Skip to main content

 

নিজের দেশকে চেনা দুটো পথে হতে পারে, এক তথ্যে, দুই আত্মায়। বেশ কয়েকদিন যাবৎ কয়েকজন মানুষ মাথার মধ্যে যেন মেলা বসিয়েছিলেন। ম্যাক্স মুলার, কার্ল ইয়ুং আর উইলিয়াম ডালরিম্পল। ম্যাক্স মুলার ভারতে আসেননি। কার্ল ইয়ুং ভারতে এসেছেন। আর উলিয়াম ডালরিম্পলকে তো ভারতের স্থায়ী বাসিন্দাই বলা চলে এখন। তিনজন মানুষের সময় আলাদা। কাজের ধারা আলাদা। ভাবার আঙ্গিক আলাদা। কিন্তু কেন্দ্র এক – ভারতবর্ষ। ম্যাক্স মুলারের সময় ১৮২৩ – ১৯০০। কার্ল ইয়ুং-এর সময় ১৮৭৫ – ১৯৬১। ডালরিম্পলের জন্ম ১৯৬৫ সালে।

      ম্যাক্স মুলার ভারতকে জানছেন পাণ্ডিত্যে, তাঁর তীক্ষ্ম উদার ধীশক্তিতে। কার্ল ইয়ুং ভারতকে জানছেন মনের আলো-অন্ধকারের গতিপথের গবেষণায়। ডালরিম্পল জানছেন আবেগে, ভালোবাসায়, ঐতিহাসিক সত্যে, মানুষের কাজের পরিচয়ের বাইরে গিয়ে মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি ছোঁয়ার গভীর আকুলতায়।

      ম্যাক্স মুলারের ‘ইণ্ডিয়া – হোয়াট ক্যান ইট টিচ আস’ (India - What can it teach us) – ভারতের প্রাচীন সাহিত্যকে নিয়ে আলোচনা। ভারতের প্রশাসকের ভূমিকায় যারা কাজে যোগ দেবে তাদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা ভাষণ। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছে – প্লেটো, কান্ট পড়ার পরেও নিশ্চয় ভারতের দর্শনের কাছে আসা দরকার, নইলে অনেক মানবিক গভীর সত্য অধরা থেকে যায়। শুধু ল্যাটিন বা ইংরাজি জানলেই হবে না, ভারতকে জানতে গেলে সংস্কৃত ভাষার সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অনুবাদে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। এই কথা বলতে গিয়ে ম্যাক্স মুলার সংস্কৃত শব্দের অর্থ ও তার অনুবাদের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করছেন। চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছেন প্রাচীন সাহিত্যে না ডুবলে যা আহরিত হয় সে ভীষণ ভাসা-ভাসা, অগভীর। তাতে নকলই কেবল জমে, আসলের প্রাণস্পন্দন নিজের প্রাণে সাড়া দেয় না।

      এই কথাক'টা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের 'প্রাচীনসাহিত্য' বইটির কথা। কত গভীর, কত বিচিত্র সে পাঠ! আমার সময় থেকে উপনিষদ তথা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের দূরত্ব, সেদিন রবীন্দ্রনাথের থেকেও খুব কাছের ছিল কি? ছিল না। অথচ আমাদের দিন যত এগোলো সেই সাহিত্যকে আমরা যতটা গবেষণার বিষয় করে তুললাম, ততটা প্রাণের বিষয় করে নিলাম কই? আরো অনেক পরে রচিত চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল ইত্যাদিকেও এক ধর্মের প্রাঙ্গণে চন্দনলিপ্ত করে সঙ্কীর্ণ মতবাদের চক্র রচনা করলাম, তাকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমার মত করে ছুঁতে চেষ্টা করলাম কই? ‘আধুনিক’ শব্দটার অর্থ যদি ক্যালেণ্ডারের গতির সঙ্গে সমানুপাতিক হয় তবে কিছু বলার থাকে না, কিন্তু ‘আধুনিক’ শব্দের অর্থ যদি মনের দ্বার উন্মোচন আলোর দিকে, নির্ভয়ের দিকে, উদারতার দিকে হয় – তবে সেখানে কালের গতির হিসাবের দরকার কি?

 

      কার্ল ইয়ুং – মনোবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ। প্রাচ্যের প্রাচীন সাহিত্যের নানা সাংকেতিক মুদ্রা, চিহ্ন ইত্যাদির গভীরে প্রবেশ করতে চাইছেন। দেখতে চাইছেন চেতনার বিপরীত গোলার্ধে যে মন, যে মনের দিকে অন্ধকার, সেই মনের ভাষা কিভাবে উচ্চারিত হয়েছে, নানা মুদ্রায় কিভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে। তিনি তার ‘সাইকোলজি অ্যান্ড দ্য ইস্ট’ (Psychology and the East) – বইতে ভারতকে যে কয়েকটা অধ্যায়ে ছুঁয়েছেন, তার মধ্যে যে অধ্যায়টা আমার ভীষণ ভালো লাগল, সে হল ‘দ্য হোলি মেন অব ইণ্ডিয়া’। এই অধ্যায়ে বিশেষ করে রমণ মহর্ষি'র কথা আলোচিত হয়েছে। রমণ মহর্ষি'র সময় ১৮৭৯ – ১৯৫০। দক্ষিণ ভারতের অরুণাচলম্ বলে একটা ছোটো পাহাড়েই জীবনের প্রায় সমস্ত সময়টা তার কাটে। প্রায় নীরব এই মানুষটার সান্নিধ্যে পৃথিবীর নানা গুণী, জ্ঞানী মানুষ এসেছেন।

