Skip to main content

রাজা পাখিটিকে আনাইলেন। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটিকে টিপিলেন, সে বলিল, জয় রাজামহারাজের জয়। তাহার পেটের মধ্যে পুঁথির কাগজগুলি পরমোল্লাসে নাচিয়া নাচিয়া বলিল, আমি সব জানি, সব জানি মহারাজ। আপনার কৃপা রাজা। আপনিই সব।

    রাজা কহিলেন, আর গান গাহিবে?

    পাখি কহিল, সে গানই গাহিব রাজা যাহাতে আপনার যশগান।

    রাজা উল্লসিত হইয়া কহিলেন, সাধু সাধু। পাত্রমিত্র সভাসদ আদি সকলেই কহিল সাধু সাধু। 

    পাখি কহিল, একটি আর্জি আছে মহারাজ, নালিশও বলা চলে। 

    রাজার ভ্রুকুঞ্চিত হইল। পাত্রমিত্র সভাসদ সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হইল। রাজা গম্ভীর কন্ঠ বলিলেন, কি নালিশ?

    পাখি বলিল, আমার খাঁচার সম্মুখে যখনই পণ্ডিত মশায়েরা কি পেয়াদার দল থাকিত না, এক বনের পাখি আসিয়া কেবল আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট করিবার প্রয়াস পাইত। 

    রাজা কহিলেন, তাহার বিবরণ কি?

    পাখি কহিল, সে কেবল ওড়ে, অকারণে সারা আকাশ উড়িয়ে বেড়ায়, মেঘে বসিবার ঠাঁই নাই জানিয়াও পক্ষক্লান্ত করিয়া ফেরে। সারা আকাশ কোনোদিন উড়িয়া পার করিতে পারিবে না সে জানে, কেবল জানে না যে পুঁথির মধ্যে ওই আকাশের সব খুঁটিনাটি তথ্য রহিয়াছে। পড়িলেই হয়। 
    
    রাজা কহিলেন, তুমি সে কথা তাহাকে বলিলে না কেন?

    পাত্রমিত্রসভাসদ সবাই সমস্বরে বলিল, বলিলে না কেন? বলিলে না কেন? বলিলে না কেন?

    পাখি সভাসদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া বলিল, বলিয়াছিলাম। সে পাখি বলিল, তোমার পুঁথির মধ্যে আকাশের সব খুঁটিনাটি রহিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু আকাশটিই যে নাই…

    রাজা হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, ভাবুক দেখি... হো হো হো…

    সভায় সবাই যেন রাজাকে ভ্যাঙচাইয়া হাসিয়া উঠিল, হো হো হো…

    পাখি কহিল, ইহা হাসির বিষয় নহে মহারাজ, সে পাখি ভাবুক হইলে শুধু ক্ষতি ছিল না, সে ভাবিতে জানে... আপনি স্বয়ং সিংহাসনে বিরাজমান থাকিতে স্বাধীনভাবে ভাবিতে চাওয়া, ইহা স্পর্ধা নহে?

    রাজার মুখাবয়ব গম্ভীর হইয়া উঠিল। সভায় সবাই এ ওর দিকে চাহিল কটাক্ষে। রাজা পেয়াদাদের কহিল, আনো উহাকে বন্দী করিয়া। 

    পেয়াদার দল সভায় রাজ সম্মুখে দণ্ডবৎ হইয়া, রাজার পাদোদক পান করিয়া বাহির হইয়া পড়িল। হঠাৎ বড় পেয়াদা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কিন্তু মহারাজ তাহার অপরাধ কি বলিব?

    রাজা মহামন্ত্রীর দিকে ইশারা করিলেন। মহামন্ত্রী পেয়াদাকে নিরালায় এক পার্শ্বে লইয়া যাইয়া বলিলেন, মূর্খ কোথাকার, রাজার চোখে যে অপরাধী সে ঈশ্বরের চোখেও অপরাধী। স্পষ্ট অপরাধ না পাও যদি অপরাধ বানাইয়া লইতে কতক্ষণ? পথ হইতে আফিম লইয়া যাও, পাখির সুমিষ্ট ফলের সহিত উহা প্রতিস্থাপিত করিয়া উহাকে বন্দী করিয়া লইয়া আসো। তাহার দণ্ড হইতে কতক্ষণ আর তবে?

    ইতিমধ্যে সভার পাখির জন্য আসন বরাদ্দ হইয়া গেল। সভাকবি আসিয়া তাহাকে এক তাড়া কাগজ ধরাইয়া গেল। ইহাতে রাজার যশস্তব রাশি রাশি লেখা। পাখি গান ধরিল। 

    বাহিরে বসন্তের বাতাস ফুরাইয়াছে বহুকাল হইল। গ্রীষ্মের উষ্ণ গুমোট বাতাস কালবৈশাখির জন্য আকাশের দিকে হাপিত্যেশ নয়নে চাহিয়া রহিল।