মৈঠা হাস্পাতাল থেকে এসে ইস্তক বিছানা ছাড়েনি, চারদিন হল। শুয়ে শুয়েই বাচ্চাটাকে দেখে, বিজন বাচ্চাটাকে কোলে দিয়ে যায়, দুধ খাওয়ায়। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে ওঠে। এত দুধ যে শাড়ি ভেসে যায়। কোমর থেকে বিষ ব্যথা। বাচ্চাটার আকারটা সবার চোখে পড়ে। এত বড় কেন? যেন দেড় বছরের বাচ্চা একটা। আর কি রূপ! এ তার মেজো ভাশুর ছাড়া আর কেউ না, লোকে যাই বলুক।
"এই মেয়েকেই নিয়ে যাব", মৈঠার মা-কে বলে এসেছিল তার মেজ ভাশুর। কি রূপ তার, অমন ফর্সা, টানা টানা চুল পিছনে, ইয়া লম্বা-চওড়া, কে বলবে মানুষটা জন খেটে খায়। কিন্তু কি যে রোগে ধরল মানুষটাকে, বাবা রে বাবা! তার বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিছানা নিল। লিভার ক্যান্সার। বড় ভালোবাসত গো মানুষটা। কলকাতায় হাস্পাতালে ভর্তি, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিল, সে বলল, ও ছোটো বউমা! একটু মাংস-ভাত খাওয়াও না গো। মনটা কেঁদে উঠল। বিজনকে বলল, তাই দাও দাদাকে, আর তো থাকবে না বলো মানুষটা? সেই শেষ খাওয়া।
মৈঠা রুটি করছে, চেপে থেবড়ে বসে আছে মেঝেতে। দু'দিন ধরে কি বৃষ্টি রে বাবা, ছাড়তেই চায় না। বিজন খাটে বসে টিভি দেখছে। আজ দোকান খোলেনি। বৃহস্পতিবার, বাড়ির সামনে লাগোয়াই তাদের মুদির দোকান। হরি বিছানায় শুয়ে খেলছে। এই দেড়মাস হল। হঠাৎ স্টোভের সামনের দেওয়ালে ঝোলানো হাতাটা 'ঠং' করে মাটিতে পড়ে গেল। মৈঠা মাথা তুলে তাকিয়ে, 'গোঁ গোঁ' আওয়াজ করতে করতে মাখা আটার থালায় মাথা গুঁজে পড়ে গেল। বিজন ছুটে এলো, কি হল, কি হল! তার চীৎকারে পাড়ার আশেপাশের বাড়ির থেকেও এ ও ছুটে এসেছে ততক্ষণে। মৈঠার জ্ঞান ফিরল পনেরো-কুড়ি মিনিট পর।
- পুরো দেখেছি গো স্পষ্ট... মেজদা ওইখানে দাঁড়িয়ে... মাটিতে পা নেই... আমাদের হরির মধ্যে ঢুকে গেল... আমি স্পষ্ট দেখলাম। পাড়ার লোক কেউ কেউ বলল, শীতলার থানে মানত করো; কেউ বলল, জলপোড়া দাও; কেউ বলল, গোবরের জল বামুন বাড়ি থেকে আনিয়ে নাও, ছেলেকে খাওয়াও।
মৈঠা শুনল না। মৈঠা জানে সকাল থেকেই আজ এরকম কিছু একটা হবে। আজ যখন হরিকে সকালবেলা বুকের দুধ দিচ্ছে তখনই জানে। বিজন বলল, তোমার যত ভুলভাল কথা। মৈঠা বলল, বিশ্বাস করো, আমি জানি, ও যখন আমার মামে মুখ দিচ্ছে আমি টের পেয়েছি ওর গা গরম। আমি ভাবলাম মাসিপিসী হয়েছে হয়ত। কিন্তু তা না গো। ওকে যখনই বিছানায় শোয়ালাম, ও বারবার ফ্যানের দিকে তাকাচ্ছে, ঘুরে ঘুরে ছাদের দিকে তাকাচ্ছে। এরকম তো করে না বলো? মৈঠা বিজনের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মেজদাকে বলো না গো ছেড়ে যেতে... বলো না...
ঠিক সেই সময়েই একটা কানে তালা লাগিয়ে বাজ পড়ল, সামনের নারকেল গাছটার শুকনো বেল্লোগুলোতে আগুন লেগে গেল। বৃষ্টির মধ্যেও দাউদাউ করে জ্বলছে সে বেল্লোগুলো। মৈঠা বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ, হরিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার গা।
পাশের বাড়ির খোকন বড়াল সরকারি হাস্পাতালে কাজ করে। সে সব শুনে বলল, ওকে আজকেই হাস্পাতালে নিয়ে এসো বিজনদা। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। মৈঠা বলল, না! আমাদের গ্রামে এসব আমি আখছার হতে দেখেছি, ওকে বাজে বাতাসে ধরেছে, হাস্পাতালে গেলেই ও মরবে। বিজন তর্কে যায় না, সে মেনে নিল, যদিও তার মনে হয় এই শহরে সবাই হাস্পাতালেই তো যায়, পাঁচশো বেডের হাস্পাতাল, কল্যাণীতে, কদ্দূর আর!