      কার্ল ইয়ুং লিখছেন, রামকৃষ্ণ ও রমণ মহর্ষি বর্তমান সময়ে ভারতের আত্মার দুই ছবি। ভারতের সাধনা কিসের সাধনা ছিল, সে বুঝতে এই দুই মানুষের সান্নিধ্যে আসা দরকার। ইয়ুং-এর ভাষায় মানুষের দুটো সত্তা – তার বাইরের, যাকে বাউলেরা বলে 'প্রাণী', দুই তার অন্তরের মানুষ – যে 'মনের মানুষ'। যে গভীরের মানুষ। আজকের দুনিয়ায় বাইরের এই প্রাণীটিকে তুষ্ট করার জন্য কত আয়োজন। সে আয়োজন যত বেড়ে চলেছে মানুষের লোভ তত বেড়ে চলেছে। বাইরের এই প্রাণীটির ক্ষুধা তাকে পাগলের মত দৌড় করাচ্ছে। যত পাচ্ছে তত তার চাহিদা বেড়ে চলেছে। কিন্তু অন্তরের সেই অভুক্ত, অবহেলিত মানুষটা? সেকি সন্তুষ্ট হচ্ছে? না তো! এই ঝাঁ-চকচকে সভ্যতায় মানুষ কি সত্যিকারের আনন্দের নাগাল পেয়েছে? নিশ্চয় তার বাহ্যিক সুখের পরিমাণ, বৈচিত্র বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু অন্তরে? সে যে দিনে দিনে রিক্ত হচ্ছে, নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র বাইরের প্রাণীটির উন্মাদনার দৌড়ে মানুষ অবশেষে কোথায় পৌঁছায়? তার বিকার জমে, তার ক্ষোভ জমে। ..the externalization of life turns to incurable suffering, because no one can understand why he should suffer from himself. No one wonders at his insatiability, but regards it as his lawful right, never thinking that one-sidedness of his psychic diet leads in the end to the gravest disturbance of equilibrium. That is the sickness of Western man, and he will not rest until he has infected the whole world with his own greedy restlessness. ....the life and teachings of Shri Ramana are of significance not only for India, but for West too...

      মনে রাখি যেন, এ এক পথিকৃৎ মনোবিদের ভাষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত।

 

      ডালরিম্পলের যে বই আমায় ‘ডুবাইলি রে, ভাসাইলি রে’ করে গেল সে হল – নাইন লাইভস্ (Nine Lives: In search of the Sacred in Modern India)। বর্তমান সময়ের ন’জন মানুষের কথা। ন’জন সাধকের কথা। যা শুরু হয় একজন জৈন সন্ন্যাসিনীকে দিয়ে, শেষ হয় বাঙলার বাউলকে দিয়ে। যেন ইংরাজিতে কালকূট পড়ছি। সেই এক খোঁজ, এক ভালোবাসা, এক আন্তরিক কোমল ভাষার স্পর্শ। মানুষের অন্তরাত্মা জেগে ওঠে ভাষায়। প্রাণের ভাষায়। ডালরিম্পল সেই ভাষা জানেন। তারাপীঠের শ্মশানের মণীষা মা হোন, আমাদের কানাই দাস বাউল হোন, থৈয়ামের ব্রাত্য নৃত্যশিল্পী হোন, রাজস্থানের লোকগীতির গায়ক হোন অথবা পাকিস্তানের কলন্দরের দরগায় জাগা সেই সুফী সাধিকা হোন। প্রত্যেকেই এক প্রাচীন সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ধারক, বাহক। ঐতিহ্য বহন করতে শুধু স্মৃতি লাগে না, মরণপ্রেমী ভালোবাসা লাগে। এই নয়জন সেই জীবন আর মরণকে ‘দুই হাতের কালের মন্দিরা’-র মত নিয়ে বেঁচেছেন। এমনকি কর্ণাটকের সেই দেবদাসীও। ডালরিম্পল আমার দেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ বোঝেন, বাঁশির সুর বোঝেন, একতারায় চোখের কোলে জমা জল মোছেন। আবার মাঝে মাঝে পাশ্চাত্যের ধামাধরাদের ধমকেও দেন। বলেন, চোখ মেলে নির্মোহ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখ – ‘তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি’ বলে আর কদ্দিন কাটবে? যে মানুষ নিজের উপর নিজের করুণায় আকুল, সে কোনোদিনই কূল পায় না। অকালে নিষ্ফল ডুবে যায় সে, হারিয়ে যায়। চারদিক থেকে মানুষের ‘আহারে, আহারে’ কুড়িয়ে পাথেয় আর কদ্দিন মেলে? ডালরিম্পল সেই মানুষগুলোকে খোঁজে, যারা এই চিত্তের আলোতে নিজে বাঁচে, অন্যকে বাঁচায়। তারা এত গভীরে শ্বাস নেয়, সে শ্বাসের অমৃতে চারদিক মধুময় হয়ে ওঠে। কিন্তু শুধুই কি তাই? তা নয়। কালকূটের গভীর সহমর্মী দৃষ্টি যেমন ঈশ্বরের বুক চিরেও এক কাঙাল মানুষের সন্ধান পায়, ডালরিম্পলও পায়। মানুষের অসহায়তা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা সব জেগে ওঠে। তবে তারাই শেষ কথা বলে না। শেষ কথা বলে মানুষের গভীরে জাগা মনের মানুষ, যে হার স্বীকার করতে জানে না।

