Skip to main content

---

বটুকবাবুর সাধ হল মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল খাবেন। যেই না সাধ হওয়া অমনি তিনি সব্জী বাজারে হাজির। লাউ, কুমড়ো, উচ্ছে, পটল কিনে, বাড়িতে পৌঁছিয়েই গিন্নীকে হাঁক ছেড়ে বললেন, খুব ভাল করে ঘ্যাঁট রাঁধো দিকিনি।

অবাক হচ্ছেন তো? হবেন না। বটুকবাবুর এটাই বিগত পঁচিশ বছরের অভ্যেস। যেদিনই উনি ওনার পাড়ার পঞ্চমবার মাধ্যমিক ঘায়েল রাখীকে বিয়ে করতে পারেননি, বাবার কথায় লাডলীকে বিয়ে করতে হয়েছে, সেদিন থেকেই উনি এরকম অসম্ভব রকমের কাণ্ড করেন। মন যা চাইবে, তার উল্টো।
এই তো সেদিন ওনার ভীষণ দাঁতে ব্যাথা। উনি রেগেমেগে কোলোনোস্কপি করিয়ে ফিরলেন। পরে অবিশ্যি ওনার শালা লাডলা ওনাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে দাঁতে সিল করিয়ে এসেছে, সে আলাদা কথা। একে শালা, তায় বিরাট সমাজসেবী। কত মানুষের দুঃখ সে সহ্য করতে না পেরে পরলোকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে প্রায় নামমাত্র খরচায়। বড় উদার প্রাণের মানুষ।
বেশ চলছিল জীবন। যেদিন পাঞ্জাবী পরার ইচ্ছা, সেদিন টি শার্ট। যেবার পুরীতে যাওয়ার ইচ্ছা সেবার নৈনিতাল। যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার ইচ্ছা তখন দালের মেহেন্দি। এমনকি মাঝে মাঝে ঘুমাবেন না জেদ ধরে ছাদে পায়চারী শুরু করেন মাঝরাত অবধি। তারপর লাডলী লাডলার ভয় দেখিয়ে নামিয়ে আনেন। পাশে শোয়ান। জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁ গো, কি গান শুনবার ইচ্ছা বলো। বটুকবাবু হয়তো বললেন, তুমি যে আমার...। অমনি লাডলী দেবী ধরলেন, আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল...। বটুকবাবু ঘুমিয়ে পড়েন।
এবার আসল ঘটনাটায় আসি। সেবার পূজোয় বটুকবাবুর সাধ হল হরিদ্বার যাবেন। যথারীতি চেন্নাইয়ের টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলেন সপরিবার। লাডলাও যেত, কিন্তু এবার পূজোয় অনেকগুলো কেস এসে পড়ায় যেতে পারল না, চারটেকে মায়ের সাথেই কৈলাসে পাঠাতে হবে, বাবার কাছে। শালারা ফ্ল্যাটের জন্য জমি ছাড়ছে না। স্টেশানে এসে লাডলার সেকি কান্না দিদিকে জড়িয়ে। খুব নরম মন, লোকেও বলে। নিন্দুকেরা তো এও বলে প্রতিটা কেস সাল্টাবার পর সে নাকি আগে তিনদিন করে হবিষ্যান্ন খেত। তা ইদানীং রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু মায়ের কাছে কালীঘাটে গিয়ে তাদের আত্মার সেফ ল্যাণ্ডিং-এর জন্য প্রার্থনা জানিয়ে আসে। দামী প্রার্থনা অবিশ্যি। প্রায় মাথা পিছু, থুড়ি আত্মা পিছু পাঁচ হাজার।
উফ, ফের ভুলভাল গল্প জুড়ে বসলাম। লাডলার সে কি কান্না। বটুকবাবুর মনে হল দিই শালাকে কানের বারান্দায় একটা। যেমনি মনে হওয়া তেমনিই কাজ। তাড়াতাড়ি তার গালে একটা সশব্দে চুমু খেলেন। লাডলী কটমট করে তাকাল।
করমন্ডল ছাড়ল। পূজোর প্যাণ্ডেল দেখতে দেখতে কর্তা গিন্নী আর কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়া লুলু, তাদের একমাত্র কন্যা চেন্নাই চলল।


