Skip to main content

- পা থাকলেই কি লাথি মারা লাগে বোকা?

- না, লাগে না?

- বুদ্ধিমানের লাগে না, বোকাদের লাগে। 

- আমি কি বোকা তবে?

- তুই বল...

- আর চা নেবে?

- না রে... তুই খেলে খা...

- আমিও না... গ্যাস হয়... পেটের মধ্যে ভুড়ভুড়ি কাটে...

    মেলার আজ জমজমাট দিন। রাত আড়াইটের কাছাকাছি হবে। ঠাণ্ডা হাড় কাঁপানো। সতীমায়ের মেলা। এ মেলা এখন প্রাচীন বাংলার মেলা। প্রাচীন বাংলা বলতে মাথায় যা যা আসে, এ মেলায় তার অনেক কিছু পাওয়া যায়। বাউল, বৈষ্ণব, কীর্তন, পালাগান। সবই হয়। এ মেলা এখন মূলত সমাজের অধীনস্তরের মেলা। আমার গুরু বলেন, গরীব বলিস না, বাবুদের নয় দেমাকে লাগে, নয় বিবেকে। দুই-ই বড় বালাই। বল অধীনের স্তর। বড়লোকেরা বাড়িতে কুকুর-মানুষ দুই পোষে। পার্থক্যটা হল চারপেয়ে জন্তুটা সাধের, দু'পেয়ে জন্তুগুলান কাজের। কাজে না জমলেই গলা ধাক্কা, নয় গালাগাল। তাই বল অধীনস্তর। সমাজের উপরের দিকে জন্মায় শাসন, নীচের দিকে জন্মায় অধীনতা। 

    দণ্ডি কাটা দেখতে দেখতে আমার উল্লিখিত চরিত্র দু'জনে কথা বলছে। ধুর... দু'জনে কেন হবে? একজনে। তাকিয়ে থাকলেই বুঝি দেখা হয়? একজন যে অন্ধ। ওরা বাউলও নয় বৈষ্ণবও নয়, ওরা ভিখারি। আমরা তাই বুঝি। বাবুদের চোখে ভিখারি। 

    ভাপা পিঠের গন্ধ আসছে। পাঁপড় ভাজা হচ্ছে। সাদা সাদা পিঠেগুলোতে গুড় মাখিয়ে চাটছে জিভ। মুখটা হাঁ করে দেখেছিস কখনও? আমার গুরু আমায় প্রশ্ন করল একদিন। বললাম, রোজই দেখি। গুরু হেসে গড়গড়ায় ফুঁ দিয়ে বললেন, ধুস কলা, ওই দেখ না... একদিন আয়নার সামনে দাঁড়াবি। মুখটা হাঁ করে জিভটার দিকে তাকাবি, দেখবি মনে হবে একটা জন্তু। তোর মুখের মধ্যে আটকে আছে। সাপের ফণার মত মাথা নাড়াচ্ছে। কিছু বলতে চাইছে তোকে... দেখিস পরীক্ষে করে। 

    সাদা পিঠের গায়ে লাগা গুড় চাটছে মুখের মধ্যে আটকা জন্তু – জিভ। ক্ষুধার্ত। পেটের ভিতর কুয়ো। সে কুয়োর জল স্থির না হলে বুকের ভিতর হৃদিপদ্ম শুকায়ে যায়। বাবুরা আমার অম্বলে ভোগে, ক্ষুধায় না – গুরু বলতেন। তবে কি তাদের হৃদিপদ্মে সর্বদা প্রস্ফুটিত? জিজ্ঞাসা করলাম, সাহস করে। আমার গুরুর কাছে প্রশ্ন করতে সাহস লাগে, ক্ষ্যাপা তো। কখন ঘটিবাটি ছুঁড়ে মারে। 

    গুরু বললেন, ধনীর হৃদিপদ্ম বন্ধক দেওয়া থাকে – সুখের আড়তদারের কাছে। বাইরের সুখ আর অন্তরের সুখ কি এক হয় পাগল? বাইরের সুখের হয় আড়তদার আর অন্তরের সুখের হয় জোগানদার। আড়তদারের ভাঁড়ার শূন্য হয়, জোগানদারের না। 

    মাইক লাগিয়ে কানে তালা ধরিয়ে বাউল গান হচ্ছে। তত্ত্বকথা শোনার রসিক মেলা ভার আজকাল, তাই চটুলগানই ভরসা। এই মাইকের সঙ্গে সেই মাইকের গানের ঠোকাঠুকি। কোনো গানই স্পষ্ট শোনা যায় না। 

    অন্ধ অধীনকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে চক্ষুষ্মান অধীন বলল, জ্বালিয়ে দিই দাঁড়াও...