      ডালরিম্পলের আরেক ভারতের বই – দ্য এজ অব কলি (The Age of Kali - Indian Travels and Encounters), অন্ধকার ভারতের গল্প। সেখানে দুর্নীতি, অত্যাচার, শোষণের ভারতের গল্প। সেও আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটে। যার গল্প শুরু লালুপ্রসাদের শাসনকালের বিহারের অধ্যায় দিয়ে। এর আগে লেখা ডালরিম্পলের বই – দ্য সিটি অব জিনস (City Of Djinns: A Year in Delhi)। কি মায়াময় লেখা! দিল্লী তথা ভারতের হৃদয়ের দরজার অন্বেষণ যেন। দিল্লী'র দাঙ্গার, দেশভাগের দগদগে স্মৃতি জাগা মানুষের মুখোমুখি ডালরিম্পল। প্রশ্নগুলো শুধু তথ্য জমিয়ে সময়ের দলিল লেখার জন্য করা না, মানুষের ভিতরে চলা মানুষটার পায়ের ছাপ খোঁজার চেষ্টা। কতটা বদ্ধ রক্ত জমে আছে সে বুকে, কতগুলো মৃত মানুষের হাহাকার সেই মানুষগুলোর নিত্য স্বাভাবিক জীবনে। আমরা তো মানুষের বাইরেটা দেখি। তার ব্যবহার, তার কাজ, তার সঞ্চয়, তার সম্পত্তি, তার হাসি-কান্না-উদাসীনতা। কিন্তু এগুলোর গভীরে আরেক যে মানুষ, একা একা জানলার ধারে দাঁড়ায়, অপেক্ষা করা অনর্থক জেনেও অপেক্ষা করে, চেতনার ছায়ার আড়ালে একা একা নিজের ফেলে আসা দিনের গল্পদের সাজায়, গোছায়, আবার সব এলোমেলো করে পাগল হয়ে কালের পাঁচিলে মাথা কুটে মরে... যার কান্নার আওয়াজ গভীর রাত্রে মাথার বালিশ ছাড়া কেউ জানে না – ডালরিম্পল তাকে ছুঁয়ে আসে। চঞ্চল আবেগে না, চিত্তে জাগা মানুষকে জানা ধ্যানের আলোয়...

 

      এ বইগুলো এই জন্যে বলা, যে মাটিতে আমার শরীর আজ না হয় কাল ছাই হবেই, সেই মাটির গন্ধ যেন নির্ভেজাল চিনতে শিখি সেই তাগিদে। এ মাটিকে এতদিন জেনে এসেছি আমারই মাটির মানুষদের লেখায়, এ কয়েকদিন জানলাম একজন জার্মান, একজন সুইডিশ, আর একজন স্কটল্যাণ্ডিয়ানের ভাষায়।

      আজ ভারতে যে নব্য হিঁদুয়ানি জেগেছে, তার মূল অত্যন্ত অগভীর। শুধু অগভীর হলে কথা ছিল না, বড় সঙ্কীর্ণ। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, গেড়ি-গুগলি ডোবায় জন্মায়। সেই গেড়ি-গুগলিতে চলতে ফিরতে পা কাটছে। বিবেকানন্দ বলতেন, শুধু অন্ধকার অন্ধকার চীৎকার করলে কিচ্ছু হয় না, আলো নিয়ে এলে অন্ধকার আপনি পালায়।

      কিন্তু আলোকে জাগানোর জন্য যে সাধনা চাই। অন্ধকার আপনিই আসে। আলোকে জ্বালতেই উপকরণ লাগে। সাধন লাগে। আলোতে মুক্তি। অন্ধকারে যে শুধুই ঘোর। নিজের ঘরের দরজা-জানলা না খুলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আর কদ্দিন?

 

 

 

 

 

 

 

 

 
 
 

Category