---

কি ছিল বিধাতার মনে। চেন্নাই সমুদ্রতীরে হঠাৎ রাখীর সাথে দেখা। কে রাখী? আরে সেই পঞ্চমবার মাধ্যমিকাক্রান্ত বটুকবাবুর ভাঙা স্বপ্ন। আচমকাই মুখোমুখি। দু'জনেই দু'জনকে দেখামাত্র চিনে ফেলেছেন। বটুকবাবু, কান্না পাচ্ছে না নাচতে ইচ্ছা পাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়ে। রাখী বেশ মোটা হয়ে গেছে। সে এখানেই থাকে। দুটো ছেলে মেয়ে। তার বর এখানেই পোস্টিং। কি একটা সরকারী চাকরি করে। বটুকবাবু খেয়াল করেননি কখন লাডলী আর লুলু এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত লুলুর পাশে কেউ দাঁড়ালে দেখা যায় না, তাই লাডলীকে দেখতে রাখীর একটু বেগ পেতে হল। তারপর কুশল বিনিময়। বটুকবাবু পরিচয় দিলেন সহপাঠিনী। ব্যস অতটুকুই।

সুযোগ এল। বটুকবাবু বউ মেয়েকে পণ্ডিচেরী পাঠিয়ে নিজে শরীর খারাপের আছিলায় থেকে গেলেন। রাখী এলো বেলা এগারোটায়। প্রথমে খুব একচোট কান্না। তারপর বিভিন্ন স্মৃতিরোমন্থন ইত্যাদি চলার পর দু'জনেই কথা হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। এদিকে বটুকবাবু পঁচিশ বছর ধরে কত কথা মনে মনে জমিয়ে রেখেছেন, রাখীর সাথে দেখা হলে বলবেন বলে। কিছুতেই কথাগুলো সাজিয়ে আসছে না মুখে। ভাবতে গেলেই বোকাবোকা লাগছে, তো বললে!
বিকাল হব হব। দুপুরের খাবার হোটেল থেকেই আনিয়ে নিয়েছিলেন। যেরকম খাবার সেরকমই পড়ে আছে। মুখে উঠছে না। তিনি রাখীর হাতদুটো বুকের কাছে নিয়ে জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে। সব কথাগুলো যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে আপনা আপনিই। সব যেন বলা হয়ে যাচ্ছে।
বটুকবাবুর বললেন, রাখী। তার গলার স্বর যেন সমুদ্রের গর্জনের মত গভীর। বুকের কোন তলা থেকে ঠেলে উঠছে।
রাখী বললে, হুঁ বলো।
- আমি ভাবছি ডিভোর্স দেব। তারপর এখানে কোনো একটা চাকরী জুটিয়ে নেব। তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে চাই রাখী। ডুকরে কান্না এলো বটুকবাবুর। সামলে নিলেন। রাখীর চোখে জল।
- তা হয় না। মেয়ে আছে। অনেক দায়িত্ব তোমার। তা ছাড়া সেটা উচিতও না।
- কেন না?
- সে আমি জানি না। তবে আমি সারা জীবন অপরাধী থেকে যাব।
- হুম।
বটুকবাবু আবার চুপ।
রাখী যখন গেল তখন বিকাল সাড়ে পাঁচটা। ওর বরের অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছিল। বটুকবাবুও আর আটকাননি। তিনি ইচ্ছা করলেন সমুদ্রের ধারে যাবেন। কি আশ্চর্য, গেলেনও। ইচ্ছা করলেন সিগারেট খাবেন। খেলেন, কোল্ডড্রিঙ্কস না খেয়ে।
লাডলী, লুলু ফিরল অনেক রাতে।
শুতে গিয়ে আলো নেভাবার পর আচমকাই লাডলী বলে উঠলেন -
- রাখি এসেছিল?
বটুকবাবু মিথ্যা বলার জন্য কিছু ভাববার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হুম।
- তুমি কি গো। মেয়েটাকে না খাইয়ে শুধু প্রেমের গল্প বলেই বাড়ি পাঠিয়ে দিলে? তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে গো? শুকনো মুখে মেয়েটা বাড়ি গেল।
- না কোল্ডড্রিঙ্কস খেয়েছে।
- কৃতার্থ করেছ! যা হোক কাল ওকে একবার ডেকে এনো। একসাথে খেতে যাব।
বটুকবাবুর এবার কান্না পাচ্ছে। তিনি লাডলীকে জড়াতে গেলে লাডলী বলল, ছাড়ো। আমার ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
বটুকবাবু বললেন, এই চলো না সি-বীচে যাই।
- পুলিশে ধরবে। ঘুমাও।
বটুকবাবু সেদিন স্বপ্ন দেখলেন। তিনি একটা মাছের বাজারে এসেছেন। তাঁর ভীষণ মুড়ো দিয়ে ডাল খেতে ইচ্ছা করছে। অথচ কোথাও সব্জী বাজার খুঁজে পাচ্ছেন না।