    দু'জনের জ্বলন্ত মুখ। সিক্তবস্ত্রে রমণীরা দণ্ডি কাটছে। মাটি আর কাদায় শরীর লেপে একাকার। চক্ষুষ্মান অধীন বলল, মারা গেলে সব ফক্কা বলো...

- রমণীতে মন টানে?...

- টানে... বউ আছে ঘরে... তেমন সুখ পেলাম না... শরীর মন দুটোই বড় উল্টো সুরে কথা বলে আমাদের...

- ছেলেপুলে?

- নেই...

- তাই এত মরার দেমাক...

- মরার দেমাক মানে?

- জীবনের উপর অনেক অভিমান জন্মে গেলে মানুষের মরার উপর দরদ বাড়ে... একে তাকে বলে বেড়ায়... মরে গেলে তখন বুঝবি... মৃতুকে দোসর ভাবে... বোকা...

- তোমার সবতাতে বোকা... মানুষের বৈরাগ্য জাগলে মরণের চিন্তা বাড়ে... শাস্ত্রে বলেছে...

- আর তুই পড়ে উল্টে দিছিস এক্কেরে... শালা...

- আর না তো কি... বৈরাগ্য নেই আমার?

- নেই... তোর ক্ষোভ আছে, বৈরাগ্য নেই...

- বৈরাগ্য মানে কি তবে?

- বৈরাগ্য মানে ব্যথা... সব থাকতিও ব্যথা... বুকের ভিতর কণ্ডাকটারের ডাকের দিকে কান পেতে থাকা... 

- উফ..., তোমার খালি হেঁয়ালি ... আবার কণ্ডাক্টর কোত্থেকে জোটালে... বাস কই?

- এই জীবনই তো বাস... কণ্ডাকটার আমাদের বুকের ভিতর...

- আর ডেরাভাইর?

- আলেখ নিরঞ্জন... আছে... আবার নেই... আবার নেই এর মধ্যেই আছে...

- মাথা গুলায়ো না দাদা... নেই এর মধ্যে আছে কিরকম?

- ধর তোর কারোর উপর প্রচণ্ড পীরিত জন্মালো... সেই পীরিত এসে কি করে? তোর বুকের খাঁচায় তুই নেই... শুধু সে... এই হল নেই এর মধ্যে আছে...

- বুঝলাম... তা কণ্ডাকটার কি বলে? টিকিট... টিকিট... খয়রার মোড়... জাগুলি... এরকম হাঁক মারে?

- মারে মারে... টিকিট চায়... মানে মন... মন না দিলি কিস্যু কোত্থাও নেই... আর হাঁক পাড়ে... লোভ... লোভ... কাম... কাম... ঈর্ষা... ঈর্ষা... তুই যেখানে নামতে চাইবি নামিয়ে দেবে...

- তারপর?

- ভালো না লাগলে আবার পরের বাস... কিন্তু একটা সমস্যা আছে...

- কি?

- অনেকে বাস দাঁড়াবার ছাওনিটাই আর টের পায় না... তাই পরের বাসের জন্যে অপেক্ষা না করে ওই এক ঠায়েতেই শুকিয়ে মরে...

- কিছু খাবা? ওই দ্যাখো হাতে গরম গরম খিচুড়ি নিয়ে আসছে...

- চল দেখি, পেটে টানও পড়েছে...

    অন্ধ অধীনকে নিয়ে চলল চক্ষুষ্মান অধীন। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি সামলে দু'জনে হাঁটছে। মেলায় নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা হচ্ছে। অমুক নীল জামা, কালো প্যান্ট, নাম এই, বয়েস এই, অমুক জায়গা থেকে এসেছে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। 

    আমি ধীরে ধীরে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রটা খুঁজতে শুরু করলাম। যে হারিয়েছে তাকে আমার একবার দেখতে ইচ্ছা করছে। যে তাকে খুঁজে পাবে তাকেও দেখতে ইচ্ছা করছে। তাকে পেয়ে সে বকবে না কাঁদবে তাও দেখি। 