মৈঠা আর পাশের বাড়ির ননী, শিমুরালি যাওয়ার জন্য হালিশহর স্টেশানে এলো। ননীর শ্বশুরবাড়ির ওখানে একজন বড় গুণিন থাকে, সে অনেক মন্ত্রপড়া জানে। ট্রেনে উঠে জানলার পাশে বসল না মৈঠা, বদ বাতাসেই যত উৎপাত, ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। "এইটুকু বয়েস, এত বাড়?" পাশের একজন বৃদ্ধা সব শুনে বলল। বলল, কল্যাণী নেমে যাও, হাস্পাতালে গেলে ঠিক হয়ে যাবে, ওকে আন্টোবায়োটিক দিতে হবে না নে... কি সব মুখ্যুর মত ওঝা-গুণিন করছ বাপু...?
এইজন্য লেডিসে ওঠে না মৈঠা, বড্ড গায়ে পড়া সব। কার কি হয়েছে সবার হাঁড়ির খবর জানা চাই, কেন রে? সে হেসে বলল, ঝাঁঝালো গলায়, ওসব সূঁচ ফোটানো ডাক্তার বদ্যি আমার ঢের দেখা আছে ঠাকুমা, মানুষ মারতে ওদের জুড়ি নেই... আপনি ছাড়েন...
গুণিনের বাড়ির সামনে মেলা লাইন। বুকে বল এলো মৈঠার, এত লোক কি মিছিমিছি আসে, হাস্পাতাল ডাক্তারে কাজ হয় না বলেই যে না আসে। ননীর চিবুক ধরে চুমো দিয়ে বলল, তোর জন্যেই ছেলেটা আমার বেঁচে গেল রে মা এই যাত্রায়, এবার পুজোয় তোর দাদাকে বলে একটা সিল্ক দেওয়া করাবো তোকে দেখিস...
ননী হাসল। শাড়ীর উপর তার বিশাল লোভ, সে একটা নীল সিল্ক দিতে বলবে, মনে মনে ঠিক করে নিল। বলল, সে হবেখন দিদি, দাঁড়াও বৌদিকে বলি, আমাদের আগে ছেড়ে দিতে, দাদাকে বলে দিতে।
গুণিন বসে আছে চৌকিতে। খালি গা। পাশে এক ঝুড়ি শিকড়বাকড় রাখা। বলল, আয় বোস... ওকে তো তোর ভাশুরে ধরেছে মা... কি খেতে ভালোবাসত?
মৈঠা হাউমাউ করে কেঁদে বলল, কচি পাঁঠার ঝোল বাবা...
- তুই রাঁধতে পারিস?
- হ্যাঁ বাবা।
- সে তোকে দেখেই বুঝেছি, এমন সুলক্ষণা তুই মা... তা এক কাজ কর... সামনের অমাবস্যায় আমাদের এখানে রাঁধ... জামাইকে বলিস দেড় হাজার টাকা প্রণামী আর একটা কচি পাঁঠার দাম দিয়ে দিতে, তুই এসে রাঁধবি, তোর বৌদি সাথে থাকবে, বাকি সব আনুষাঙ্গিক জোগাড় করা থাকবে, পনেরো জন ব্রাহ্মণ আমার সাথে খাবে বুঝলি রে মা? সবই আমার পরিবারের, তোর পুণ্যি হবে...
টাকার খোঁচটা বুকে লাগল মৈঠার... তবু পায়ে পড়ে বলল, তাই হবে বাবা...
একটা ঘটির জল একটা ছোটো হোমিওপ্যাথির শিশিতে ঢেলে বলল, এই জল নিয়ে রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে ওকে খাইয়ে দিবি। মায়ের নাম নিবি। পাঁচটা জবা নিবি, ওর মাথার কাছে দুটো, হাতে একটা, নাভিতে একটা আর হাঁটুতে একটা রেখে দিবি। তোর ভাশুরকে বলবি, তুমি যাও দাদা, আমি তোমার তুষ্টির জন্য বাবার ওখানে গিয়ে রেঁধে তোমায় খাইয়ে আসব। তুই সেদিন নিজের চোখে দেখবি তোর ভাশুর আমার পাশে বসে পাত পেড়ে খাচ্ছে...
বলতে বলতে বাবা কেঁদে ফেলল..., বড় ভালো মানুষ ছিল রে... শুধু একটু দোষ পেয়েছিল মারা যাওয়ার সময় তাই এই ভোগান্তি... তুই যা... আমি সব ব্যবস্থা করে দেব...
ননীর চোখেও জল। সে মৈঠাকে বলল, চলো বৌদি। এখন বেরোলে শান্তিপুরটা পেয়ে যাব। তারা বেরোতে যাবে, হঠাৎ পিছন থেকে হুঙ্কার, দাঁড়া !
