিশালী কে আছে?
সীতা, অনেক বড়লোকেরাই আমাদের মানুষ হিসাবে দেখে না…. ওদের জোর টাকার জোর.. ওর বেশি কি আছে বল… আমাদের… গরীব মানুষদের আছে ভরসার জোর... টাকা কমলে টাকার জোর কমে সীতা... ভরসার জোর কমে না..… তোকে ওবেলা বলছিলাম না…. সাহস না থাকলে মানুষ ভরসা করতে পারে না…. খড়কুটোর মত ভেসে যায়…. অসহায় হয়ে বেঁচে থাকা, আর ভরসা রেখে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে সীতা….
সীতা আর রতন স্টেশানে বসে আছে। সাড়ে দশটা বাজে। ট্রেন ঠিক হবে। আরো সময় লাগবে।
সীতা বলল, আমাকে একবার দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যাবে দাদা? একা যেতে সাহস হয় না। তুমি নিয়ে গেলে মানত করতাম মায়ের কাছে… এই কাজটা হয়ে গেলে মাকে একশো টাকার সন্দেশ পুজো দেব।
রতন বলল, মানত কেন করবি, মাকে বলে আসবি, হয়ে যাবে হওয়ার থাকলে, না হলে জানবি মা তোর জন্যে অন্য কিছু ভেবেছেন….
সীতা বলল, ভয় করে দাদা। পোড়া কপাল। কোনোদিন ভালো কিছু হয়নি। মা চাইলেই কি আর ভালো কিছু হবে?
রতন বলল, ওসব কথার কথা সীতা…. চল কাল সকালে এক্কেবারে মন্দির হয়ে কাজ করে বাড়ি যাই… আজ রাতটা স্টেশানেই কাটিয়ে দিই… কি বল?
সীতা 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না। খানিকবাদে বলল, একবার এক লোক আমায় একশো টাকা ভিক্ষা দিয়েছিল জানো। আমি ভয়ে টাকাটা ব্যারাকপুরে নেমে হনুমান মন্দিরে দিয়ে চলে আসি। কেন জানো? যদি এত টাকা দেখে কেউ সন্দেহ করে আমি এখানে অন্যকাজের জন্য আসি…. খারাপ কাজ….
======
তিনটের সময় দু'জন তাহেরপুর স্টেশানে নামল। আরো কয়েকজন নামলো। নেমে দু'জনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল স্টেশানে। একটু পর রতন বলল, চ তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি….
সীতার গলায় কুণ্ঠা।
রতন বলল, বেশ, তুই এগো….. আমিও যাই।
সীতা বলল, ইচ্ছা থাকলেই ভরসার জায়গা দেখানো যায় না দাদা…. জানানো যায় না… মানুষ তাই দেখে শোনে… যা সে দেখতে শুনতে চায়…
রতন বলল, জানি রে। তবু বলি, ভরসা রাখিস সাহস করে। কিছুতে অন্তত, কাউতে অন্তত, নইলে হারিয়ে যাবি।
রতন হাঁটছে বাড়ির দিকে। ক্লান্তিতে শরীর জড়িয়ে। পা চলছে না। রতন হাঁটছে। মাঝে মাঝে পুবাকাশের দিকে তাকাচ্ছে। ফর্সা হচ্ছে অল্প অল্প করে। রতন হাসল, বলল, কে বলবে বলো, এতবড় তাণ্ডব হয়ে গেছে কাল আকাশ জুড়ে। কোত্থাও ছিঁটেফোঁটা ছাপ নেই। অধৈর্য হোস না মন... হোস না.... ধৈর্য হারাস না সীতা... ভীম.....