    হাঁটতে হাঁটতে দুধপুকুরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। এই শীতে মানুষের স্নানের কি ঢল! মানুষ ইচ্ছা করে সহ্য করে, যেন মহড়া দেয়। জীবন তাকে যতটা কঠিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বলে, সে যেন ইচ্ছা করেই তার চাইতেও কঠিন রাস্তায় হাঁটতে পারে। এ এক অভিমান। ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর খেলা। আমিও পারি। তবু মানুষ কাঁদে। তবু হাঁটে। তবু জড়িয়ে ধরে। তবু ছেড়ে যাওয়া হাতের গন্ধ নিজের হাতে মেখে পরের হাতটা খোঁজে। শূন্য চোখে মানুষ শুধু মানুষকে খোঁজে। শ্মশান থেকে প্রসূতিগৃহ শুধু মানুষ আর মানুষ। 

- আপনার কাছে দেশলাই হবে?

    দিলাম। আমি সিগারেট খাই না। তবু দেশলাই পকেটে নিয়ে ঘুরি। দেশলাই থেকে অনেক গল্পের শুরু হয়। এখনই হবে, শুনুন। 

- ওই যে, আমার স্ত্রী, দণ্ডি কাটছে... আমার মেয়েটার থ্যালাসেমিয়া। রক্ত কমে এলে গা গুলায়, মাথা ঘোরায়, মেঝেতে বসে পড়ে ওর মাকে ডাকে... আমার বিরক্ত লাগে জানেন মশায়... বিরক্ত লাগে... মনে হয় মরে না কেন মেয়েটা? আপনি অবাক হচ্ছেন...ভা বছেন বারো বছরের মেয়ের মৃত্যুকামনা বাবা হয়ে কি করে করি? করা যায় মশায়... বুকের উপর পাথর জমিয়ে করা যায়... আমায় বুকের ভিতরটা কি হয় আমি জানি... মেয়েটার বুকটা হাপরের মত ওঠে পড়ে মশায়... একটু বাতাসের জন্য কাকুতি মিনতি করে... সারা পৃথিবী ভর্তি এত বাতাস... ওর ওই ছোট্টো বুকটার সঙ্গে কি শত্রুতা বলুন? কিন্তু শালা...

    মানুষটার মুখের থেকে মদের গন্ধ শীতল বাতাসের সঙ্গে মিশে আমার মাফলার ভেদ করে ঢুকে পড়ছে.... আমার ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ডে ছ্যাঁদা খুঁজছে... আছে তো ছ্যাঁদা... মানুষের চোখের দিকে তাকালে মানুষের ফুসফুসে আর হৃৎপিণ্ডের ছ্যাঁদা গোনা যায়... আমার গুরুদেব বলতেন..... মানুষটা মদ খেয়েছে... কিছুটা দূরে গোলাপী শাড়ি পরা একজন মহিলা দণ্ডি কাটছে.. মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা করতে এসেছে... আমি কার গল্প শোনাব নিজের মস্তিষ্কের শিক্ষিত যুক্তিবাদী নিউরনগুচ্ছকে? সেই বুদ্ধের সরষে আনতে বলার গল্প, না বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্প? না যীশুর মৃতকে জাগিয়ে তোলার গল্প? বুকের মধ্যে রক্ত আর মাথার মধ্যে নিউরন বলল, মেয়েটা বেঁচে থাকুক...

    লোকটা চলে গেছে... একটু দূরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সিগারেট টানছে। ওর চশমার উপর লেগে পড়ে আছে রাস্তার পাশে জ্বলে থাকা হলুদ আলো। মানুষটা কাঁদছে। একজন অসহায় বাবার কান্না বোবা আকাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এমন মেলায় এসে অনেকে কাঁদে। অনেক মানুষের ভিড়ে নিজের নিঃস্বতার জন্য বড় মায়া মানুষের। মানুষ কাঁদে। আমার যেমন কান্না পাচ্ছে এখন। কার জন্য জানি না। কেন জানি না। কিন্তু আমাকেও কাঁদতে হবে। না কাঁদব না। হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার কথা আবার ঘোষণা হল। সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি বরং প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রটা খুঁজে বার করি। আমার সেখানে যাওয়া দরকার। এখনও নিতে এলো না কেন? শুনতে পায়নি? ইচ্ছা করে রেখে যায়নি তো?