মৈঠার বুকটা ধড়াস করে উঠল, বাবা কি তার টাকার খোঁচটা টের পেয়েছেন?
-- শোন, তুই হালিশহরে নামার পর যখন বাড়ির দিকে যাবি, দেখবি তোর চারদিকে হাওয়া বাতাস কিচ্ছুটি নেই, কিন্তু গাছের পাতাগুলো সব নাচতে নাচতে তোর সাথে যাচ্ছে, বুঝলি...
মৈঠার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল, তাই হবে বাবা... তাই হবে... আপনি যে কালে বলছেন...
তাই হল, তারা দু'জন যখন হালিশহরে নামল তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে। সেই আবছা আলোয় দেখল সবক'টা গাছের পাতা তারা যেখান যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেখান সেখান দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে। সে উত্তেজনায় ননীর হাত চেপে বলল, দেখচিস?... ননী নীল সিল্কের শাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে বলল, তাই তো দিদি...
ননী লোকের বাড়ী ঝিয়ের কাজ করে খায়, বরটা মাতাল, একটা নতুন সিল্কের শাড়ি সে গায়ে দিতে পারবে, তার জন্যে এটুকু মন রাখা কথা বলতে পারে না?
রাত দুটো, হরির শ্বাসকষ্ট শুরু হল। বিজন বলল, পেটটা ফুলেছে দেখছ? চলো একটা গাড়ি ঠিক করে নিয়ে হাস্পাতালে যাই...
মৈঠা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, না, বলেছি তো আমি, সেই এককথা কতবার বলবে? আমি প্রাণ থাকতে ওর গায়ে ওই বিষাক্ত সূঁচ ঢোকাতে দেব না... না না।
মৈঠার চোখমুখ দেখে ভালো লাগল না বিজনের, সে চুপ করে গেল। রাতেই ঠিক হল হরিকে নিয়ে তারা সকালেই চন্দ্রকোণা যাবে, সাগরদীঘির গুণিন অনেক বড়। মৈঠা অনেকবার তার মেজ ভাশুরকে হরির মাথার কাছে বসে থাকতে দেখেছে। তার ভাশুরের জিভ লাল, রক্ত পড়ছে।
হরি শ্বাস নিতে পারছিল না। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাসেই মারা গেল হরি।
এই ঘটনার পর থেকে আর বাচ্চা নিতে চায়নি মৈঠা। বিজন বুঝিয়েছে অনেকবার। মৈঠা বারবার বলেছে না, তোমার দাদা আমায় ছাড়বে না। সব ক'টাকেই নিয়ে ছাড়বে।
আজকাল মৈঠার হাবভাব ভালো লাগে না বিজনের। নিজের মনে কথা বলে, রান্না চাপিয়ে ভুলে যায়। নুন দেয় না প্রায় তরকারিতে। রোজ বলে, তোমার দাদা স্বপ্ন দিয়েছে, ও আর হরি আজ পাঁঠার ঝোল খাবে। বিজন প্রথম প্রথম এনে দিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু তার এত সামর্থ্য কোথায়, তাছাড়া সে তো সে নিজেও খাবে না, তাকেও খেতে দেবে না, রেঁধে নিয়ে শিমুরালি চলে যাবে সেই গুণিনের কাছে। হরিকে আর তার মেজদাকে একসাথে ভাত খেতে বসতে দেখতে পায় সে, তার রান্নার সুখ্যাত করে। অনেকবার তার সাথে যেতে বলেছে মৈঠা তাকে, যায় না, তার বিশ্বাস হয় না।
এখন মৈঠার প্রতি মঙ্গলবার আর শনিবার ভর পড়ে। পাড়া-বেপাড়ার কত লোকে দেখতে আসে। লোকে বলে ভাগ্যে এমন বউ পেয়েছিলে বিজন, তোমার সাতকূল ধন্য হয়ে গেল।
বিজন কাউকে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। দোকানেও বসে না। যা প্রণামী আসে তাতে তাদের চলেই যায়। লোকে বলেছে এখানে একটা মায়ের মন্দির তৈরি করে দেবে। মৈঠা মায়ের নামে। বিজন মাথা নাড়ে, বলে মায়ের ইচ্ছা, আমি কি আর জানি ভাই। বিজনের ইচ্ছা করে গলায় দড়ি দেয়, কিন্তু দাদা আর হরির ভয়ে দিতে পারে না, মৈঠা তো সে জগতেও তার পিছনে পিছনে আসবে। বিজন এখন মদ খেয়ে এখানে ওখানে পড়ে থাকে। কেউ বলে এমন ভাগ্য মানুষটার যে এমন বউ পেয়েও অধর্মের পথে যায়। কেউ বলে, মৈঠার ধরা পুরুষ ভূতেরাই এই কীর্তি করেছে। কেউ বলে, না, হয় তো বিজনকে গোপনে পিশাচসিদ্ধ করেছে মৈঠা। কিন্তু যাই হোক, বিজনকেও শ্রদ্ধার চোখেই দেখে মানুষজন এখন।